শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১২:৫৮

প্রতিদিন কফি পান আপনাকে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে

প্রতিদিন কফি পান আপনাকে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
নতুন নতুন সব গবেষণা আমাদেরকে নিয়মিত কফির স্বাস্থ্যকর গুণাগুণ সম্বন্ধে আশ্চর্য্য সব তথ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমনি একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন কফি পানের অভ্যাস আমাদেরকে দীর্ঘায়ু দিতে পারে। ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই এবং ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার কেক স্কুল অফ মেডিসিন এর বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখতে পান যে যারা প্রতিদিন শুধু ১ কাপ কফি পান করেন তাদের ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ও কিডনি রোগে মৃত্যু ঝুঁকি অন্যান্যদের (যারা কখনই কফি পান করেন না) তুলনায় ১২% কম। একই সাথে যাঁরা প্রতিদিন ২ থেকে ৩ কাপ কফি পান করেন তাদের এসব রোগ থেকে মৃত্যু ঝুঁকি ১৮% কম।
 
কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, বিজ্ঞানীরা বলছেন কফির উপাদান ক্যাফিন এর জন্য দায়ী নয় কারণ গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা ক্যাফিনসহ এবং ক্যাফিন ছাড়া – এই দু’ধরনের কফিই পান করেছিলেন। কফি পৃথিবীতে পানির পরেই সবচেয়ে বেশী পান করা পানীয়। প্রতিদিন সমগ্র বিশ্বে মানুষ ২২৫ কোটি কাপ কফি পান করেন। ৫০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে মানুষ কফি পান করে আসছে। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কফি পানের প্রমাণ পাওয়া যায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইয়েমেনে।
 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী মানুষ নিয়মিত কফি পান করে থাকেন এবং তারা গড়ে প্রতিদিন ৩ কাপ কফি পান করেন। পূর্বের গবেষণা গুলোতে দেখা যায় যে কফি লিভারের স্বাস্থ্য উন্নতি করে এবং ক্যান্সার রোধ করে। কিন্তু, ঐ গবেষণাগুলো মূলতঃ করা হয় শ্বেতাঙ্গ মানুষদের উপর, তাই এই নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা অন্যান্য জাতির উপর কফির প্রভাব পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন।
 
এই গবেষণাটি কফি পান এবং দীর্ঘায়ুর মধ্যে যোগাযোগের উপর করা সবচেয়ে বড় গবেষণা। এতে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের এক লক্ষ পঁচাশি হাজারেরও বেশী মানুষ। অংশগ্রহনকারীরা ছিলেন কৃষনাঙ্গ আমেরিকান, হাওয়াইয়ান, আমেরিকান আদিবাসি, দক্ষিন আমেরিকান, জাপানিজ আমেরিকান এবং শ্বেতাঙ্গ। গবেষণার শুরুতে তাঁদের বয়স ছিল ৪৫ – ৭৫ বছর। অংশগ্রহনকারীদের পর্যবেক্ষণ করা হয় ১৬ বছর পর্যন্ত। “এই গবেষণাটি এই ধরনের গবেষণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং এর অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে ছিলেন অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য যাদের জীবনধারা ছিল বিভিন্ন ধরনের।“ বলেন ভেরোনিকা ওয়েন্ডি সেতিয়াওান, কেক স্কুল অফ মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপিকা।
 
“একই ধরনের প্যাটার্ন বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মধ্যে দেখা যাওয়ায় এটি একটি মজবুত প্রমাণ দেয় যে আপনি শ্বেতাঙ্গ, কৃষনাঙ্গ, লাতিনো বা এশিয়, যেই হোন না কেন, কফি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ভাল,“ উনি বলেন।
 
গবেষণা 
গবেষণায় সকল অংশগ্রহনকারীকে প্রশ্নাবলীর উত্তর দিতে হয় যেখানে তাঁদের কফি পানের মাত্রা এবং কি ধরনের কফি (ক্যাফিনসহ বা ক্যাফিন ছাড়া) পান করেন সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়। তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের মেডিকেল ইতিহাস এবং জীবনধারা সম্বন্ধেও প্রশ্নাবলীতে জিজ্ঞেস করা হয়। অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে ১৬% জানান তাঁরা খুবই কম কিংবা কখনও কফি পান করেন না, ৩১% জানান তাঁরা প্রত্যহ ১ কাপ কফি পান করেন, ২৫% জানান তাঁরা প্রতিদিন ২ থেকে ৩ কাপ কফি পান করেন এবং ৭% জানান তাঁরা প্রতিদিন কমপক্ষে ৪ কাপ কফি পান করেন। বাকি ২১% অংশগ্রহনকারীর কফি পানের অভ্যাস ছিল
অনিয়মিত।
 
গবেষণা চলাকালীন ১৬ বছরে ৫৮,৩৯৭ অংশগ্রহনেকারী মারা যান। তাঁদের মৃত্যুর প্রধান কারন ছিল হার্টের রোগ (cardiovascular disease) এবং ক্যান্সার। গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করেন যে যাঁরা প্রতিদিন এক কাপ কফি পান করেন তাঁদের হার্টের রোগ, ক্যান্সার, ফুস্ফুসের রোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ এবং ডায়াবেটিস রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি অন্যান্যদের (যাঁরা খুবই কম কিংবা কখনই কফি পান করেন না) তুলনায় ১২% কম। তাঁরা আরও দেখতে পান যে, যাঁরা প্রতিদিন ৩ কাপ কফি পান করেন তাঁদের এসব রোগে মৃত্যু ঝুঁকি ১৮% কম।
 
অংশগ্রহনকারীরা কী ধরনের কফি পান করেন (ক্যানফিনসহ বা ক্যাফিন ছাড়া) এটা কোন বিষয় ছিল না। গবেষকরা যখন অংশগ্রহনকারীদের বয়স, লিঙ্গ, মদ্যপান এবং ধুমপানের অভ্যাস বিবেচনায় নেন তখনও ফলাফল একই ছিল। কফি পান এবং দীর্ঘায়ুর যোগসূত্র দেখা যায় চারটি ভিন্ন জাতির মধ্যেঃ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান, কৃষনাঙ্গ আমেরিকান, ল্যাটিন আমেরিকান এবং জাপানিজ আমেরিকান। তাই গবেষকরা মনে করেন ফলাফল অন্যান্য জাতির উপরও প্রযোজ্য হবে।
 
“এই ভিন্ন জাতির মানুষজনের জীবনযাত্রা ছিল বিভিন্ন ধরনের। তাঁদের খাদ্যাভ্যাস ছিল ভিন্ন এবং তাঁদের সংবেদনশীলতা ছিল ভিন্ন, কিন্তু তারপরও আমরা একই ধরনের প্যাটার্ন দেখতে পাই,” বলেন সেতিয়াওয়ান। সেতিওয়ান বলেন, কফিতে আছে হাজার হাজার biologically active কম্পাউন্ড, যেমন এন্টিঅক্সিডেন্ট, ফেনলিক কম্পাউন্ড, এবং সঠিকভাবে এটা বলা যাবে না কোনটা এই স্বাস্থ্যগুণের জন্য দায়ী।
 
“কেউ কেউ কফি পান করতে ভয় পান কারণ তাঁরা মনে করেন এটা তাঁদের হার্টের রোগ, পাক্সথলীর আলসার এবং হার্টবার্ন দিতে পারে। কিন্তু, বেশীরভাগ কফির গবেষণায় দেখা যায় যে কফি আসলে স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি করে না।“ সেতিওয়ান বলেন। তারপরও গবেষকরা বলেন যে কফি কিংবা যে কোনো গরম পানীয় পান করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। তাঁরা ২০১৬ সালে প্রকাশিত World Health Organization (WHO) এর একটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে বলা হয় যে গরম পানীয় পান করলে অন্ননালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
 
কফি পান কেন আমাদের আয়ু দীর্ঘায়িত করতে পারে সে ব্যপারে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। এদিকে বিজ্ঞানীরা বলেন কফি পানের অভ্যাস আমাদের চালিয়ে যাওয়া উচিৎ কারণ এটা আমাদের অনেক অনেক উপকার করতে পারে। জন্স হপকিন্স ব্লুম্বার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এর প্রফেসর ডঃ এলিসিও গালার বলেনঃ “যদিও কফি পান নিরাপদ, চিকিৎসকদের উচিৎ হবে না রোগ নিরাময় বা রোগ প্রতিরোধের জন্য কফি প্রেস্ক্রিপ্শন করা।” “কফি পানের সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে এতে প্রচুর পরিমাণে ক্রিম এবং চিনি মেশানো না হয় কারণ এসব উপাদানে প্রচুর ক্যালরি এবং ফ্যাট আছে। কফি পান খুবই নিরাপদ কিন্তু এটা করতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে,” গালার বলেন।
 
তাই আপনি যদি নিয়মিত কফি পান করে থাকেন, এই গবেষণার ফলাফলে আপনার উচিৎ হবে না খুব বেশী রোমাঞ্চিত হওয়া, বলেন সেতিওয়ান এবং তাঁর সহকর্মীরা। তাঁরা বলেনঃ “আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে কফি পান আপনাকে দীর্ঘায়ু দিবে, কিন্তু আমরা একটা সংযোগ দেখতে পাই। আপনি যদি কফিপ্রেমি হয়ে থাকেন, তাহলে কফি পান চালিয়ে যান! আর আপনি যদি কফিপ্রেমি না হয়ে থাকেন তাহলে আপনার ভেবে দেখা উচিৎ আপনি এ অভ্যাস শুরু করবেন কিনা।” গবেষণাটি প্রকাশিত হয় এনালস অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন (Annals of Internal Medicine) জার্নালে।
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক
 
 
 
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK