রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৮:৪৫
ব্রেকিং নিউজ

কোমল পানীয় পানে বিশ্বজুড়ে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুরা ভুগছে নানা রোগে, এখনই সাবধান হোন

কোমল পানীয় পানে বিশ্বজুড়ে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুরা ভুগছে নানা রোগে, এখনই সাবধান হোন

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
আমরা জানি কোমল পানীয়, যেমন কোক, পেপসি, স্প্রাইট, ফানটা, সেভেন আপ, ইত্যাদি বেশী পরিমাণে পান করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এটা ঠিক কতখানি  ক্ষতিকর তা অনেকেরই জানা নেই। শিশুরা এসব মিষ্টি পানীয় খুব পছন্দ করে এবং এর কারণে বিশ্ব জুড়ে দেখা দিচ্ছে শিশুকালের অতিস্থূলতা (Childhood obesity) এবং লিভারের রোগ। বড়দের মধ্যে এই মিষ্টি পানীয়ের কারণে দেখা দিচ্ছে হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার ডিযিয ও ক্যান্সার। 
 
আপনি শুনলে আশ্চর্য হবে যে এক ক্যান কোকে আছে সাড়ে ৯ চা চামচ চিনি। এই পরিমাণ চিনি আপনি শরবত বানাতেও ব্যবহার করেন না, কিন্তু এক ক্যান কোকে আপনি এটাই খাচ্ছেন। আর এই চিনি আমরা সবসময় যে চিনি ব্যবহার করি তা নয়, এটা হচ্ছে হাই ফ্রুকটোয কর্ন সিরাপ (High-fructose corn syrup)। এই হাই ফ্রুকটোয কর্ন সিরাপ খুব সস্তা এবং তাই সারা বিশ্বে মিষ্টি পানীয় প্রস্তুতকারক, বেকারি ও কনফেকশনারি, এবং মিষ্টির দোকানে এটা ব্যবহার করা হয়। এই আর্টিকেলে আমরা ১৩টি কারণ দেখাব কেন মিষ্টি পানীয় আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। 
 
১। কোমল পানীয় আপনার পেট ভরা রাখে না এবং ওজন খুব দ্রুত বাড়ায় 
আমরা যখন শর্করা (carbohydrate) খাই তখন তা গ্লুকোজে (glucose) রূপান্তরিত হয় এবং এই গ্লুকোজ আমাদের ক্ষুধার হর্মোন ঘ্রেলিন (ghrelin) এর মাত্রা কমায় যার ফলে আমরা পেট ভরা অনুভব করি। কিন্তু, ফ্রুকটোজ আমাদের শরীরে ক্ষুধার এই হর্মোনের মাত্রা কমায় না। তাই, আপনি যখন মিষ্টি পানীয় পান করেন তখন আপনি এই ক্যালরি আপনার খাদ্যের ক্যালরির সাথে যোগ করছেন।  একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খাদ্যের সাথে মিষ্টি পানীয় পান করেন তাঁরা তাঁদের শরীরে ১৭% অতিরিক্ত ক্যালরি যোগ করেন। 
 
২। অতিমাত্রার চিনি চর্বিতে রূপান্তরিত হয়ে আপনার লিভারে জমায় হয়
আমরা সবসময় যে চিনি ব্যবহার করি সেটা হচ্ছে সুক্রোজ (sucrose)। সুক্রোজ এবং হাই ফ্রুকটোয কর্ন সিরাপ দ’টিই নির্মিত হয় ২ টি উপাদান দ্বারা – গ্লুকোজ এবং ফ্রুকটোজ। গ্লুকোজ বিপাকিত (metabolized) হয় আপনার শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা, কিন্তু ফ্রুকটোজ বিপাকিত হয় শুধু আপনার যকৃতের (liver) মাধ্যমে। আপনি যখন খুব বেশী মাত্রায় মিষ্টি পানীয় পান করেন তখন আপনার লিভার অতিরিক্ত চাপের ফলে এই ফ্রুকটোজকে চর্বিতে রূপান্তরিত করে। এই চর্বির মধ্যে কিছু পরিমাণ ট্রাইগ্লিসারাইডে (triglycerides)রূপান্তরিত হয়ে রক্তে মিশে যায় আর কিছু থেকে যায় আপনার লিভারে। সময়ের সাথে এটাই ফ্যাটি লিভার ডিযিযের আকার নেয়।
 
৩। চিনি খুব দ্রুত পেটের মেদ বৃদ্ধি করে
অতিরিক্ত চিনি আপনার দেহে মেদ বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে ফ্রুকটোয পেট এবং পেটের কাছে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গে চর্বি বৃদ্ধি করে। এটাকে বলে হয় ভিসেরাল ফ্যাট (visceral fat) বা  পেটের চর্বি (belly fat)। অতিরিক্ত পেটের চর্বি টাইপ ২ ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
 
৪। কোমল পানীয় টাইপ ২ ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ
সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যেহেতু অতিমাত্রায় ফ্রুকটোজ ইন্সুলিন রেযিস্ট্যান্স ঘটায়, স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে বেশী পরিমাণে কোমল পানীয় পান করলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হয়। এমনকি প্রতিদিন শুধু এক ক্যান মিষ্টি পানীয় পান করলেও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। 
 
৫। কোমল পানীয়ে কোন প্রয়োজনীয় পুষ্টি নেই, আছে শুধু চিনি
কোমল পানীয়ে স্বাস্থ্য উপকারী কোন প্রকার ভাইটামিন, মিনারেল বা ফাইবার নেই। এটা আপনার খাদ্যে শুধু চিনি এবং অপ্রয়োজনীয় ক্যালরি যোগ করে।
 
৬। চিনি খেলে লেপ্টিন রেযিস্ট্যান্স (Leptin Resistance) হতে পারে 
লেপ্টিন (Leptin) হচ্ছে এক ধরনের হর্মোন যা আমাদের চর্বির কোষে তৈরী হয়। এই লেপ্টিন নিয়ন্ত্রণ করে আমরা কতখানি ক্যালরি গ্রহণ করি ও বার্ন করি। না খেয়ে থাকলে এবং অতিস্থূলতার কারণে লেপ্টিনের মাত্রা বাড়ে-কমে। তাই এটাকে পেট ভরা এবং ক্ষুধার হর্মোনও বলা হয়।
 
৭। কোমল পানীয় আসক্তি (Addiction) সৃষ্টি করে 
গবেষণায় দেখা যায় চিনি খেলে মগজে ডোপামিন (dopamine) নির্গত হয়, যা খুব সুখী ভাব দেয়। অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে যে চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আপনার মগজকে মাদক দ্রব্যের মত প্রভাবিত করতে পারে। যদিও মানুষের মধ্যে চিনির এই আসক্তি প্রমাণ করা কঠিন, কিছু মানুষ আছে যাঁরা মিষ্টি পানীয় মাদক দ্রব্যের মতই প্রচুর পরিমাণে পান করে।
 
৮। কোমল পানীয় হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে
বহু বছর ধরেই কোমল পানীয় পান্কে হৃদরোগের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটা এখন সবারই জানা যা মিষ্টি পানীয় হৃদরোগ, অতিমাত্রায় ব্লাড সুগার, অতিমাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়ায়। ৪০,০০০ মানুষের উপর ২০ বছর ধরে চালিত এক গবেষণায় দেখা যায় যে, যাঁরা প্রতিদিন এক ক্যান কোমল পানীয় পান করেছেন তাঁদের হার্ট এটাকে মৃত্যুর সম্ভাবনা অন্যান্যদের তুলনায় ২০% বেশী।
 
৯। কোমল পানীয় পানকারীদের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশী
৬০,০০০ প্রাপ্তবয়স্কের উপর চালিত এক গবেষণায় দেখা যায় যাঁরা প্রতি সপ্তাহে ২টি বা তার বেশী মিষ্টি পানীয় পান করেছেন, তাঁদের প্যাঙ্ক্রিয়াটিক ক্যান্সার (pancreatic cancer) হওয়ার ঝুঁকি যারা কখনও মিষ্টি পানীয় পান করেননি, তাঁদের তুলনায় ৮৭% বেশী। 
 
১০। কোমল পানীয়ের চিনি এবং সোডা দাঁতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর
এটা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে কোমল পানীয় দাঁতের শত্রু। কোমল পানীয়ে আছে ফসফরিক এসিড এবং কার্বোনিক এসিড। এই এসিড আপনার মুখে একটি এসিডিক ভাব দেয় যা আপনার মুখে ঝাঁঝের মত লাগে এবং আপনার দাঁতকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে। সোডার মধ্যে থাকা এসিড ক্ষতিকর, কিন্তু এটা যখন চিনির সাথে মিশ্রিত হয় তখন ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। 
 
১১। কোমল পানীয় পানকারীদের গাউট (Gout) হবার সম্ভাবণা অনেক বেশী
গাউট (Gout) হচ্ছে এক ধরনের রোগ যা আপনার হাঁড়ের জয়েন্ট ও পায়ের আঙ্গুলে ব্যাথা ও জ্বালাপোড়ার সৃষ্টী করে। গাউট হয় যখন রক্তে অতি মাত্রায় ইউরিক এসিড স্ফটিকে পরিণত হয়। ফ্রুকটোজ রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বাড়ানোর জন্য দায়ী। এছাড়া অনেক গবেষণায় কোমল পানীয় পান এবং গাউট হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে খুব শক্ত যোগসূত্র পাওয়া গেছে। 
 
১২। কোমল পানীয় স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে
স্মৃতিভ্রম (Dementia) সাধারণতঃ ৬৫ বছর বা তার বেশী বয়সের মানুষের মাঝে দেখা যায়।  আলযহাইমার্স ডিযিয (Alzheimer's disease) সবচেয়ে পরিচিত এক ধরনের ডিমেনশা (Dementia)। গবেষণায় দেখা গেছে ব্লাড সুগারের মাত্রা খুব বেড়ে গেলে ডিমেনশা’র ঝুঁকি বাড়ে। ইঁদুরের গবেষণায় দেখা গেছে বেশী পরিমাণে চিনি খেলে তা স্মৃতশক্তি ও সিদ্ধান্ত নেয়ার শক্তি নষ্ট করে।
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক 
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK