মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১০:৩৯
ব্রেকিং নিউজ

গৌরব আর অহংকারের পদ্মা সেতু

গৌরব আর অহংকারের পদ্মা সেতু

উত্তরণ বার্তা ডেস্ক : ২০১২ সালের ২৯ জুন দুর্নীতির অভিযোগে ১২০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। তাদের দেখাদেখি প্রকল্প থেকে সরে যায় এডিপি, জাইকা ও আইডিবির মতো উন্নয়ন সহযোগীরা। কিন্তু অর্থায়ন স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘নিজেদের টাকায়ই আমরা পদ্মা সেতু গড়ব।’ ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। তখন মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মন্ত্রীরা তাঁদের এক মাসের বেতন ওই অ্যাকাউন্টে দেয়ারও সিদ্ধান্ত নেন। পদ্মা সেতুর মতো কোনো বৃহদায়তন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এভাবে জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রয়াস নজিরবিহীন।

নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর মতো জটিল ও ব্যয়বহুল প্রকল্প সম্ভব কি না, তা নিয়েও বিভিন্ন মহল তখন সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। কেউ কেউ বলছিল, এটি নেহাতই সরকারের একটি রাজনৈতিক চমক। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। কিন্তু এটি কোনো রাজনৈতিক চমক ছিল না, তার প্রমাণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদেশি কোনো সাহায্য ছাড়াই ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা খরচ করে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপই ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, সামর্থ্যের ঘাটতি—এ সব কিছু জয় করে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। শেষ স্প্যানটি নদীর ওপর স্থাপনের মাধ্যমে স্বপ্নের সেতু মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। শুধু নিজস্ব অর্থায়নই নয়, মূলত দেশি উপকরণ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে স্বপ্নের এই সেতু।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অনেক দিনের স্বপ্ন পদ্মা সেতু। সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর পদ্মায় অনেক পানি গড়ালেও পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা আবারও সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই নিয়োগ করা হয় পদ্মা সেতুর ডিজাইন কনসালট্যান্ট। ২০১০ সালে প্রি-কোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরপর ঘটনাবহুল সময় পেরিয়ে যায়। পদ্মা সেতুর মূল দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক নানা টালবাহানার পর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি স্থগিত করে, পরে চুক্তি বাতিল করে দেয়। ২০১১ সালের জুলাই-আগস্টে উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক (লিড পার্টনার) প্রকল্পে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তোলে এবং সেপ্টেম্বর থেকে প্রকল্পের কাজ স্থগিত করে দেয়। বিশ্বব্যাংক কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে কানাডীয় রয়াল মাউন্টেড পুলিশের (আরসিএমপি) কাছে নালিশ করে। পরে তদন্ত করে আরসিএমপি কানাডীয় আদালতে মামলা করে। ২০১২ সালের ২৮ জুন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করলে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দিনবদলের স্বপ্ন দেখছে দক্ষিণের জেলাগুলোর মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ সহজ হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, কাঁচামাল সরবরাহ সহজলভ্য হবে এবং শিল্পায়নের প্রসার ঘটবে অর্থাৎ ছোট-বড় নানা শিল্প গড়ে উঠবে এবং কৃষির উন্নয়ন হবে। সেতুর উভয় পারে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও শিল্পনগরী গড়ে উঠবে। বিনিয়োগ বাড়বে এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর সচল হবে। পর্যটনশিল্পের প্রসার ঘটবে এবং দক্ষিণ বাংলার কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ষাটগম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরা পারের রিসোর্টসহ নতুন-পুরনো পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর প্রভাব হবে বহুমাত্রিক। সেতুটি চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এতে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়বে। দারিদ্র্যের হার কমবে ০.৮৪ শতাংশ। নতুন করে গড়ে উঠবে ভারী শিল্প-কারখানা। পায়রা বন্দর, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতসহ দুই তীরে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক জোনগুলোকে কেন্দ্র করে নতুন মাত্রা পাবে দেশের পর্যটন খাত।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেহেতু পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগের একটা বড় লিংক, তাই আঞ্চলিক বাণিজ্যে এই সেতুর বড় ভূমিকা থাকবে। ভারত, ভুটান, নেপালের ট্রানজিট বাণিজ্য বাড়ার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতুর কারণে।’ তিনি বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগ সুবিধা পেতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতি সংস্কার জোরদার করতে হবে। যদি এসব ব্যাপার দ্রুত সংস্কার করা যায়, তাহলে সুবিধাগুলো খুব দ্রুতই লাভ করা যাবে। একই সঙ্গে পদ্মা সেতুর সঙ্গে যেসব গ্রাম ও অঞ্চলের সংযোগ রয়েছে, সেসব এলাকার মানুষের কাছে পদ্মা সেতুর সুবিধা পৌঁছাতে লিংক রোডগুলোর সংস্কার বাড়াতে হবে।

‘পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব প্রাক্কলন’ শীর্ষক এক গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. বজলুল হক খন্দকার ও ড. সেলিম রায়হান দেখিয়েছেন, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পণ্য ও সেবার চাহিদা বাড়বে, যাতে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বাড়বে। তাঁরা দেখিয়েছেন, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণাঞ্চলে শস্য চাহিদা ২০ শতাংশ, মাছের চাহিদা ২০ শতাংশ, ইউটিলিটি সেবা ১০ শতাংশ এবং পরিবহন সেবার চাহিদা ৫০ শতাংশ বাড়বে। এর ফলে দেশের মোট শস্য চাহিদা ১০ শতাংশ, মাছের চাহিদা ১০ শতাংশ, ইউটিলিটি সেবার চাহিদা ৫ শতাংশ এবং পরিবহন চাহিদা ২০ শতাংশ বাড়বে।
উত্তরণ বার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK
আরও সংবাদ