শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৭:০৯

মহাবিপদ এড়াতে এখনই সাজাতে হবে পরিকল্পনা

মহাবিপদ এড়াতে এখনই সাজাতে হবে পরিকল্পনা

উত্তরণবার্তা ডেস্ক :  প্রবল দহনে পুড়ছে দেশ। ঘরে-বাইরে কোথাও নেই একদণ্ড শান্তি। খরতাপে পোড়া শহরে আগের সেই কোলাহল নেই। মানুষের গিজগিজও দেখা মেলে না বহুদিন। যেন রোদের তেজের কাছে হার মেনেছেন সবাই। কৃষিতে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। উপকূলে শুকিয়ে গেছে পানি। হুমকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। সূর্যের প্রখর তাপে থার্মোমিটারে পারদ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁইছুঁই করছে। দেশের ইতিহাসে টানা ২৮ দিন তাপপ্রবাহের রেকর্ড অতীতে নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যে দিন যাচ্ছে, তা নিয়েই এতটা হাপিত্যেশ। সামনে আরও ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করছে। প্রকৃতি বিরূপ হয়ে ওঠার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আছে মানবসৃষ্ট বহু কারণ। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, গাছপালা উজাড় ও জলাধার কমে যাওয়ার পাশাপাশি ‘এল নিনো’র প্রভাবে এ বছর উষ্ণতা বেড়েছে বলে মনে করেন তারা। প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তি থেকে বাঁচার কিছু উপায়ও বাতলে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এমন দুর্যোগের জন্য প্রকৃতিকে দায়ী করে যাওয়াটা কোনো বিশেষজ্ঞই সমর্থন করছেন না। তাপপ্রবাহের পেছনে তারা মানুষের ভূমিকা দেখছেন। জলাশয় ধ্বংস থেকে শুরু করে অবিরাম কার্বন নিঃসরণ, নির্বিচারে গাছ কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ অনেক কিছুই প্রকৃতিকে রুষ্ট করে তুলছে বলে মনে করেন তারা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি এই আন্তঃমহাদেশীয় বাতাসের চলাচল ও স্থানীয় পর্যায়েও তাপমাত্রা বাড়ার কারণে দেশজুড়ে এ বছর তাপপ্রবাহ তুলনামূলক বেশি। এ ছাড়া বাংলাদেশে এল নিনো জলবায়ু সংকটের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এল নিনোর প্রভাব বিষয়ে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, এল নিনো মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের দুটি বায়ুপ্রবাহের একটি। এল নিনো বলতে মূলত উষ্ণায়নের অবস্থা বোঝায়। অন্যদিকে ‘লা নিনা’ বলতে বোঝায় এর শীতল অবস্থাকে। গত সেপ্টেম্বর থেকে এল নিনোর সক্রিয়তার কথা জানায় অস্ট্রেলিয়া ব্যুরো অব মেটেরোলজি। এর কারণে যে এবার বিশ্বজুড়েই তাপপ্রবাহ বাড়বে, তা আগে থেকেই সতর্ক করা হয়। গত ১৬ এপ্রিল এল নিনো শেষ হয়েছে বলে অস্ট্রেলিয়া ব্যুরো অব মেটেরোলজি জানিয়েছে। তবে শেষ হলেও এল নিনোর রেশ রয়ে গেছে। তাই এবার তাপপ্রবাহ বেড়েছে। এ ছাড়া এ বছর বৃষ্টি হয়েছে কম। এপ্রিলে মাত্র একটি বড় কালবৈশাখী হয়েছে। তিনি বলেন, সামনে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। নগরায়ণের কারণে অস্বস্তিও বাড়বে। আমরা সেটি মাথায় রেখেই কাজ করছি।

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, তাপপ্রবাহের তীব্রতা কম বা বেশি হওয়ার ওপর সেই স্থানের মানুষের নিয়ন্ত্রণ আছে। একই তাপপ্রবাহ ঢাকা শহরের পাশে অবস্থিত আড়িয়ল বিল এলাকার কিংবা পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের জন্য যতটুকু অস্বস্তি সৃষ্টি করবে, তার চেয়ে অনেক বেশি অস্বস্তি সৃষ্টি করবে ঢাকা শহরের মানুষের জন্য। যে এলাকায় খোলা জায়গা ও গাছপালা যত বেশি থাকবে, সেই এলাকায় মানুষ তাপপ্রবাহের ক্ষতিকর প্রভাব তত কম অনুভব করবে।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ঢাকার অত্যধিক জনসংখ্যাও তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। ইউএস-ইপিএর মতে, সাধারণত প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য যে কোনো এলাকার তাপমাত্রা ১.৮ থেকে ৫.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়তে পারে। ঢাকা নগরের জনসংখ্যা দুই কোটিরও বেশি, যা প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া নগরের একটি বিশাল অংশের মানুষ রান্নার কাজে কাঠ পুড়িয়ে থাকেন। এর বাইরে নগরীতে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রয়েছে, যাদের ২০ লাখ চুলায় গড়ে প্রতিদিন অন্তত তিন ঘণ্টা করে রান্নার কাজ চলে। ঢাকায় তাপমাত্রা বাড়ার আরেক কারণ হলো যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো। রাজধানীর বেশির ভাগ যানবাহন ও যানজটও তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। নতুন বহুতল ভবনের অতিরিক্ত কাচে ধারণ করা তাপ ও এসি থেকে নিঃসৃত তাপ বাতাসে ছড়িয়ে তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, গবেষণায় আমরা দেখেছি, ঢাকার বাতাসে পাঁচ ধরনের গ্যাস জমা হচ্ছে; যা নগরবাসীর নানা রোগবালাই এবং সমস্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বাতাসকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে। পাঁচ ধরনের গ্যাস হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড ও ওজোন। এসব গ্যাস ১০ থেকে ৪০০ বছর পর্যন্ত নগরের বাতাসে রয়ে যেতে পারে। এসব গ্যাসের উৎস কমাতে পারলে শহরের বায়ুদূষণ এবং অতি উষ্ণতাকেও নিয়ন্ত্রণ ও সহনীয় পর্যায়ে আনা যাবে।

সমুদ্রবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, বাংলাদেশের মানুষের এখন বাড়তে থাকা তাপমাত্রার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার সময় এসে গেছে। তাপপ্রবাহকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা, নীতি ও বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিবছর তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। তাপপ্রবাহ আগাম সতর্ক সংকেত ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন। এলাকা ও সময়ভিত্তিক তাপপ্রবাহের সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দিতে হবে। কোন কোন এলাকায় তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে, তাপমাত্রা কত ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে যাবে– এসব তথ্য দিয়ে দায় সারলে হবে না। ওই তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় আমাদের কী করতে হবে, কীভাবে এবং কারা তা করবে, সেই ব্যবস্থাপনাও রাখতে হবে। এককভাবে, সরকারি কোনো সংস্থার অল্প জনবল নিয়ে এ ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা করা কঠিন। তাই সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় তা কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে। সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। করণীয় তালিকা বেশ দীর্ঘ নয়। এককথায় বললে সচেতনতা, আন্তরিকতা এবং পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

এই সংকটকালে বৃক্ষনিধন ও বন উজাড় বন্ধ করার দাবি জানিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) কার্যকরী সভাপতি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, মানুষের শ্রমক্ষমতার সঙ্গে সুস্বাস্থ্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যারা বসে বসে ভারী কাজ করছেন, তাদের মাথার ওপর আমরা শেড দিতে পারি, পাখা দিতে পারি। যে গাছগুলো দ্রুত বাড়ে, আমরা সেসব গাছ লাগাতে পারি, যাতে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে পারে তারা। আমরা ঘাস লাগাতে পারি। রাস্তায় পানি ছিটাতে পারি, যাতে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে। প্রতিটি পয়েন্টে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে পারি, যাতে কিছুক্ষণ পরপর রিকশাওয়ালারা পানি পান করতে পারেন। এগুলো সরকারকে করতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কংক্রিটের পরিমাণ কমাতে হবে এবং বনায়ন করতেই হবে। বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে, সেটা ধ্বংসাত্মক নগরায়ণ। বিদেশি আগ্রাসী গাছ লাগানো হচ্ছে। নগর বনায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে প্রতিটি এলাকায় পর্যাপ্ত খালি জায়গা রাখতেই হবে। এলাকাভিত্তিক পুকুর বা জলাধার রাখতে পারলে তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তাপপ্রবাহকে বৈশ্বিক দুর্যোগ বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঢাকা কিংবা সারাদেশে তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে, আমরা ভ্রান্ত নগরায়ণের দিকে এগিয়েছি। যেভাবে ঢাকা নগরায়ণ হয়েছে, ব্যবস্থাপনার জন্য সেভাবে প্রশাসন গড়ে ওঠেনি। আগে থেকেই আন্তর্জাতিক সব সংস্থা বাংলাদেশে তাপপ্রবাহের বিষয়ে সতর্ক করেছে। তবে সেভাবে তাপপ্রবাহ নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ভূমিকা নেয়নি। আমরা নির্বিচারে উন্নয়নের নামে পুরো ঢাকা শহরকেই কংক্রিট দিয়ে মুড়ে দিয়েছি। সেগুলোতে আবার স্টিল ও কাচ দিয়েছি। তা কতটা তাপমাত্রা সহনীয়, সে বিচার করিনি। নগরে বড় বড় প্রকল্প করেছি, এর বিপরীতে নগরে যে ১৫ শতাংশ সবুজ থাকতে হয়, তা আমরা ভুলে গেছি। যেখানে গাছ ছিল, সেখানেও আমরা কংক্রিটের আস্তর দিয়ে দিয়েছি। আমরা সুউচ্চ ভবন করলেও ছাদবাগান বাধ্যতামূলক করিনি। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বিদেশি গাছ লাগাচ্ছি। ছায়া প্রদানকারী বৃক্ষ কেটে কেটে বাগানবিলাসের গাছ লাগাচ্ছি; যেগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ, অক্সিজেন বিকিরণে মোটেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে না।

তিনি বলেন, তাপমাত্রা হয়তো কমানো যাবে না। তবে তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে চাইলেই রাখা যাবে। জলবায়ু বিপর্যয়ের বিষয় সামনে রেখে নগরবাসীকে তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচাতে নগর সাজাতে হবে। প্রতিটি ছাদ সবুজ করতে হবে। এ নগরে আর ভ্রান্ত নকশার ভবন বানানোর অনুমতি দেওয়া যাবে না। নগরে জলাশয় ফিরিয়ে আনতে হবে। বন্যাপ্রবাহ এলাকাগুলো অবমুক্ত রাখতে হবে। নগরের নিচু জমিগুলোর সুরক্ষা দিতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। দুর্নীতি, লোভ, অদক্ষতা এ নগরীর যে সর্বনাশ করেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
 
তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো উদ‌্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে দুর্যোগ ব‌্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বলেন, সর্বশেষ ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকে তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করার কথা বলছেন। যখন আমরা কথা বলব, তখন উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি উত্থাপন করব।
উত্তরণবার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK
আরও সংবাদ
আরও সংবাদ