শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৪:০১

সংস্কৃতি ও শিল্পবান্ধব বঙ্গবন্ধু

সংস্কৃতি ও শিল্পবান্ধব বঙ্গবন্ধু

আতাউর রহমান : আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্তিকালগ্ন শিল্প, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি শিকড় থেকে উৎসারিত, মনে-প্রাণে ও হৃদয়ে একজন বাঙালি ছিলেন। টুঙ্গিপাড়ার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা বাবা-মায়ের আদরের ছেলে খোকাই কালে হয়ে উঠলেন বাঙালির ত্রাতা এক মহামানব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংগ্রাম, প্রজ্ঞা এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ইতোমধ্যে বহু আলোচনা হয়েছে, যা আজ সকল বিশ্বমানবের জ্ঞাত। তার ৭ই মার্চের ভাষণসহ, দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে তার উৎসর্গকৃত জীবন সংগ্রামের কাহিনি আজ আর কারও অজানা নেই। শেখ মুজিবুর রহমানের একক সত্তা আর বাঙালির সামগ্রিক পরিচিতি মিলেমিশে আজ এক দেহে লীন হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাই বাঙালির সকল সুকৃতি, বীরত্ব, দৃঢ়চিত্ত সংকল্প ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিলেন।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন খাঁটি বাঙালির জীবনাচরণ ও বাঙালির হাজার বছরের পুরনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সুকৃতিকে ধারণ করে তিনি নিজ অন্তরে স্থাপন করেছিলেন। কালে তিনি শিল্প, সাহিত্য দেশীয় সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ এক পরিপূর্ণ বাঙালি যুবক হিসেবে বর্ধিত হন। পরবর্তী কালে তার সামগ্রিক রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রে তার প্রতিভাস পরিলক্ষিত হয়। তার জীবন ও রাজনৈতিক সাধনার মূলমন্ত্র নিহিত ছিল বাঙালির হাজার বছরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গৌরবময় ঐতিহ্যের মধ্যে। উনি দ্বিজেন্দ্রলালের গানের কথার সাথে সম্পূর্ণ ঐক্যমত পোষণ করতেন বলে আমি মনে করি। সেই গানের নির্জাস কথাটি হলো- সকল দেশের রাণী সে যে, আমার জন্মভূমি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শ্রুতিধর, যা একবার তিনি দেখতেন, পড়তেন অথবা শুনতেন তা তিনি কখনও ভুলতেন না। বাংলাদেশের কয়েক হাজার মানুষকে উনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, এমনকি তাদের পারিবারিক ইতিবৃত্তও জানতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা তার মুখস্থ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান ও কবিতার লাইন উনি প্রায়ই আওড়াতেন। আশ্চর্যজনকভাবে উনি আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্দ্বিধায় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। উনার সামনে আরও পছন্দের সংগীত ছিল, কিন্তু অন্য সংগীত বাদ দিয়ে উনি এই বিশেষ গানটিকে আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আমি ধারণা করি, আমাদের জাতির পিতা জানতেন যে, তরুণ বয়েসে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতার আদেশে তখনকার পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, পতিসর ও সাজাদপুরে প্রায় সাত বছর বসবাস করেছিলেন, তাদের পৈতৃক সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করার জন্য এবং এই সময় কালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে বসে তার বিখ্যাত পত্র-গ্রন্থ ‘ছিন্নপত্র’ রচনা করেছিলেন। এই সময়ে উনি মহাত্মা লালন ও গগন হরকরার গান শুনে বিমোহিত হয়েছিলেন। গগন হরকরার লেখা বাউল গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’, রবীন্দ্রনাথের কলমে রূপান্তরিত হয়ে রচিত হলো ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। পরবর্তীতে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটি রচনা করেছিলেন। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থভাবে মনের অন্তর্গত আকর্ষণে পূর্ব বাংলার মাটির সাথে সম্পৃক্ত এই গানটিকে আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অনন্য প্রতিভাবান একজন মানুষ। তিনি ৭ই মার্চ এ জগৎ কাঁপানো এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন তখনকার রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে), যা বিশ্ব ইতিহাসে সর্বকালের সেরা এবং সর্বাধিকবার শ্রুত বক্তৃতার দুর্লভ স্বীকৃতি পেয়েছে। পৃথিবীতে অনেক গণনায়কদের বক্তৃতা যুগ যুগ ধরে আমাদের আন্দোলিত ও অনুপ্রাণিত করেছে; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ছিল তুলনাহীন। এই বক্তৃতা পাকিস্তানিদের দাসত্ব শৃঙ্খল ভাঙার জন্যে লক্ষ-কোটি বাঙালির মনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। যারা আধুনিক যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে কিছু জানত না তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জীবনপণ যুদ্ধে, সামান্য ঘরোয়া অস্ত্রকে সম্বল করে এবং প্রাণ দিয়েছিল ত্রিশ লক্ষ বাঙালি এবং সম্ভ্রম হারিয়েছিল প্রায় দুই লক্ষ মা-বোন। আশ্চর্যজনকভাবে ষোড়শ শতকের বিশ্বখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার ও কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের মার্ক এ্যাস্টনির বক্তৃতার অনন্য বিষয়বস্তু ও কাব্যিক দ্যোতনার সাথে বঙ্গবন্ধুর যেন স্বর্গ থেকে প্রেরিত ৭ই মার্চের কথামালার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্যেই আমরা প্রমোদকর ছাড়া মঞ্চে নাট্যাভিনয় করতে পারি। উনি রাষ্ট্রপতি থাকার সময় নাটকের ওপর থেকে প্রমোদকর বাতিল করেছিলেন। তারই সুযোগ্য কন্যা, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে ‘সেন্সরশিপ’ তথা নাটকের পাণ্ডুলিপির ওপর থেকে ছাড়পত্র নাকচ করে দেন। ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি)-এর প্রতিষ্ঠাও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে) বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল।
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি জিয়া হায়দারসহ বর্তমান লেখক (প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক) বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত বাড়িতে একাধিকবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, আমাদের নানা আবদার ও তদবির নিয়ে। শেষবার গিয়েছিলাম একটি যাত্রাপালা বিদেশ ভ্রমণের তদবির নিয়ে। দলপ্রধান থাকবে জিয়া হায়দার এবং উপ-নেতা থাকব বর্তমান লেখক, এই ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাদের নিবেদন। বঙ্গবন্ধু তখন বিরোধী দলের সর্বপ্রধান হিসেবে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার গভর্নর মালেক সাহেব ছিলেন পাকিস্তান সরকারের ক্ষমতাহীন এক পুতুলের মতো। মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন; কিন্তু তার সত্যিকার রূপকার ছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে আমি দুবার দেখেছিলাম বাঙালির আটপৌরে পোশাকে। পরনে ছিল সাদা চেক-চেক লুঙ্গি এবং গায়ে হাতাওয়ালা সাদা গেঞ্জি। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত কবি বেগম সুফিয়া কামালের বাড়িতেও আমি তাকে দেখেছি এই ঘরোয়া পোশাকে। বেগম সুফিয়া কামালকে উনি বুবু বলে ডাকতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি ও বিদেশি লেখক এবং কবিদের ভক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে আমি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ নিজ কণ্ঠে গাইতে শুনেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতা তার মুখস্থ ছিল এবং আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সত্তা ও লেখার সাথে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবির উচ্চাসন অলংকৃত করেন। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিলেত ও ভারত হয়ে ঢাকা পুরনো তেজগাঁও এয়ারপোর্টে প্রচ- ভিড়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম। তিনি আগের তুলনায় কৃশকায় হয়ে গিয়েছিলেন এবং তার সহকর্মীদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন এবং আবৃত্তি করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ থেকে-
“নমঃ, নমঃ, নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি। গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।”
আমার এই সামান্য লেখার ইতি টানবো এই বলে যে; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি সুযোগ ও সময় পেতেন তাহলে তার লেখা ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম চার্চিলের মতোই বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পেত। সামান্য উদাহরণ হিসেবে তার রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এর নাম উল্লেখ করতে হয়। এমন সহজ, সুন্দর ও নান্দনিক গদ্য রচনায় আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি সব বড় প্রথিতযশা লেখকের সহজ-সুন্দর ভাষা ও ভাব প্রকাশের ভঙ্গি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। তার জীবনের একটা বিরাট অংশ যদি কারাগারে না কাটাতে হতো, তাহলে আমরা বাংলা সাহিত্যের আরও একজন প্রথিতযশা লেখককে পেতাম, যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান; যিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। আমি এই মহান সংস্কৃতিমনা ও লেখক সত্তায় সমৃদ্ধ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহান স্মৃতির প্রতি প্রণতি জানাচ্ছি। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারই জয় হয়েছে।
 
লেখক : মঞ্চসারথি, কবি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK