মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১০:২৩
ব্রেকিং নিউজ

ফলপ্রসূ এক সফর

ফলপ্রসূ এক সফর

হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, উত্তরণবার্তা  : হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যাওয়া নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গত ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও শেখ হাসিনা দুই পক্ষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগের ৪০ বছরের তুলনায় আরো বেশি কার্যকর ফল অর্জন করেছেন। তাই দুই প্রধানমন্ত্রীই যখন এই সময়টিকে ‘সোনালি অধ্যায়’ বা ‘সোনালি যুগ’ বলে উল্লেখ করেন, তখন অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকে না।

সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যে নয়াদিল্লি সফরটি সংক্ষিপ্ত হলে এই সফর আগামী কয়েক দশক ধরে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত গতিশীল উপাদানে ভরপুর ছিল। প্রটোকল অনুযায়ী এটি ‘রাষ্ট্রীয় সফর’। এর শুরু রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনার মাধ্যমে।

গত ৯ জুন মোদি সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শপথ অনুষ্ঠানে অন্য প্রতিবেশী দেশের নেতাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার অংশগ্রহণের ১৫ দিনের মধ্যে এ সফর। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ২১-২২ জুনের সফরটি প্রধানমন্ত্রী মোদির তৃতীয় মেয়াদে প্রথম দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফরই শুধু ছিল না, গত জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর এটিই বিদেশে তাঁর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল।

এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতি পরস্পরের গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিফলন। বিগত এক দশকে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের মৌলিক রূপান্তর হয়েছে।

তবে শুধু এটুকু বললে বিষয়টাকে ছোট করে দেখা হবে। বাণিজ্য, নিরাপত্তা, সংযোগ, বিদ্যুৎ, ডিজিটাল সংযোগ, জনগণের আসা-যাওয়া এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক—প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

ঐতিহাসিক সম্পর্ক একটি সাধারণ ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিলে সার্বভৌমত্ব, সমতা, বিশ্বাস এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটি আধুনিক শক্তিশালী অংশীদারিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকে ভারত দেখে ‘নিকট ও মূল্যবান প্রতিবেশী’ হিসেবে।

ভারত মনে করে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে। ‘সাগর (সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিওন) ডকট্রিন’ এবং নয়াদিল্লির ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনের পাশাপাশি ভারতের ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ (নেইবারহুড ফার্স্ট) ও ‘পূর্বের দিকে সক্রিয় হওয়া (অ্যাক্ট ইস্ট)’ নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি ‘অভিসারী বিন্দু’ বা ‘আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্র’ হিসেবে দেখা হয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশীদার।

অন্যদিকে বাংলাদেশও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘একটি প্রধান প্রতিবেশী’ ও ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’র (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা অনুযায়ী) এবং অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক হিসেবে মূল্যায়ন করে। এশিয়ার ভেতর বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার এই ভারত।

প্রকৃতপক্ষে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, দক্ষিণ এশিয়া এবং এই অঞ্চলকে ছাপিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মডেল হিসেবে কাজ করছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। এতে বড় অবদান রেখেছে বিভিন্ন পর্যায়ে টেকসই সংলাপ, যার ভেতর প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের সংলাপও রয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও উল্লেখ করেছেন, বিগত বছরে তিনি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ বারের মতো সাক্ষাত্ করেছেন। এই সফরে দুই প্রধানমন্ত্রী মিলে দুই দেশের গতিশীল সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল ১০টি সমঝোতা এবং দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা, প্রণোদনা ও রসদ।

প্রধানমন্ত্রী মোদির ভাষায়, ভারতের ‘২০৪৭-এর মধ্যে বিকশিত ভারত’-এর স্বপ্ন ও বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১’-এর ওপর ভিত্তি করেই দুই দেশের ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভবিষ্যৎ’-এর পরিকল্পনা করা হয়েছে। “ভবিষ্যতের আলোকে ‘ভারত-বাংলাদেশ’-এর যৌথ পরিকল্পনা : একই ধারায় উন্নতির লক্ষ্যে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও সহযোগিতা বাড়ানোর” বিষয়টিতে পরিবেশ, টেকসই উন্নয়ন ও সুনীল অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে।

আমাদের সামনে যেহেতু জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান, তাই দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিতে এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়াটা শুধু সময়োচিত নয়, বরং অবশ্য করণীয় কাজও বটে। তাই দুই দেশের পক্ষে দুর্যোগ ঝুঁকি কমানোর জন্য চেষ্টা করা ও ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগের ব্যবস্থাপনার ভিত্তির ওপর কাজ করা এবং দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে সহযোগিতা করার জন্য একই সঙ্গে কাজ করাই স্বাভাবিক।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদী রয়েছে। দুই দেশের জনগণের বড় একটি অংশ নির্ভর করে এই নদ-নদীগুলোর ওপর। তাই দুই দেশের জন্যই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা অগ্রাধিকারমূলক একটি বিষয়। যৌথ নদী কমিশনের পরামর্শের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী পানি বণ্টনের জন্য কাঠামো তৈরি এবং তথ্য বিনিময়ের ওপর দুই প্রধানমন্ত্রীই অগ্রাধিকার দিয়েছেন তাঁদের আলোচনায়।

১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ৩০ বছরের জন্য, যা ২০২৬ সালে নবায়ন হওয়ার কথা। এই উদ্দেশ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তি আলোচনার টেবিলে তোলার জন্য দুই দেশ একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। এ ছাড়া আরেকটি অববাহিকা উন্নয়নে দুই প্রধানমন্ত্রী ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্যও সম্মত হয়েছেন।

মহাশূন্যে নতুন যুগের মেলবন্ধনে যৌথ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশি স্যাটেলাইট উেক্ষপণে সাহায্য করবে ভারত। দুই দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য জ্বালানি ও ডিজিটাল খাতে সহযোগিতায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যৌথ পরিকল্পনার দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে জ্বালানি খাতে সহযোগিতার কথা, যাতে সংযুক্ত আন্ত আঞ্চলিক বিদ্যুত্ বাণিজ্য, অর্থাত্ ভারত, নেপাল ও ভুটানের পরিচ্ছন্ন জ্বালানি প্রকল্প থেকে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

ভারতের অর্থায়নে বিহার ও আসামের ভেতর ৭৬৫ কেভি উচ্চ ক্ষতাসম্পন্ন আন্ত সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এই নতুন সরবরাহ লাইন শুধু ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে অতিরিক্ত জ্বালানি সরবরাহের জন্য স্বল্পতম রুটের সুবিধাই নিশ্চিত করবে না, বরং অপ্রশস্ত শিলিগুড়ি করিডরের ওপর ট্রানজিটের চাপও কমাবে। বাণিজ্যকে আরো এগিয়ে নিতে দুই দেশ বিশদ অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তির ওপর সংলাপ শুরু করবে। বাংলাদেশ থেকে দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (মোংলা ও মিরসরাই) প্রদানের প্রস্তাব, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নতুন হাট উদ্বোধন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে জোরদার করতে বাণিজ্যিক সুবিধা বৃদ্ধি, স্থলপথ, রেলপথ, আকাশপথ ও জলপথের সংযোগ এবং বাণিজ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন হলো অন্যান্য ধাপের কয়েকটি, যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ‘আমাদের ভৌগোলিক নৈকট্যকে আমাদের জনগণের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগে রূপান্তরের’ মহান লক্ষ্যে।

কানেক্টিভিটি বা সংযোগ হলো ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার মূল ভিত্তি, যা বাণিজ্য এবং উভয় দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের ওপর বহুগুণ প্রভাব ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি উল্লেখ করেছেন, দুটি দেশ ১৯৬৫ সালের আগের সব সংযোগ পুনরুদ্ধার করেছে এবং মানুষ, পণ্য ও পরিষেবার বিরামহীন আন্ত সীমান্ত চলাচলের জন্য আরো কিছু প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হবে। এই সংযোগ বৃদ্ধিতে উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগও অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যা বাংলাদেশকে রেলপথে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনে সহায়তা করবে। ‘জয়েন্ট ভিশন ডকুমেন্ট’ অনুসারে রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে একটি নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন পরিষেবা এবং গেদে-দর্শনা থেকে চিলাহাটি-হলদিবাড়ী হয়ে হাসিমারা হয়ে ভারত-ভুটান সীমান্তে ডালগাঁও পর্যন্ত একটি পণ্য-ট্রেন পরিষেবা চালু করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়া গেছে।

উভয় দেশের সরকারের জন্যই জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক উন্নয়ন অত্যন্ত অগ্রাধিকারমূলক একটি বিষয়। দুই দেশের তরুণদের মধ্যে এই যোগাযোগের ওপর বিশেষ গুরুত্বে দেওয়া হয়েছে। জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক উন্নয়নের অতি প্রয়োজনীয় ঘোষণাটি আসলে ভারতে চিকিত্সাসেবা গ্রহণ করতে আসা বাংলাদেশিদের জন্য ই-মেডিক্যাল ভিসা সুবিধারই একটি সমপ্রসারণ। রংপুরে একটি নতুন ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন চালু হবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের জেলাসমূহের মানুষের জন্য কনস্যুলার ও ভিসা সেবাকে আরো গতিশীল করতে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সফল হওয়ায় এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকার পরও উভয় পক্ষকেই সম্ভাব্য ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সেই ঝুঁকিগুলোর ভেতর রয়েছে ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদ, মৌলবাদ এবং পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসংলগ্ন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা ও এই অঞ্চলে বিরাজমান ভারতকে হুমকির মুখে ফেলা সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি। এর চেয়েও বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব।

আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র, কিন্তু আসলে বড় এই ঝুঁকি ভারত ও বাংলাদেশ, উভয় দেশের জন্যই প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের কাছের ও মূল্যবান প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের প্রদান করা সুবিধা ও চ্যালেঞ্জগুলো এবং বাংলাদেশের সক্ষমতার ক্রমোন্নয়নের কারণে দেশটি হয়ে উঠেছে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার। তাই এটাই স্বাভাবিক যে, ভারত এই সম্পর্ককে গভীরভাবে পরিচর্যা করতে চাইবে।

বাংলাদেশের জন্যও ভারত এমন এক অংশীদার যে গভীর প্রয়োজনের সময় তার পাশে থেকেছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে ঘোষিত নতুন উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে দুই দেশের পরীক্ষিত বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় উঠবে, সন্দেহ নেই।

লেখক : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার
(ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের ভাষান্তর)
উত্তরণবার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK