সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৯:২১

লাইকোপিন খ্যাত সুস্বাদু টমেটোর ৯ উপকারিতা

লাইকোপিন খ্যাত সুস্বাদু টমেটোর ৯ উপকারিতা

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
টমেটো বা টমাটো, যে নামেই ডাকুন না কেন, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় একটি ফল হলেও এটা সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং মজাদার একটি সবজি। লাইকোপিন (Lycopene) নামক উপাদানের জন্য সুখ্যাত এই ফল, বা সব্জিটির আছে অসংখ্য স্বাস্থ্যোপকারিতা।
 
টমেটোর বৈজ্ঞানিক নাম সোলানাম লাইকোপারসিকাম (Solanum lycopersicum)। এটা আমাদের দেশের একটি প্রধান শীতকালীন সবজি, তাই দুঃখের ব্যপার হল সুস্বাদু এবং রসালো টমেটো  পেতে হলে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয় শীত পর্যন্ত!  
 
টমেটো অনেক কারণেই স্বাস্থ্যোপকারি, তবে এটা লাইকোপিন (Lycopene) নামক এন্টিঅক্সিডেন্টের জন্য জন্য সুখ্যাত। টমেটো হচ্ছে খাদ্য থেকে লাইকোপিন পাওয়ার একটি উৎকৃষ্ট উৎস। লাইকোপিন হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। লাইকোপিন হচ্ছে একটি নিউট্রিয়েন্ট যা এন্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। এর রঞ্জক টমেটো, তরমুজ ইত্যাদি ফলকে এর লাল রং দেয়।  
 
টমেটো যখন রান্না করা হয় তখন এর লাইকোপিন অনেক মাত্রায় বেড়ে যায়। তাই, কাঁচা খাওয়ার চেয়ে রান্না করে, ভেজে, গ্রিল করে, সস বা সুপ বানিয়ে টমেটো খেলে আরো বেশী উপকার পাওয়া যায়। লাইকোপিন ছাড়া টমেটোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভাইটামিন সি, পটাশিয়াম, ফোলেট ও ভাইটামিন কে। একটি মাঝারি আকারের টমেটো আপনাকে দিবে আপনার প্রতিদিনের চাহিদার ২৮% ভাইটামিন সি। 
 
টমেটো লাল রঙ ছাড়াও হলুদ, কমলা, সবুজ এবং বেগুনি রঙের হ’তে পারে। টমেটোর বেশীর ভাগই পানি (৯৫%), বাকি ৫% শর্করা (carbohydrates) ও আঁশ (fiber)। একটি মাঝারি আকারের (১২৩ গ্র্যাম) টমেটোতে আছে মাত্র ২২ ক্যালরি। নীচের চার্টে ১১০ গ্র্যাম টমেটোর পরিপোষক (nutrients) দেয়া হলঃ
 
 

ক্যালোরি    

১৮

পানি      

৯৫%

আমিষ (Protein)                                

০.৯ গ্র্যাম

শর্করা (Carbohydrate)                                    

৩.৯ গ্র্যাম

চিনি    

২.৬ গ্র্যাম

আঁশ (Fiber)                            

১.২ গ্র্যাম

চর্বি  (Fat)                                        

০.২ গ্র্যাম

সম্পৃক্ত চর্বি (Saturated fat)                   

০.০৩ গ্র্যাম

মনোআনস্যাচুরেটেড চর্বি  (Monounsaturated fat) 

০.০৩ গ্র্যাম

পলি আন স্যাচুরেটেড চর্বি (Polyunsaturated fat) 

০.০৮ গ্র্যাম

 
লাইকোপিন
টমেটোতে থাকা সব উপাদানের মধ্যে লাইকোপিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লাইকোপিন হচ্ছে এক ধরনের ক্যারটিনয়েড (carotenoid) যা প্রচুর পরিমাণে থাকে টমেটোতে, এবং সবচেয়ে বেশী পরিমাণে থাকে টমেটোর আবরণে। 
 
টমেটো যত বেশী লাল হবে তাতে লাইকোপিন থাকবে তত বেশী। টমেটোজাত খাদ্য যেমন কেচাপ, টমেটো জুস এবং টমেটো সসে প্রচুর লাইকোপিন আছে এবং এটা আপনার খাদ্য থেকে পাওয়া লাইকোপিনের ৮০% দিতে পারে।
 
রান্না করা টমেটোতে কাঁচা টমেটোর তুলনায় বেশী লাইকোপিন থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ১০০ গ্র্যাম কেচাপে আছে ১০-১৪ গ্র্যাম লাইকোপিন আর ১০০ গ্র্যাম কাঁচা টমেটোতে আছে ১-৮ গ্র্যাম লাইকোপিন।
 
তারপরও প্রসেস করা টমেটো যেমন কেচাপ ইত্যাদির চেয়ে কাঁচা টমেটো খাওয়াটাই বেশী ভাল বলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে প্রসেস করা টমেটোর তুলনায় রান্না করা টমেটো আরো ভাল।  
 
টমেটোর লাইকোপিনের উপকারিতা 
  • লাইকোপিনের এন্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকারিতা অন্যান্য শত শত ক্যারটিনয়েডের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী
  • ১১৬,০০০ অংশগ্রহনকারীর উপর চালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে লাইকোপিন স্ট্রোকের ঝুঁকি ২০% কমাতে পারে
  • লাইকোপিন হাড় শক্ত ও ভাল রাখতে সাহায্য করে
  • গবেষণায় দেখা গেছে লাইকোপিন ফুসফুসের ক্যান্সার ও প্রস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসায় উপকারি
১। হৃদরোগ ও স্ট্রোক থেকে রক্ষা 
প্রতিনিয়ত টমেটো বা টমেটো জুস খেলে রক্তে এল ডি এল কোলেস্টেরল বা “খারাপ কোলেস্টেরল” ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমে এবং হৃদপিন্ড ভাল রাখে,ব্রিটিশ জার্নাল অফ নিউট্রিশনে প্রকাশিত গবেষণা মতে। মধ্য-বয়সী পুরুষদের উপর চালিত গবেষণায় দেখা গেছে রক্তে লাইকোপিন ও বেটা-ক্যারোটিনের মাত্রা কম থাকলে হার্ট এটাকের ঝুঁকি বেশী থাকে ও রক্তে লাইকোপিন বেশী থাকলে তা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
 
২। ধূমপানের ক্ষতি থেকে বাঁচানো 
টমেটোতে থাকা কুমারিক এসিড (coumaric acid) এবং ক্লোরোজিনিক এসিড (chlorogenic acid) সিগারেটের ক্ষতিকারক উপাদান নাইট্রোসামিন (nitrosamines) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং ধূমপানকারীদের ফুসফুসের ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। ক্যানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর ডক্টর সানজিভ আগারওয়াল এক গবেষণায় দেখান যে লাইকোপিন ক্যান্সার রোধে সাহায্য করে।  
 
৩। ক্যান্সার রোধ টমেটোর উপকারিতা 
গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত টমেটো খেলে প্রস্টেট, ফুসফুস ও পাকস্থলির ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।  বিজ্ঞানীদের মতে টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে লাইকোপিনের উপস্থিতিই এর কারণ। নারীদের উপর চালিত গবেষণায় দেখা যায় টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে ক্যারটিনয়েড থাকার ফলে তা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে।  
৪। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন টমেটো খেলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কারণে হওয়া অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (oxidative stress) কমায়।
 
৫। সুন্দর ত্বক 
ত্বকের জন্য টমেটোর উপকারিতা অনেক। গবেষণায় দেখা গেছে লাইকোপিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে তা রোদে পোড়া (sunburn) থেকে রক্ষা করে। 
 
৬। দৃষ্টিশক্তির উন্নয়ন 
টমেটোতে থাকা ভিটামিন এ দৃষ্টি শক্তির উন্নিতি করে এবং রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা করে।
 
৭। খাদ্য হজম করতে সাহায্য 
টমেটো পাচনতন্ত্র (digestive system) সুস্থ্য রাখে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে। এজন্যেই আমরা সালাদে সবসময় টমেটো খাই। এছাড়া টমেটোতে থাকা আঁশের (fiber) কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।
 
৮। উচ্চ রক্তচাপ কমায়
গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন টমেট খেলে উচ্চ রক্তচাপ কমে। এটার কারণ টমেটোতে থাকা প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম।  
 
৯। স্মৃতিশক্তি রক্ষা 
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিনিয়ত লাইকোপিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে স্মৃতিশক্তি ভাল থাকে ও আলযহাইমার্স রোগ (Alzheimer’s disease) ও পার্কিনসন্স রোগের (Parkinson’s disease) ঝুঁকি কমে।
 
টমেটো সম্বন্ধে আরো কিছু তথ্য 
টমেটো  আমাদের দেশীয় সবজি নয়। এর জন্মস্থান দক্ষিণ আমেরিকায়। প্রায় দেড় শ বছর আগে বিদেশ থেকে টমেটোর বীজ এনে এদেশে রোপন করা হয়। এর বীজ বেগুনের বীজের মত ব’লে একে বলা হত ‘বিলেতি বেগুন।‘ আজও অনেকে একে বিলেতি বেগুন নামেই চেনেন। পৃথিবীতে সর্বোচ্চ টমেটো উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছেঃ চীন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তুর্কি। এই পাঁচটি দেশ পৃথিবীর ৭০% টমেটো উৎপাদন করে। 
 
মেক্সিকো হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ টমেটো রপ্তানিকারি দেশ। এই দেশটি প্রতি বছর ১৫ লক্ষ টন টমেটো রপ্তানি করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম সর্বাধিক টমেটো উৎপাদনকারী দেশ হলেও তাদের ৫২% টমেটো আসে মেক্সিকো থেকে। 
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক  
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK