শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৪:৩৩
ব্রেকিং নিউজ

রাজা রামমোহন রায়ের ১৯০তম প্রয়াণ দিবস স্মরণে অনাথদের বস্ত্র ও খাদ্য প্রদান

রাজা রামমোহন রায়ের ১৯০তম প্রয়াণ দিবস স্মরণে অনাথদের বস্ত্র ও খাদ্য প্রদান

উত্তরবার্তা প্রতিবেদক : ৬ বছরের দুধে শিশু বাবুল দাসের হাতে যখন উৎসবের রঙিন পোশাক; তখন তার মধ্যে যারপরনাই আনন্দ। তার ভারী পাওয়ারের চশমাচোখ-অনাবিল হাসিমুখ বলে দিচ্ছিল কতটা উচ্ছ্বাসিত বাবুল। তার নাম ঘোষণার আগেই বিতরণমঞ্চের কাছ ঘেসে দাঁড়িয়েছিল বাবুল; এই বুঝি— তার নাম বলা হলো। দেরি সহ্য হচ্ছিল না তার। এ এক অভূতপূর্ব বিরল দৃশ্য। শুধু বাবুল দাসই নয়; এমন প্রায় ৯০ জন শিশু-কিশোর-বয়সী অনাথদের বাহারী বস্ত্র তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজ। ১৮ অক্টোবর এমন আয়োজন-উপলক্ষ্যের সবটাই ছিল সতীদাহ প্রথা রোহিতের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায়ের ১৯০তম প্রয়াণ দিবসকে ঘিরে।
 
সাদা-মাটা আয়োজন। ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থণাগৃহের ঠিক সামনে বাগানে সাজানো হয়েছিল মঞ্চ। পেছনে বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজের আনুষ্ঠানিক বেকড্রপ। সামনে একশ’ প্লাস প্লাস্টিক চেয়ারগুলোতে যেনো; এক একটি ফুল হাসছিল। কিন্তু সবার অবয়বে শান্ত-সৌম্য-স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিল অভাবিত। খোলা আকাশের নীচে বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজের ব্যতিক্রমী এই আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ফরাশগঞ্জে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ঢাকা অরফানেজ সোসাইটির [হিন্দু] অনাথ ছেলে মেয়েদের। সন্ধ্যাবধি এই আয়োজনের অতিথিরা যখন একে একে সবাইকে রঙ-বেরঙের, নানা ঢঙের পোশাক প্রদাণ করেছেন; তখন চারদিকে প্রাপ্তির আনন্দের মৌ মৌ ঘ্রাণ। ৬ থেকে ৩০ উধর্ব বয়সীদের নানা বস্ত্র দেওয়া হয়েছে।
 
অনুষ্ঠানে মঞ্চ থেকে পোশাক তুলে দিয়েছেন— ব্রাহ্মসমাজের নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রী রনবীর পাল রবি, অন্যতম সদস্য দেবাশিষ বিশ্বাস, সুশান্ত চন্দ্র বাবু, প্রদীপ কুমার পাল, বকুল চন্দ্র রায়,  বিপ্লব চক্রর্বতী, কানন বালা পাল, মঞ্জু সমাদ্দারসহ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানে শুধু পোশাক নয়, চিকিৎসাসেবার জন্য আর্থিক অনুদানও দেওয়া হয়। তুলে দেওয়া হয়েছে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী দুই অসহায় মানুষ- একজন হৃদয় মণ্ডলকে হুুইল চোয়ার এবং মিরাজ জোয়াদ্দারকে হুইল বেড। অনুষ্ঠানের সমাপনী লগ্নে ব্রাহ্মমন্দিরের বেদিমূলে বিপুলভাবে উৎসাহিত বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃবৃন্দ অভ্যাগতদের নিয়ে অনবদ্য ছবিও ফ্রেমবন্দি করা হয়।
 
ব্যতিক্রমধর্মী এই আয়োজনে সুশৃঙ্খলভাবে ঢাকা অরফানেজের অধ্যক্ষ কালীপদ সাহা তার আশ্রমের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ব্রাহ্মসমাজের আমন্ত্রণে। কথায় কথায় হাস্যোজ্জ্বল কালিপদ সাহা জানালেন— ‘তার অনাথ আশ্রমে রয়েছে প্রায় ৮৯জন ছেলে মেয়ে। তাদের থাকা-খাওয়া-পড়ার সব খরচই সোসাইটি থেকে বহন করা হয়। এই আয়োজনে তাদের সবাইকে বস্ত্র এবং খাদ্য প্রদান করা হয়েছে।’
 
 
বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক শ্রী রনবীর পাল রবি জানিয়েছেন, ‘ব্রাহ্ম সমাজ, হিন্দু ধর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো অনেকেই 'ব্রাহ্ম' আর 'ব্রাহ্মণ' এই দুটি শব্দ গুলিয়ে ফেলেন। আসলে দুটো ভিন্নার্থক শব্দ। হিন্দুদের একটি অংশের নাম ব্রাহ্মণ। অন্যদিকে ব্রাহ্মসমাজের অনুসারীরা এক ব্রহ্মের উপাসনা করেন। তারা বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর নিরাকার, তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ব্রাহ্মসমাজে কোনো দেব-দেবী নেই।’
 
তিনি আরো বলেন, ‘১৮৬৯ সালে বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে নানা আয়োজন করে আসছে। আজকের বস্ত্র ও খাদ্য প্রদান আয়োজনও তারই ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মন্দিরে প্রতি রবিবার প্রভাত এবং সন্ধ্যায় উপাসনার আয়োজন করা হয়। মহাধূমধামে পালন করা হয় রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। উৎসবের আয়োজন করা হয় ব্রাহ্মসমাজ এবং মন্দিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে। ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র-রবীন্দ্র-নজরুলসহ গুণীদের স্মরণেও উপাসনার আয়োজন করে এই প্রতিষ্ঠান। উৎসব-পার্বণে নিজেস্ব অর্থায়নে দুঃস্থ-দুখী-অনাথদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়।’
 
বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজের বছরব্যাপী উৎসবগুলোর মধ্যে রয়েছে—  ক. মাঘোৎসব : ১১ মাঘ ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার স্মরণোৎসব; খ. ভাদ্রোৎসব : ৬ ভাদ্র ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার স্মরণোৎসব এবং গ. বর্ষশেষ ও নববর্ষ উৎসব : ৩১ চৈত্র বর্ষশেষ ও ১ বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসব পালন করা হয়। এ ছাড়া স্মৃতি উপাসনা হিসেবে— ২২ মে, রাজা রামমোহন রায়ের জন্মদিবস; ২৭ সেপ্টেম্বর রাজ রামমোহন রায়ের প্রয়াণদিবস; ২০ জানুয়ারি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবস; ৮ জানুয়ারি ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্রের মৃত্যুদিবস; ৩০ সেপ্টেম্বর পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর মৃত্যু দিবস; ৮ মে (২৫ বৈশাখ) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস; ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণদিবস; ২৪ মে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিবস এবং ২৯ আগস্ট জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিবস পালন করা হয়। এ ছাড়া ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু দিবসে; বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের মহামানবগণের জন্ম-মৃত্যু দিবসে এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বিশেষ উপাসনার আয়োজন করা হয়।
 
ব্রাহ্মসমাজ প্রকৃতপক্ষে এক ধর্মীয় এবং সামাজিক আন্দোলনের নাম। রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ গোড়াপত্তন করেন ১৮২৮ সালে। তিনি নিজের গভীর উপলব্দি থেকে একটি নতুন, নিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করে সমমনাদের নিয়ে গঠন করেন একেশ্বরবাদী সমাজ— যার নাম ব্রাহ্মসমাজ। ব্রাহ্মসমাজে বর্ণভেদ নেই। 'বেদান্ত' এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মসমাজ। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সপ্তদশ-বিধি’ আইন পাস হয়। ফলে বর্বর সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হয়। তিনি ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি ‘হিন্দু কলেজ’ [যা পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বর্তমানে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত] স্থাপন করেন। ১৮৩৩ সালে রাজা রামমোহন রায় যখন মারা যান, তখন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের প্রচার-প্রচারণা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিজে হাতে তুলে নেন। এভাবেই ঠাকুর পরিবারে প্রবেশ করে ব্রাহ্মসমাজ। যা প্রভাবিত করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও।
 
ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম একজন গুণগ্রাহী মহীয়সী মানব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালে এই মন্দিরে এসেছিলেন। অংশ নিয়েছেন উপাসনায়। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ এই প্রতিষ্ঠানের পাশেই ব্রাহ্ম স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী তার বাবার নামে স্কুলটির সংস্কারপূর্বক নামকরণ করেন জগন্নাথ স্কুল। বর্তমানে যা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নামে সুপরিচিত। 
 
পরিশেষে ব্রাহ্মসমাজের চিরায়ত উপাসনা স্মরণতব্য—‘ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়।’ এই মর্মকথার মাঝেই ব্রাহ্মসমাজের বিশেষত্ব লুকিয়ে রয়েছে। তারা প্রার্থনায় বিশ্বব্রম্মাণ্ডের সকল জাগতিক প্রাণীর মঙ্গল কামনা করেন। রাজ রামমোহন রায়ের প্রকৃত অনুসারী হিসেবে মানবসেবাকেই তারা অন্যতম ব্রত মনে করেন। 
উত্তরণবার্তা/আসো

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK
আরও সংবাদ