রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ২৩:৫৩
ব্রেকিং নিউজ

নীলফামারীতে স্বাভাবিক প্রসবে আলো ছড়াচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক

নীলফামারীতে স্বাভাবিক প্রসবে আলো ছড়াচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক

উত্তরণবার্তা প্রতিবেদক :  জেলার সদর উপজেলায় কমিউনিটি ক্লিনিকের সুবিধায় স্বাভাবিক প্রসবের দিকে ঝুঁকছেন প্রসূতি মায়েরা। এ কার্যক্রমের গতি বাড়াতে আটটি ক্লিনিকে নিরাপদ প্রসব কক্ষ নির্মাণ করে দিয়েছে সদর উপজেলা পরিষদ। পরিচালন ও উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউজিডিপি) আওতায় গত অর্থবছরে এসব কক্ষ নির্মাণ করা হয়।
স্বাস্থ্য বিভাগের সূত্রমতে, সদর উপজেলায় ৪৬টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এসব ক্লিনিকে বিভিন্ন রোগের ২৭ প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি গর্ভবতী মায়েদেরকে নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসবে উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরে ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৪৫জন মায়ের স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়। কার্যক্রমের গতি বাড়াতে সদর উপজেলা পরিষদ ইউজিডিপি প্রকল্পের আওতায় আটটি নিরাপদ প্রসব কক্ষ করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে এসব কক্ষ ব্যবহার হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে জেলা সদরের কচুকাটা ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে নবনির্মিত নিরাপদ স্বাভাভিক প্রসব কক্ষ। উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে ৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ব্যয়ে ইউজিডিপি’র অধীনে নির্মান করা হয় কক্ষটি। ঝকঝকে কক্ষে রয়েছে প্রসবের আধুনিক বিভিন্ন সরঞ্জাম। গত জুলাই মাসে প্রথম একটি স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয় সেখানে। সেখানে কর্মরতরা জানান, তাদের তত্বাবধানে নিরাপদ প্রসবের অপেক্ষায় আছেন আরও ৫৬ জন প্রসূতি। তারা সকলে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সময় প্রসূতি মা’সহ অভিভাবকরা ভাবতেন সিজারের মাধ্যমে প্রসব করানোই ঝুঁকিমুক্ত। কিন্তু প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও অর্থ অপচয়ে বিষয়টি বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তাদের কাছে। বর্তমানে সে ধারণা পাল্টে স্বাভাবিক প্রসবের দিকে ঝুঁকছেন প্রসূতি মায়েরা।
বানিয়াপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে উপজেলা পরিষদ নির্মিত কক্ষে গত ২২ জুলাই স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয় কচুকাটা ইউনিয়নের ব্রম্মতল গ্রামের রিয়ামনি আক্তারের (১৯)। প্রথম ছেলে সন্তানের জন্ম হওয়ায় তিনি অনেক খুশি। গ্রামের কৃষক নাঈম হোসেনের স্ত্রী রিয়ামনি আক্তার বলেন,‘মোর পহেলা ছাওয়া এইটা। অনেকে সিজার করির পরামর্শ দিছে। এরপর ক্লিনিকোত আসি আপাক (সিএইসিপি) দেখানু। সেইথাকি আপা নিয়মিত মোর চেক করিল। সময় আসিল, আপা কইল ক্লিনিকতেই নরমাল ডেলিভারি হোবে। সেদিন (২২ জুলাই) মধ্য আইতোত ব্যাথা উঠিল (প্রসব ব্যাথা), আপাক খবর দিয়া ক্লিনিকোত আসিনু। আপা আসিবার এক ঘন্টার মধ্যে মোর ছাওয়ার জন্ম হইল। এলা ছাওয়াসহ মুই সুস্থ্য আছে।’
তিনি জানান, সিজার করা মা অনেকের কাছে পরবর্তী কষ্টের কথা শুনেছিলেন। এ কারণে স্বাভাবিক প্রসবের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।  
ইউনিয়নের বানিয়া পাড়া গ্রামের ইসমত আরা (৩০) বলেন, ‘পাঁচ বছর আগোত পহেলা বেটা (ছেলে) ছাওয়া সিজার করি হইছে। ওই সময় খরচ হইছে মেল্লা টাকা। ধার দেনা করি টাকা যোগার করির লাগিছে। সিজারের পর একমাস কোন কাজ-কাম করির পারো নাই। এতে করি সংসারোত মেল্লা ঘাটতি হইছে। গত বছরের প্রথম মাসের (জানুয়ারি) ১৬ তারিখ আরেকটা বেটি (মেয়ে) ছাওয়া গ্রামের ক্লিনিকত (কমিউনিটি)  সিজার ছাড়া হইছে। এতে হ কোন টাকা খরচ হয় নাই, আগের মতন সমস্যাও হয় নাই। এই জন্য মুই কও সিজার না করায় ভালো।’
বানিয়া পাড়া গ্রামের গৃহিনী লিপি বেগম (৩০) বলেন, ‘আগে বাচ্চা নেওয়ার জন্য নীলফামারী অথবা রংপুর যেতে হতো। এখন বাড়ির কাছে ক্লিনিকে নিয়মিত গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে। সিজার ছাড়াই বাচ্চা প্রসব হচ্ছে, এতে গ্রামবাসী অনেক খুশি।’
ক্লিনিকের সিএইচসিপি (কমিউনিটি হেল্থ কেয়ার প্রোভাইডার) মোছা. আশরাফি বেগম জানান, অন্যান্য প্রশিক্ষণের পাশপাশি তিনি ধাত্রী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। সে প্রশিক্ষণের পর থেকে স্বাভাবিক প্রসবে উদ্বুদ্ধ করছেন গর্ভবতী মায়েদেরকে। এমন তৎপরতায় গত ৭ মাসে দুইটি স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে তার ক্লিনিকে।
তিনি বলেন,‘স্বাভাবিক প্রসবের জন্য উপজেলা পরিষদ একটি আধুনিক কক্ষ নির্মাণ করে দিয়েছে। এতে এলাকার মানুষ অনেক খুশি। ওই কক্ষে গত ২২ জুলাই মাত্র দেড় ঘন্টার চেষ্টায় এক মায়ের নরমাল ডেলিভেরি হয়। নতুন ওই ঘরে সেদিন যখন বাচ্চা কান্না করছিল, আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। এলাকার মানুষও আনন্দে ক্লিনিকের সামনে ভীড় জমায়।’
আশরাফি বেগম বলেন, ‘গ্রামের মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছেন। নিরাপদ সন্তান প্রসবের জন্য তারা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন, আমার অধীনে এখন ৫৬ জন গর্ভবতী মা আছেন। এখন পর্যন্ত তারা স্বাভাবিক প্রসবের কথা মাথায় রেখে এগুচ্ছেন।’
সিএইচসিপি মোছা. আশরাফি বেগম জানান, ইতিমধ্যে তার কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করেছেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদ, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন নাহার, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা  আবু হেনা মোস্তফা কামাল। এলাকাবাসীতে উদ্বুদ্ধ করার পাশপাশি ক্লিনিকে প্রসব হওয়া নবজাতক ও প্রসূতি মাকে উপহার প্রদান করেছেন তারা।
সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘জেলা সদরে মোট ৪৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে আটটি ক্লিনিকে উপজেলা পরিষদ ইউজিডিপি প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ ডেলিভারি কক্ষ করে দিয়েছে। ক্লিনিক গুলোতে ২৭ প্রকারের ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। বর্তমান সময়ে বাসায় নিরাপদ ডেলিভারি হতে পারে না, তাই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরাপদ ডেলিভারি করতে হবে। উপজেলা পরিষদের উদ্যোগ স্বাভাবিক প্রসব কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করবে।’
তিনি জানান, জেলা সদরে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি জুন মাস পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকে ৪৫ জন মায়ের স্বভাবিক প্রসব হয়েছে। তারা সকলে নিরাপদে আছেন। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন নাহার জানান, উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার অর্থায়নে জেলা সদরে আটটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ডেলিভারি কক্ষ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কক্ষ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা করে।
সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহিদ মাহমুদ বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে স্বাভাবিক ডেলিভারি নিশ্চিৎ হওয়ার সফলতায় আটটিতে নিরাপদ ডেলিভারি কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি ক্লিনিকে এ ধরণের কক্ষ করে দেওয়ার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।

উত্তরণবার্তা/ডেল

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK
আরও সংবাদ