বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৩:২৫

একাত্তরের রক্তাক্ত বাংলাদেশ : বঙ্গবন্ধু বনাম ইয়াহিয়া

একাত্তরের রক্তাক্ত বাংলাদেশ : বঙ্গবন্ধু বনাম ইয়াহিয়া

উত্তরণবার্তা ডেস্ক : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেরকালে অনেকগুলো পক্ষ ছিল। পক্ষগুলো ছিল পরস্পর বিরোধী। পক্ষ থাকাই স্বাভাবিক। পক্ষ বিপক্ষেই শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করে পৃথিবীর যে কোনো যুদ্ধের পরিণতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক অনেক পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে অন্যতম প্রধান পক্ষ বিপক্ষ ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিপক্ষে ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান।

১৯৭১ সালের ইতিহাসের অনেক ঘটনাবলি এখনো বিশ্লেষণের বাইরে রয়ে গেছে। যত দিন বা সময় যাচ্ছে চিন্তার অন্ধকার পার হয়ে আলোর দিকে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অবস্থান সুস্পষ্টভাবেই ছিল, কিন্তু গোটা পরিপ্রেক্ষিতের কেন্দ্রবিন্দু ছিল দুটি বা দুই দুইজন। বাংলাদেশের প্রান্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর পাকিস্তানের প্রান্তে জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সত্তরের নির্বাচনের পরে যখন মার্চের দুই তারিখ অধিবেশন বন্ধ করে দেয় জেনারেল ইয়াহিয়া, পাকিস্তানের জেনারেল ও ভুট্টোদের পরামর্শে - তখনই গোটা পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার একমাত্র প্রতিদ্ধন্দ্বী হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ, তিনি নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জনগণমননায়ক শেখ মুজিব রাষ্ট্রের কোনো পদে অলংকৃত নন; কিন্তু তাঁর নির্দেশে একটি চেতনাগত রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে, শাসকদের সকল ক্ষমতার উৎসের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময়ের একটি প্রামাণ্য: পাকিস্তানের দ্বিতীয় সামরিক শাসন আইন জারির প্রথম বার্ষিকীর দিন ছিল সেটি। শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের একটি মফস্বল শহরে যাচ্ছিলেন নির্বাচনী সমাবেশে বক্তৃতা দিতে। তাঁর গাড়ি ঘটঘট আওয়াজ তুলতে তুলতে এগিয়ে যাচ্ছিল। পেছনের সিটে বসেছিলেন এক অবাঙালি সাংবাদিক। তিনি নিজের খবরের কাগজের জন্য শেখ মুজিবের নির্বাচনী সফরের সঙ্গী হয়েছিলেন। চলতি কিছু ঘটনার কথা উত্থাপন করে তিনি শেখ মুজিবকে উসকে দিয়ে সংগোপনে নিজের ক্যাসেট রেকর্ডারের বোতাম টিপে দিলেন। পরবর্তীকালে এককভাবে সংগৃহীত নিজের মহামূল্যবান সম্পদ তিনি বন্ধুদের শোনান। তিনি আমাকেও শুনিয়েছিলেন। মুজিবের বাগ্মীসুলভ কণ্ঠস্বর স্পষ্ট বোধগম্য ছিল। তিনি বলছিলেন- ‘যেভাবেই হোক আইউব খান আমাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলেছে। এখন আমি যা চাইব, তাতে কেউ ‘না’ করতে পারবে না। এমনকি ইয়াহিয়া খানও আমার দাবি উপেক্ষা করতে পারবে না।’

কী ছিল তার দাবিগুলো?

ইয়াহিয়া খানের গোয়েন্দা বাহিনীর সংগৃহীত আরেকটি টেপ থেকে সূত্রটি পাওয়া গেলো। বিষয়টি লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডার, এলএফও-সম্পর্কিত। ১৯৭০ সালের ৩৯ মার্চ সরকার এ আদেশটি জারি করেন। যা ছিল শাসনতন্ত্রের খসড়া। এই আদেশ বিখ্যাত ছয় দফা বাস্তবায়নের ব্যাপারে মুজিবের হাত বেধে ফেললো। এলএফও-র ওপর তিনি মতামত অতি নির্ভরতার সঙ্গে বলেছিলেন সিনিয়র সহকর্মীদের সঙ্গে। কিন্তু আঁচ করতে পারেননি, তাঁর উচ্চারিত বাক্যের শ্রাবক হবেন ইয়াহিয়া খান, তাঁর জন্যে টেপ হয়ে যাচ্ছে। রেকর্ড করা টেপে মুজিব বলেন- ‘আমার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবো। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর আমাকে চ্যালেঞ্জ করবে কে?’ যখন এই টেপ ইয়াহিয়া খানকে শোনানো হলো, তিনি বললেন- যদি সে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে আমি তাকে দেখে নেব।’[নিয়াজির আত্মসমর্পেনর দলিল, পৃষ্ঠা - ১৩। মেজর সিদ্দিক শালিক, অনুবাদ : মাসুদুল হক, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ]

 ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান জানতেন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান, পূর্ব বাংলার বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানই সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং প্রবল প্রতিপক্ষ। সুতরাং পাকিস্তানের নির্বাচন বা শাসনতন্ত্র যা কিছু করা হোক, তাতে মাথায় রাখতে হতো শেখ মুজিবকে। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ক্ষমতালোভী ভুট্টো। কিন্তু ভুট্টো পাকিস্তানের নাগরিক, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ। একই ভাষায় কথা বলে দুজনে, উর্দুতে। পক্ষান্তরে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের পূর্ব বাংলা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি ও ভাষা একেবারেই বিপরীত। পূর্ব বাংলায় যদিও অনেক দালাল তৈরি হয়েছে ধর্মের আবরণে। কিন্তু তাঁরা শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। কারণ, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যে গোপন ফাইল খুলেছে, সেই ফাইলে রিপোর্ট দিচ্ছে পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিব একমাত্র নেতা, যে নেতা পাকিস্তান তোষণ করেন না। যে নেতা পাকিস্তান ভেঙে বাঙালির জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবেশী হিন্দু রাষ্ট্র ভারতে গেছেন। ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করছেন। তিনি আগরতলা মামলায় প্রায় মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি লাভ করে জনগণমননায়ক হিসেবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অতুলনীয় একক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ও জনগণের মধ্যে নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন।

মজার ব্যাপার- জনগণের জন্য শেখ মুজিবের দুটি দাবি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর স্বাধীন বাংলার দুঃখী সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চান। শেখ মুজিব কখনো কোনো জনসভায় বলেননি, আমি আপনাদের দুধের নহরে ভাসিয়ে দেব্ আকণ্ঠ সুখে নিমজ্জিত করে রাখবো। তিনি সাধারণ মানুষের অন্তরের অন্তর্নিহিত আবেদন শুনতে পেয়েছিলেন বলেই কোনো বাগাড়ম্বর করেননি। মিথ্যা আশ্বাসের ফুলঝুরা ছোটাননি। ফলে, সাধারণজনগণ ধারণ করেছিলেন শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিবও সকল সত্তায় অনুভব করতেন জনতাকে। জনতার সঙ্গে যে নেতার এমন নিবিড় বোঝাপড়া, সেই নেতাকে জনতার হৃদমাঝার থেকে ছিন্ন করা কতটা কঠিন, বুঝতে পারেনি জেনারেল আগা মোহাম্মাদ ইয়াহিয়া খান এবং চারপাশের মাথা মোটা জেনারেলরা। আর পশ্চিম পাকিস্তানের সিভিলিয়ানরা ছিল অলীক এক কল্পনায়, ভেতো বাঙালিদের ওপর সেনাবাহিনী হত্যা ও খুনের স্টিমরোলার চালালে একেবারে ঠান্ডা হয়ে যাবে। কিন্তু বুঝতে পারেনি, ভেতো বাঙালিরা, যারা ছিল অস্ত্রহীন, তাদের চেতনার মর্মমূলে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ দ্য ইকোনমিস্ট’ লিখেছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক ২৫ মার্চ তারিখে গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বানের জবাবে শেখ মুজিব চারটি শর্ত আরোপ করেন, যা তাঁর ও আওয়ামী লীগের অধিবেশনে যোগদানের পূর্বেই পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে দুটি শর্ত, ‘অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার’ এবং ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর’- কার্যত প্রেসিডেন্ট পক্ষে মেনে নেয়া অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই পরিস্থিতির একটা নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হওয়ার জন্যে, যেটা হয়ত দুজনার মধ্যে শেষ বৈঠক হতে পারে- খুব শিগগিরই ঢাকা যাচ্ছেন।

১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা গমন করলে নিউইয়র্কের টাইম সাময়িকী  রিপোর্ট করে, আসন্ন বিভক্তির [পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণতকরণ] পিছনে যে মানুষটি রয়েছেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।

 বোঝা যাচ্ছে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রদেশ পূর্ব বাংলায় আসছেন কেবল বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফয়সালা করতে। একই সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের তকমা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাবাহিনীর প্রধান, আইন বিচার ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী। একটি রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার টুটি চেপে নিজের দুই হাতের মুঠোয় পরেছিলেন। সেই লোক ঢাকায় এসেছেন সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে, একমাত্র শেখ মুজিবের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। কারণ, জেনারেলের মনে আছে দুটি দিক। এক, বাঙালির নেতা বছর খানের আগে নিজের জাঁদরেল বস আইউব খানকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন। দ্বিতীয়, সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। সুতরাং ক্ষমতার সব উৎস হাতের মুঠোয় থাকার পর ভেতো বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবের কাছে আসতেই হবে।

১৯৭১ সালের ইয়াহিয়া খান ও সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেনসহ আরও নেতাদের সঙ্গে বার বার যে বৈঠক বা আলোচনা চলছিল, কেন্দ্রবিন্দু একজন- তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মুজিব। কিন্তু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ যখন ছয় দফার প্রশ্নে আপস করলেন না, বুঝতে পারলেন জেনারেল ইয়াহিয়া- এই ভেতো বাঙাল ভাঙবেন কিন্তু মচকাবেন না। তখন আস্তিনের আড়ালে গুটিয়ে রাখা ছুরি বের করল এবং রাতের অন্ধকারে পূর্ব বাংলায় দখলদার সেনাবাহিনীর জেনারেলদের অপারেশন সার্চলাইটের নির্দেশ দিয়ে পালিয়ে গেলেন নিজের দেশে, পশ্চিম পাকিস্তানে।

২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল, পূর্ব বাংলার আবালবিদ্ধবনিতা নিরীহ নিরপরাধ দরিদ্র ক্ষুধার্ত জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। জেনারেল পশ্চিম পাকিস্তানের পালিয়ে গিয়ে ২৬ মার্চ রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়। সেই ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কি বলেছেন শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে, সেই দিকে তাকাই, সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের অনেক কিছুই পাল্টে যাবে। ভাষণে ইয়াহিয়া বলেন, আপনারা জানেন, রাজনৈতিক সংকট দূর করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে  আমি অনেকগুলো বৈঠকে মিলিত হলাম। ... সংবাদপত্র ও অন্যান্য তথ্য মাধ্যমের মারফত আপনারা জানতে পেরেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি দেখা দিয়েছিল। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার একটা বিশেষ পর্যায়ে এসে আমি পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের ঢাকায় আর এক দফা আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করলাম।

আপনারা জানেন, আওয়ামী লীগ নেতা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পূর্বেই সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছিলেন। আমাদের বৈঠকে শেখ মুজিব প্রস্তাব দেন, যে অন্তবর্তীকালীন সময়ের শাসনব্যবস্থা চলবে আমার জারি করা ঘোষণার অধীনে।... এই পরিকল্পনায় আইনগত ও অন্যান্য দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বার্থে নীতিগতভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু একটি শর্তে। শর্তটি আমি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করলাম। শর্তটি ছিল, এই ব্যাপারে প্রথমে আমি রাজনৈতিক নেতাদের সকলের মধ্যে সর্বসম্মত মতৈক্য চাই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পাকিস্তান- পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গির সম্পাদিত,আগামী প্রকাশনী [পৃষ্ঠা – ৭৯-৮০-৮১]

পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী- প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও জেনারেল ইয়াহিয়া খান কতটা আটকে গিয়েছিলেন শেখ মুজিবের হাতে, রাজনীতির গুটিচালে, অনুধাবন করা যায়- ১৯১৭ সালের ২৬ মার্চ রাতের সেই ভাষণের বিরানব্বই লাইনের মধ্যে শেখ মুজিবের নাম নিয়েছিল ১৩ বার। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাষণে পাকিস্তানের সকল দুর্যোগ ও যুদ্ধের জন্য ইয়াহিয়া খান সেই ভাষণে দায়ী করেছিলেন, অনিবার্যভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। জেনারেল ভাষণের শেষের দিকে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলের সহযোগীদের বিরুদ্ধে আমি কয়েক সপ্তাহ আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতাম। কিন্তু আমি এমনভাবে অবস্থার মোকাবেল করতে চেষ্টা করলাম যাতে আমার ক্ষমতা হস্তান্তরে পরিকল্পনা ব্যাহত না হয়। এই উদ্দেশ্যে অর্জনের প্রতি আমার আগ্রহের জন্যই আমি একটা পর একটা বেআইনি কাজ সহ্য করে গেছি। আর একই সঙ্গে কোন রকম একটা যুক্তসঙ্গত সমাধানে পৌঁছানোর  জন্যে আমি সম্ভব সব চেষ্টা চালিয়ে গেছি। শেখ মুজিবুর রহমানকে যুক্তির পথে আনার জন্য আমি যে চেষ্টা করেছি, এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে চেষ্টা করেছেন- আমি আপনাদের আগেই বলেছি। কিন্তু তিনি আমার যে কোনো প্রস্তাবে গঠনমূলকভাবে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে তিনি ও তাঁর অনুগামীরা এমন কী আমি যখন ঢাকায় উপস্থিত, সেই সময়েও সরকারি কর্তৃপক্ষকে লঙ্ঘন করে গেছেন। তিনি, শেখ মুজিবুর রহমান যে ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেটা একটা ফাঁদ ছাড়া কিছুই না। তিনি জানতেন, যে কাগজে ওই ঘোষণাটি লেখা হতো, সেই কাগজটুকুর মূল্য পর্যন্ত থাকতো না। আর সামরিক আইন প্রত্যাহার করার ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হতো, তখন শেখ মুজিবুর রহমান অবাধে যা ইচ্ছে তাই করতে পারত। তাঁর একগুঁয়েমি, তাঁর অবাধ্যতা এবং যুক্ত-তর্কের পথ অবলম্বন করায় তার অস্বীকৃতি- এ সবের একমাত্র অর্থ হচ্ছে- এই লোকটি এবং তাঁর দল পাকিস্তানের শত্রু, আর তারা পূর্ব পাকিস্তানকে দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করতে চান। শেখ মুজিবুর রহমান দেশের ঐক্য ও সংহতিকে আক্রমণ করেছেন, এই অপরাধে তাঁকে শাস্তি পেতেই হবে।

[প্রাগুক্ত -৭৯-৮০-৮১]

পাকিস্তানের সকল সমস্যার কেন্দ্র- একজন মানুষ- একজন বাঙালি- তিনি  গোপালগঞ্জের বাইগার নদীর তীরের গ্রামের শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র- পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণের নির্বাচিত নেতা, বাঙালি জাতির জনক- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের ভাষণের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত। শাস্তি মানে ফাঁসি শেখ মুজিবকে দিতেই হবে, কারণ দুই পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চান। যে দেশের ঘোষণা দিয়েছিলেন শেখ মুজিব ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর, নেতা হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দ্দীর সমাধিস্থলে, আলোচনা সভায়।

পরের ঘটনাবলি বাংলাদেশের প্রকৃত বাঙালিরা জানেন। পাকিস্তানি জেনারেল- সৈন্য ও রাজনীতিবিদরাও জানে, কিন্তু পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পূর্ব বাংলার সকল নৃশংস ঘটনাবলি আড়ালে রেখেছে। দীর্ঘ নয় মাসে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে যুদ্ধ করার পর ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও পাঁচ লক্ষ নারীর পবিত্র ইজ্জতের বিনিময়ে হাজার বছর পর বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে, জনক তখনো বন্দি পাকিস্তানের কারাগারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রধান প্রতিপক্ষ সকল ক্ষমতার মাস্টার জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোথায়?

তখন পাকিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় লাখ লাখ জনতা নেমে আসে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সেনানিবাসের সামনে জড়ো হয়ে গেটে প্রস্রাব করে, বিকৃত স্লোগান দেয় জনতা। ইয়াহিয়া আটকা পড়েন নিজের কক্ষে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ভুট্টো ক্ষমতা হাতে নিয়েই একদা প্রভু জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে কারাগারে পাঠান ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর। বিপরীতে, চিরশত্রুকে মিয়ানওয়ালী কারাগার থেকে মুক্ত করে শেখ মুজিবকে পুলিশের রেস্টহাউজ সিহালায় নিয়ে আসেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনগামী বিমানে তুলে দেয় ভুট্টো। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডন, দিল্লি হয়ে ফিরে আসেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। ১৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে।

অন্যদিকে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জেনারেল ইয়াহিয়া খান? গৃহবন্দি হয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন আর শেখ মুজিবকে কেন ফাঁসি দেননি, সেই আফসোস করছিলেন।  
উত্তরণবার্তা/এআর

 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK