শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৪:৪৮
ব্রেকিং নিউজ

৭ নভেম্বর : মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার হত্যা দিবস

৭ নভেম্বর : মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার হত্যা দিবস

মোহাম্মদ হানিফ হোসেন
 
আজ ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্মম অধ্যায়ের সূচনা হয়। সেদিন সেনাবাহিনীর ভেতরে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বে সাথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এদিনের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ওলোট-পালট করে দেয়। যার রেশ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি জাতি। 
 
৭ নভেম্বর একটি গোষ্ঠির কাছে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। আর মুক্তিযুদ্ধের অনুসারীদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস। ইতিহাসের পাঠ থেকে জানা যায়, সিপাহী বিপ্লবের নামে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শুরু হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে স্বাধীনতা বিরোধী-ঘাতকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর একই ঘাতকচক্র ৩ নভেম্বর জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর চারদিন পর ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা। যেই ধারাবাহিকতা চলে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার পুরো সময়। আর এই হত্যাকান্ডের নেতৃত্বে ছিল বর্তমানে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস দাবিদার অংশটির এক সময়কার শীর্ষ নেতৃত্ব। এদিন প্রথমে হত্যা করা হয় তিন খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধাকে। এরা হলেন- খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম, কে এন হুদা বীরউত্তম এবং এটিএম হায়দার বীরবিক্রম। জানা যায়,  দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে অবস্থানকালে সকালে তাদের একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে দু’জন কোম্পানি কমান্ডার আসাদ এবং জলিল। এ ব্যাপারে সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহ্যাস তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘এদিন উচ্ছৃংখল জওয়ানরা একজন মহিলা ডাক্তারসহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এমনকি একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এ সময় হত্যা করা হয়।’ বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে লিখেছেন কর্নেল শাফায়াত জামিল বিদ্রোহের খবর পেয়েও  থেকে গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। যখন বিদ্রোহী সেনারা স্লোগান দিতে দিতে বঙ্গভবনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় তখন তিনি সঙ্গীদের নিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান। এতে তার পা ভেঙ্গে যায় এবং পরে ধরা পড়েন। তাকে ভর্তি করা হয় সামরিক হাসপাতালে। উল্লেখ, ৬ নভেম্বর  ভোর রাতে গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের ল্যান্সার বাহিনীর একটি দল। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার অন্যতম ঘাতক ল্যান্সার মহিউদ্দিন ছিলো এই দলের নেতৃত্বে। তারা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে নিয়ে আসে কর্নেল রশিদের দুই নম্বর আর্টিলারি রেজিমেন্টের দপ্তরে। গোলাম মুরশিদ আরো বলেন, মুক্তি পেয়েই জিয়াউর রহমান সদ্য নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের অনুমতি ব্যতিরেকে বেতারে ভাষণ দিতে চলে যান।
 
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জিয়া রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেয় । ১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল জিয়াউর রহমান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। বিচারপতি সায়েম তার At Bangabhaban, Last phase গ্রন্থে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। সংবিধান ও সেনা আইন লঙ্ঘন করে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে হ্যাঁ-না গণভোটের নাটক সাজিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া সামরিক আইনের অধীনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। এ সময় জিয়া মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করে ।
 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেয়া হয়। আইনটির নাম ছিলো সংবিধান (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিল।
পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত কিন্তু জিয়াউর রহমান তা না করে আইনটি সংসদে পাস করেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে অনুমোদন দিয়ে জিয়া প্রমাণ করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের রক্ষক এবং ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়ানক। মোশতাক ও জিয়া সরকার খুনিদের অপরাধের বিচার না করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে কূটনৈতিক পদে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ ও জিয়ার সহধর্মিণী খালেদ জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেননি বরং তারা দায়মুক্তি আইনের  দোহাই দিয়ে খুনিদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়।
 
জানা যায় জিয়ার আমলে ২০টির বেশি অভ্যুত্থান হয়েছিল। এসব অভ্যুত্থানে অসংখ্য সামরিক সদস্য নিহত হন। যাদের বেশিরভাগই মুক্তিযোদ্ধা। বিশেষ করে ’৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীর অভ্যুত্থানের পর শত শত লোককে বিনা বিচারে অথবা সংক্ষিপ্ত বিচারে হত্যা করা হয়। এক পর্যায়ে বিমান-বাহিনীতে মাত্র ১১ জন কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের মধ্যে বিমান চালাতে পারতেন মাত্র তিনজন।’ বিশ্লেষকদের মতে, এসব অভ্যুত্থানে কম পক্ষে আড়াই হাজার সেনা সদস্য নিহত হয়। সর্বশেষ ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক পূর্ণ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মেজর মঞ্জুরসহ ১১ জন সামরিক কর্মকর্তা যাদের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিলো তাদের প্রহসনের (!) বিচারে ফাঁসি দিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যাকারিরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে দেশকে আবারও সে জায়গায় নিয়ে যায়। বলা যায়, জিয়াউর রহমানের হাত ধরে তা এক ধরনের সফলও হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সিপাহী বিপ্লবের নামে কার্যত ৭ নভেম্বর থেকেই শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যা প্রক্রিয়া। আসলে ৭ নভেম্বরের কর্নেল তাহেরের ভ্রান্ত নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানকে সরকারে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেয়া হয়েছিল। অথচ কর্নেল তাহেরকে ২১ জুলাই ১৯৭৬ ফাঁসি দেওয়া হয় জিয়াউর রহমানের নির্দেশে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে। আর ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ পরবর্তী সেনা বিদ্রোহগুলোতেও ভূমিকা রেখেছিল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট গবেষকগণ ৭ নভেম্বরকে ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যাকান্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 
 
১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করান এবং নিজে রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’সহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সকল অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেয়। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিলো সংবিধান (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিলো। পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত কিন্তু জিয়াউর রহমান তা করেননি। তিনি সামরিক জান্তা বরং খুনিদের সুবিধা দিয়ে চাকরি দিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মেজর মঞ্জুরসহ ১১ জন সামরিক কর্মকর্তা যাদের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিলো তাদের ফাঁসি দিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এভাবে ষোলকলা পূর্ণ হয় মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যার ইতিহাস দিয়ে। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে বীর বাঙালি বীরত্বে সঙ্গে লড়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, দেশ স্বাধীনের পর ছদ্মবেশি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসরদের হাতে সেই বীর সন্তানদের প্রাণ দিতে হয়। ৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর অফিসার হত্যাকান্ড তারই একটি অধ্যায়।
 
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক কর্মী  
 
 
 
 
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK