শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৮:০০
ব্রেকিং নিউজ

শুভ জন্মদিন হে কীর্তিমান

শুভ জন্মদিন হে কীর্তিমান

আশেক মাহমুদ সোহান 
 
পাবনা শহরের ইন্দিরা পট্টি থেকে বঙ্গভবন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মো. সাহাবুদ্দিন এর এই ৭ দশকের যাত্রা মোটেও সহজতর ছিল না। তিনি দীর্ঘ অধ্যবসায় ও কর্মের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, নিজেকে নির্মাণ করেছেন, আদর্শে একচুল ছাড় না দিয়ে শত বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সেই অমিয় বাণীর মতো 'কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না'। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে পাবনার সেই টগবগে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, হামিড রোডের মিছিলের সকলের প্রিয় চুপপু ভাই আজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি; বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পাবনাবাসীর এই শ্রেষ্ঠ উপহার। জন্মলগ্ন থেকেই তার দেশপ্রেমিক সত্তার জাগরণেই তিনি কঠিন পথ জেনেও রাজনীতিকেই বেছে নিয়েছিলেন, সেই পথেই আজ তিনি বাংলাদেশের অভিভাবক। 'সত্য যে কঠিন, কঠিনরে ভালোবাসিলাম,যে কখনো করে না বঞ্চনা', আসলেই যে সত্যকে যিনি হৃদয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন, লালন করেছেন জীবনের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে; তারই চূড়ান্ত রুপ আজ তিনি আমাদের মহামান্য। 
 
বঙ্গবন্ধুর ডাকেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পরেন, তিনি নিজেই তার এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ বইয়ে উল্লেখ করেছেন," সদ্য এসএসসি পাস করেছি, পরিচয়ে তখনো কলেজের তকমা পাইনি। রাজনীতির কতটুকুইবা বুঝি? কিন্তু ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি দীর্ঘদেহী এই মানুষটির স্নেহমাখা ‘মাঠে আয়' স্বরে কী যেন লুকিয়ে ছিল। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম – কেউ না নিলেও একা একা জনসভায় যাব। কিন্তু সেটি আর করতে হলো না। সবার সঙ্গেই টাউন হলে গেলাম। বঙ্গবন্ধু ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, মনের অজান্তেই মুগ্ধ শ্রোতা থেকে গগনবিদারী স্লোগানদাতা হয়ে গেছি। মাধ্যমিকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলাম। কিন্তু ঘন্টাখানেকের ব্যবধানে আমি যেন তাঁর ছাত্রলীগের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। সেই সক্রিয় প্রবেশ কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর ‘মাঠে আয়' নির্দেশের মধ্য দিয়ে ঘটল। মূলত রাজনীতিতে আমার সক্রিয় ভাবটা ওই মুহূর্ত থেকেই। এরপর আর পেছনে তাকাইনি। তাকাতে হয়নি।" 
 
ছাত্রজীবনে এই পাবনার মাঠ ঘাট প্রান্তরে মুক্তির বার্তা নিয়ে পৌঁছে গেছেন, একজন রানার যেমন চিঠির বস্তা কাঁধে ছুটে চলে যতক্ষণ পর্যন্ত গন্তব্যে না পৌঁছায়। তারও গন্তব্য ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চুড়ান্ত বিজয়, আমাদের স্বাধীনতা। ইছামতীর পাড়ে বেড়ে ওঠা সেই তরুণের বুকে বঙ্গোপসাগরসম ভালবাসা ছিল দেশের প্রতি, তাইতো জীবন বাজি রেখে ৩০৩ রাইফেল কাঁধে নিয়ে চরম শত্রুর চোখে চোখ রেখে মোকাবিলা করেছেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সেই মহান প্রত্যাবর্তনের পর, বঙ্গবন্ধুর সাথে সহযাত্রী হিসেবে তিনিও দেশ পুনর্গঠনে অংশ নেন। ঐতিহাসিক মুজিব বাঁধ যা পাবনাবাসীর রক্ষাকবচ নামে খ্যাত সেই বাঁধ উদ্বোধনে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য হিসেবে তাঁর পাশে থেকে সমাবেশস্থলে লক্ষ জনতার সামনে বক্তব্য দেন এবং বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ পান। পরবর্তীতে পাবনার ছাত্র ও যুবদের সংগঠিত করতে যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো ব্যয় করেন। তবে তার মাঝে যে গুণের আঁধার, তা প্রমাণ মেলে সাংবাদিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও সুনাম অর্জন করার মাধ্যমে। তিনি আইন পেশায়ও মনোনিবেশ করেন এবং খুব অল্প সময়েই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতেন এবং তার শত্রুদের বিপদেও তাদের সাহায্য করার মতন মহান মানসিকতার অধিকারী হিসেবে বারবার প্রমাণ রেখেছেন, তার বাল্যবন্ধু অধ্যাপক শিবজিৎ নাগ বলেছেন," সাহাবুদ্দিন চুপ্‌পুর সঙ্গে সেই বাল্যকাল থেকে আমার বন্ধুত্ব। পাবনা শহরে ওর আড্ডার মূল জায়গা আমাদের নাগ মার্কেট এবং লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার । সে নিরহঙ্কার, সদালাপী, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক এবং ক্ষমাশীল মানুষ। এক সময়ের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যারা তাঁর জীবন নাশের চেষ্টা পর্যন্ত করেছে, তাদের দুর্দিনেও চুপ্‌পুকে দেখেছি সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে।"
 
১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টের পর এদেশে যেমন অমানিশা অন্ধকার নেমে আসে,তেমনি তার জীবনও কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায়। তাকে কারাগারের নির্মম প্রকোষ্ঠে পাঠানো হয় এবং তার উপর নিপীড়ন চালানো হয়। কারণ ঘাতকের দল বুঝে গিয়েছিল কোনোকিছুর বিনিময়েও তাকে দমায়ে রাখতে পারবে না। তিনি জেলখানার সেই দুঃসহ স্মৃতি তার লেখায় উল্লেখ করেছেন," গ্রেফতারের পর জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিকে কোনো এক গভীর রাতে জেলখানা থেকে চোখ বেঁধে বালুর ট্রাকে করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় নতুন উদ্যমে নির্যাতন। সেই নির্যাতনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডিএসপি কংশধর তরফদার। ছিলেন পাকিস্তান-ফেরত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমানও। ফজলুর রহমান আমাকে একের পর বুটের লাথি মারতে থাকেন, আর বলতে থাকেন, 'এই ব্যাটা তোর বঙ্গবলটু কোথায়?' এও বলা হয় – 'তোরা মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করেছিলি, মিছিল করেছিলি? তোদের গুলি করে মারা হবে। ভেবেই নিয়েছিলাম, জীবন চলে যাবে। যে দেশে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হন, সে আমি আর এমন কী! কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম, আমাদের আবারও গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে। পরে সেনা ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় পুনরায় কারাগারে প্রেরণ করা হয়।" স্ত্রী ও শিশু দেড় মাসের সন্তানকে রেখে দীর্ঘকাল তাকে জেলে কারাভোগ করতে হয়।
 
তবে বঙ্গবন্ধুর জীবনে যেমন ছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা, তেমনি তার জীবনেও সুখে-দুঃখে পাশে ছিলেন তার সহধর্মিণী রেবেকা সুলতানা। তার কলেজ জীবনের সহপাঠী থেকে সারাজীবনের সাথী হিসেবে সকল বিপদে আপদে সুখের ছায়া, আঘাতের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে সাহস জুগিয়েছেন। সহধর্মিণী প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, "এডওয়ার্ড কলেজের এই ছায়া ঘেরা অঙ্গনেই তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে এ কলেজেরই সহপাঠী মেধাবী ছাত্রী রেবেকার সাথে। সেদিনের সেই রেবেকা আজ আমার সহধর্মিণী হয়ে সকল কাজের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।" 
 
পরবর্তীতে তিনি বিসিএস (মুন্সেফ) হিসেবে সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন এবং বিচারকের মতন একটি মহান পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। মাননীয় ফাস্ট লেডি ড. রেবেকা সুলতানাও একজন যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসর নেন।
 
অবসর গ্রহণের পর দুদকের কমিশনার হিসেবে তিনি পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তার বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে যে তথাকথিত দূর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছিল তা তিনি প্রমাণের সহিত খণ্ডন করেন। তিনি পরিস্কারভাবে তার বক্তব্যে বলেন," যখন অনুসন্ধানে নামা হলো তখন এটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। যতগুলো প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নিয়েছে প্রত্যেকের বক্তব্য নিয়েছি। দশটা ফার্ম পরিষ্কারভাবে বলছে, ‘আমাদের টেন্ডার প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো এলিগেশন নেই। আমরা বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দিলাম যে, ‘আপনারা বলছেন যে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছে, এটার তো এই অবস্থা।' ওরা চুপ হয়ে গেল। উত্তর দিল না। তার কয়দিন পরেই, পনেরো দিন যেতে না যেতেই তারা বললেন, 'দুর্নীতি তো হয়নি, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে'। যার কোনো ভিত্তি নেই। আমরা ফাইনাল রিপোর্ট দিলাম।" এর পরবর্তী ঘটনা বাঙালির তো বটেই সমগ্র বিশ্ববাসী জানে, বাঙালির নিজের টাকায় পদ্মা সেতুর মত স্থাপনা আজ দৃশ্যমান। 
 
জীবনের কোন সংগ্রামে তিনি পিছপা হননি, কোনো চ্যালেঞ্জ তাকে দমাতে পারেনি, এর কারণ তার চিন্তাচেতনা ও দর্শন ছিল নিজ পেশায় শতভাগ সৎ থেকে শুধুমাত্র মানুষের সেবা করা। একটা কথা আছে,সৎ থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ভয় পাওয়ার কিছু থাকেনা। তাইতো নাগরিক সংবর্ধনার ঐতিহাসিক সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে এডওয়ার্ড কলেজের স্মৃতিবিজরিত মাঠে তিনি বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ বিরোধী অপশক্তিকে বলিষ্ঠ স্বরে জানান দেন, 
 
"Whatever i will face, i am ready to face at anytime"
 
বঙ্গবন্ধু যেমন 'মাঠে আয়' ডেকে এই কীর্তিমান পুরুষকে তাঁর আদর্শিক রাজনীতির সাথে সংযুক্ত করেছিলেন, ঠিক তেমনি তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা তার জহুরির চোখ দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ২২ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাকে নির্বাচন করলেন। একজন সাবেক ছাত্রনেতা,যুবনেতা,সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারক, কলামিস্ট ইত্যাদি বহুগুণে গুণান্বিত মানুষটি আজ বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। মহান এই মানুষটির জন্মদিনে তার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম ও শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন, হে কীর্তিমান।
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK