সাদিকুর রহমান পরাগ : আগস্ট বেদনার মাস। আগস্ট শোকের মাস। এই মাসে আমরা হারিয়েছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘাতকরা শুধু জাতির পিতাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, হত্যা করেছে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, ভাই শেখ নাসেরসহ পরিবারের অন্যান্য স্বজনদের। দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে সেদিন ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। বেঁচে গেলেও এখনো পিতা-মাতা-ভাই ও স্বজনহারা দুই বোন ক্রমাগত পাড়ি দিয়ে চলেছেন দীর্ঘ এই শোকের সাগর। শোকের এই পথ কখনও ফুরোয় না।
বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ নামটি সমার্থক। এই মাটিতে তিনি জন্মেছিলেন বলেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এই মাটিতে তিনি জন্মেছিলেন বলেই বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাভাষীদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এই মাটিতে তিনি জন্মেছিলেন বলেই লড়াই আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্যটা।
তাই একাত্তরের পরাজিত শক্তি জানতো বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে বাংলাদেশকে কখনোই পাকিস্তানে বা পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানো যাবে না। তাই স্বাধীনতার শুরু থেকেই তারা থেমে ছিল না। নানাবিধ চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে তারা। যে কোনো মূল্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এই অপশক্তি। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা বেছে নেয় আগস্ট মাসকে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এই মাস? কারণ এই মাসে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই পাকি-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির মাসটিকেই তারা বেছে নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য। আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। সেই দিন দিবাগত রাতে, অর্থাৎ ১৫ আগস্ট রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ঘাতকচক্র। এই হত্যাযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাসহ হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের। মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন ও চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। হরণ করা হয় মানুষের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার। বিপর্যস্ত জনজীবন, দিশেহারা মানুষ। সীমাহীন দুঃশাসন ও দমন-পীড়নে বাংলাদেশ প্রবেশ করে এক অন্ধকার যুগে।
বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে নেতৃত্বশূন্য আশাহীন অসহায় মানুষ কোথায় যাবে, কী করবে, কার কাছে যাবেÑ কিছুই ভেবে পায় না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে অপশক্তি প্রাথমিকভাবে সফল হলেও তারা জানে না যে জাতির পিতার রক্ত যেই ধমনিতে বহমান সেই রক্ত কখনো মানুষের অসহায়ত্তে নিশ্চুপ বসে থাকতে পারে না। এমনি এক প্রেক্ষাপটে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, প্রাণের মায়াকে তুচ্ছ করে, স্বজন হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলার জনগণকে তার ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ফিরে আসেন স্বদেশের মাটিতে। আবারও প্রমাণিত হলো রক্ত কথা বলে। তাকে বরণ করে নিতে আসা মানিক মিয়া এভিনিউর বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশ্যে সেদিন তিনি বলেছিলেন, “আমি সব হারিয়ে আজ আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি শুধু আমার পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবার জন্য। প্রয়োজনে আমার পিতার মতো জীবন দিব, তবু, আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আপস করবো না।”
তার এই সাহসী উচ্চারণে বাংলার মানুষ আবার আশা ফিরে পেল। গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে গড়ে ওঠে দুর্বার গণ-আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মানুষ আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রামে। তার এই চলার পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বারবার তার ওপর আঘাত এসেছে, ষড়যন্ত্র হয়েছে, জেল-জুলুম সইতে হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিজ্ঞা থেকে তাকে একবিন্দু পরিমাণও বিচ্যুত করা যায়নি। শুধুমাত্র রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি তার অপরিহার্যতা প্রমাণ করেননি, ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করেও তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে তার নেতৃত্বে কীভাবে আবার বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
যেই অপশক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, সেই বিএনপি-জামাত শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা উপলব্ধি করে যে শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে, তাদের ‘পাকিস্তানি বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের নীলনকশা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
তাই তারেক জিয়ার পরিকল্পনা অনুসারে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তিনটি কাজ করা হয়
প্রথমত; রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হরকাতুল জিহাদ-জেএমবি-বাংলাভাই সব বিভিন্ন ধর্মীয় উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটানো হয়।
দ্বিতীয়ত; এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি জঙ্গি-অনুকূল রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়।
তৃতীয়ত; এই জঙ্গিগোষ্ঠীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়, যাতে করে বিএনপি-জামাতের সম্পৃক্ততা আড়াল করা যায়।
চতুর্থত; সব আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর হামলার জন্য আবার সেই আগস্ট মাসকেই বেছে নেওয়া হয়। কেননা আগস্ট হচ্ছে পাকি-ভাবধারায় বিশ্বাসীদের প্রেরণার মাস।
হাওয়া ভবনের নীলনকশায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর জনসভায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। প্রাণপ্রিয় নেত্রীর প্রাণ বাঁচাতে নেতাকর্মীরা সেদিন তাকে ঘিরে মানব-ঢাল তৈরি করে। মানুষের ভালোবাসায় এবং সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় জননেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন। আহত হয়েছিল প্রায় ৩ শতাধিক নেতাকর্মী। গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়ার পর জননেত্রীকে দ্রুতই গাড়িতে করে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় সেই গাড়ির দিকে লক্ষ্য করেও ঘাতকরা গুলি ছুড়েছিল।
এই হামলায় যে তারেক জিয়া এবং বিএনপি-জামাতের সংশ্লিষ্টতা ছিল, সেটি কতগুলো বিষয় থেকেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে :
দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এই মামলা চলে। মামলার প্রধান আসামি মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে বেরিয়ে এসেছে যে এই হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে তারেক জিয়া, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, আলী আহসান মুজাহিদ, আবদুস সালাম পিন্টু, কাজী মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, এনএসআই-র সাবেক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিমসহ আরও অনেকে সম্পৃক্ত ছিল। এই হামলার জন্য তারা তাকে সকল প্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এই মামলার রায় দেওয়া হয়। রায়ে ৩৬ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১৮ জনকে মৃত্যুদ- এবং ১৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে চললেও প্রকৃত দোষীদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে এবং তাদের সাজা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথকে সুদৃঢ় করা হয়েছে।
আজকের বাংলাদেশের সাফল্যের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “ম্যাডাম প্রধানমন্ত্রী আপনার নেতৃত্বকে অভিনন্দন জানাই।… আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি গতিশীল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে (এমডিজি) গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছে।… অনেক দেশকেই আমি এই উদাহরণ দেই, বলি বাংলাদেশের দিকে তাকান।” তিনি আরও বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশ ও জনগণের জন্য যে সোনার বাংলার কথা ভেবেছিলেন, যে অর্থনীতির কথা ভেবেছিলেন তা বাস্তব। জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের অর্জন ও তাদের প্রচেষ্টার জন্য অভিনন্দন।”
২১ আগস্ট যদি ঘাতকরা সফল হতো, তাহলে কি আমরা আজকের এই বাংলাদেশ পেতাম? মানুষ কি ফিরে পেত তার গণতান্ত্রিক অধিকার? তিনি না থাকলে যে বাংলাদেশের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তি আবারও নেতৃত্বশূন্য হতো, বাংলাদেশ যে একটি অকার্যকর ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো, উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর অভয়রাণ্যে পরিণত হতোÑ সেটি কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনও?
তাই এ-কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আক্রমণ। আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের জাতীয় দিবস, ১৫ আগস্টের কালরাত্রি এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ষড়যন্ত্রের একই সুতোয় গাঁথা।
লেখক : সাংস্কৃতিক সংগঠক ও লেখক