শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৩:৪৭

অনলাইনে আম বিক্রি বেড়েছে, কমেছে আড়তে

অনলাইনে আম বিক্রি বেড়েছে, কমেছে আড়তে

উত্তরণর্তা প্রতিবেদক : চাঁপাইনবাবগঞ্জে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে অনলাইনে আম বেচাকেনা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনলাইনে আম বিক্রি করার পেশায় ঝুঁকছেন অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকরা। আগে বাজারে এসে আম কিনতে হলেও এখন অনলাইনে বাড়িতে বসেই আমের স্বাদ নিতে পারছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্রেতারা। এদিকে বেশি পরিমাণে অনলাইনে আম বেচাকেনা হওয়ায় বাজারে আমের চাহিদা কমেছে। ফলে বাজারে কম পরিমাণে আম বিক্রি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন আড়ৎদারেরা।

আমের রাজধানী খ্যাত উত্তরা লের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে অর্থকারী ফসল আম। হাতেগোনা কয়েক মাসের আম ব্যবসায় নির্ভর করে এখানকার বাসিন্দাদের বছরের বাকিটা সময়। গত কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পেইজ খুলে স্বল্প আয়ের ব্যবসার খাতায় নাম লেখাচ্ছে জেলার শিক্ষিত বেকার যুবকরা। এই তালিকায় নাম আছে অনেক গৃহবধুরও। কয়েক মাসের জন্য অনলাইনে আম বেচাকেনা হলেও পরবর্তীতে এই মাধ্যমের সাহায্যে অন্যকোন খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে ঝুঁকছেন তারা।

অনলাইনে আম ব্যবসায়ীদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তারা পেইজ খুলে বিভিন্ন জাতের আমের ছবি শেয়ার করেন। এতে করে সারা দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছে ওই আমের ছবি পৌঁছালে আম কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এছাড়াও ফেসবুক ভিত্তিক গ্রুপের যারা সবধরণের পণ্য নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করেন, সেই গ্রুপেও অনেকই আমের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপণ প্রচার করেন। প্রাথমিক শুরু হয় এমন ভাবেই আম বেচাকেনা। আমের কাঙ্ক্ষিত দাম নেয়ার পাশাপাশি কুরিয়ার সার্ভিস চার্জ অগ্রিম নেন তারা। হাতে গোনা কয়েক দিনের মধ্যে বাড়িতে বসে সুমিষ্ট আমের স্বাদ নিতে পারেন দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্রেতারা। অনলাইনে আম বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত থাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিদিন তারা এভাবে কয়েক হাজার মেট্রিক টন আম বেচাকেনা করছেন।

জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা নুর-ই-জান্নাত। আসিফা নামে তার এক মেয়েকে নিয়ে আম বিক্রি করছেন গত কয়েক বছর ধরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘শতরুপা’ নামে ফেসবুক পেইজ খুলে আম বেচাকেনা করেন তারা। গত বছর মা- মেয়ে অনলাইনে আম বিক্রি করেছেন সাড়ে ৮০০ মণেরও বেশি।

নুর-ই-জান্নাত বলেন, ‘গত মাসের ২৪ তারিখ থেকে গোপালভোগ আম দিয়ে অনলাইনে আম বিক্রি শুরু করেছি। বর্তমানে খিরসাপাত ৮৫ টাকা ও ল্যাংড়া ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি আম বিক্রি করছি আমরা। আমাদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন ৪৫০ কেজি থেকে ৫০০ কেজি পর্যন্ত আমের অর্ডার অসে, আবার কোনো কোনো দিন বেশিও অর্ডার হয়।’

তার ভাষ্যমতে, ‘আগামীতে আম্রাপালি, বিশেষ একধরণের গুটি, বারি-৪, ফজলি আম বিক্রি করছেন। এছাড়াও আমের পাশাপাশি তারা বছরজুড়ে এই অনলাইন পেইজের মাধ্যমে কয়েক পদের আমের আচার, আমসত্ত্ব আরও অনান্যপণ্য বিক্রি করেন তিনি।

কুরিয়ার সার্ভিসের সেবা নিতে গিয়ে নুর-ই-জান্নাত নিজে বিড়ম্বনায় না পড়লেও, অনলাইনের মাধ্যমে আম বিক্রি করা অন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিড়ম্বনার শিকার হওয়ার খবর তিনি পেয়েছেন। তিনি জানান, খদ্দেরের জন্য কুরিয়ার সার্ভিসে আম বুকিং দেয়ার পর আম চুরি হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যথাসময়ে আম না পৌঁছানোর অভিযোগ শুনেছেন তিনি। ফলে অনেক অনলাইন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর নাম খারাপ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলেও জানান নুর-ই-জান্নাত।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার বাসিন্দা অনার্স পড়ুয়া সাব্বির হোসেন। তিনি গত ৩ বছর ধরে অনলাইনে আম বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। গত বছর কয়েক দিনের ব্যবধানে ৪৫০ মণ আম বিক্রি করেছেন। এতে তার বাণিজ্য হয়েছে আনুমানিক ৯ লাখ টাকাও বেশি। গোপালভোগ আম বিক্রির মধ্য দিয়ে চলতি বছরে অনলাইনে আম বেচাকেনা শুরু করেছেন তিনি। সাব্বির বলেন, ‘লেখাপড়ার পাশাপাশি ফেসবুকে পিওর প্রিমিয়াম পেইজ খুলে অনলাইনে আম বেচাকেনার শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত আড়াইশত মণেরও বেশি আম বিক্রি করেছি। এই বছরে সাড়ে ৭০০ মণ অনলাইনের মাধ্যমে আম বেচাকেনা লক্ষ্য আছে আমার। এতে প্রায় ১৮ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকার বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

দেশের বৃহত্তম আম বাজার কানসাট। এই বাজারে আম বিক্রি করতে আসা বাগান মালিক ও চাষিরা বলছেন আড়ৎদারেরা আম কিনছেন না। আড়ৎদারেরা কেন আম কিনছেন না— এই প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ সাহেব আলী নামে এক আড়ৎদার বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানের বাজারগুলোতে আমের চাহিদা কমেছে গেছে, শুধু মাত্র অনলাইনে আম বিক্রি হওয়ার কারণেই। এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অনেকজন আমবিক্রি করছেন অনলাইনে। অনলাইনে যারা আমের বেচাকেনা করছেন তাদের জন্যই পুরাতন পত্রিকা, ক্যারেট, গাড়ি ভাড়া সব বেড়ে গেছে। অনলাইনে যারা ব্যবসা করছেন তারা বেশি দামে আম বিক্রি করছেন।

কানসার আড়ৎদার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক টিপু বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনা এই বছর অনলাইনে বেশি পরিমাণে আম বিক্রি হচ্ছে। অনলাইনে যারা আম বিক্রি করছেন তারা সবাই বাগান থেকে আম কিনে বিক্রি করেন। অনলাইনে আম বিক্রি করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কাঙ্খিত দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছে আম চাষি ও বাগানিরা।

অনলাইনে বেশি পরিমাণে আম বিক্রি হওয়ায় কিছুটা হলেও আড়ৎদারেরা ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানান জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় খাতাকলমে ২৪০ জন অনলাইনে আম বিক্রি করছেন। তবে গত এই বছরে অনেক জনই অনলাইনের মাধ্যমে আম বিক্রি করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিচ্ছেন।

দিনে কত কেজি অনলাইনের মাধ্যমে আম বেচাকেনা হয়, তা জানাতে না পারলেও তিনি বলেন, ‘জেলায় যেসব শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা অনলাইনে আম বিক্রির সঙ্গে জড়িত তাদের অধিকাংশ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা যেন কৃষিপণ্য বিক্রি লাইসেন্স করে আম বিক্রি করে। কিন্তু তারা আমাদের কথা কর্ণপাত না করে আম বিক্রি করে যাচ্ছে। আগামীতে তাদের সবাইকে কৃষিপণ্য বিক্রি লাইসেন্সের আওতায় আনার জন্য সকল কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

অনলাইনে আম বিক্রি করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সরকারি অ্যাপ ‘সদাই’ এর মাধ্যমে আম বেচেকানা পরামর্শও দেওয়া হয়েছে বলেও জানান কৃষি বিপণন কর্মকর্তা। আমের রাজধানী খ্যাত এ জেলায় এবার ৩৭ হাজার ৮৫৫ হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। এবার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার।
উত্তরণর্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK