রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৮:২৮
ব্রেকিং নিউজ

ব্রাহ্ম মন্দিরে উপাসনা-গান-কথা-শ্রদ্ধায় রাজা রামমোহন রায়ের ২৫১তম জন্মদিন পালিত

ব্রাহ্ম মন্দিরে উপাসনা-গান-কথা-শ্রদ্ধায় রাজা রামমোহন রায়ের ২৫১তম জন্মদিন পালিত

► রাজিয়া সুলতানা
স্নিগ্ধ পরিবেশে অসাধারণ সূচনা। ইথারে ভেসে আসছে উপাসনা, বেদান্তের কথা; তার ফাঁকে ফাঁকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল রবিঠাকুরে কখনো ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও/আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও’ আবার কখনো ‘তুমি, নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে/তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে’— এসব গানের সুর-লয়-তালের মুগ্ধতার সৌরভ। আয়োজন-উপলক্ষ্যের সবটাই ছিল সতীদাহ প্রথা রোহিতের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায়ের ২৫১তম জন্মদিন নিবেদনে। ২২ মে সেই দিনটি যথাযথভাবে উদযাপন করতেই বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের ব্যতিক্রমী এই আয়োজন। অনুষ্ঠানের সূচনা পাটুয়াটুলির ব্রাহ্ম মন্দিরে বেদিমূলে রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করে। পর্বটি ছিল নমিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন অনবদ্য আয়োজন। সেখানে সব অভ্যগতরা একে একে ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে ওই মহামানবকে স্মরণ করেন। 
 
‘সমকালে অপরিহার্য রাজা রামমোহন রায়’ শীর্ষক আলোচনা, উপাসনা, ব্রহ্মসঙ্গীতানুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং রাজা রামমোহন গবেষক কামরুল ইসলাম। অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শাহিনুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শহীদ কাদের চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিঠুন কুমার সাহা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু সালেহ সিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শান্তাপত্র নবীশ ও দীনেশচন্দ্র সেন গবেষণা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ড. চিন্ময় হাওলাদার। বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য দীপক পালের শ্রুতিমধুর উপাসনা, ঋদ্ধ সংগীতশিল্পী খায়রুজ্জামান কাইয়ূম ও সহশিল্পীদের হৃদয়ছুঁয়ে যাওয়া পরিবেশিত গান, সংগীতা চৌধুরীর অনুষ্ঠান নির্মল সঞ্চালনা, বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদক শ্রী রনবীর পাল রবির স্মিথ স্বাগত বক্তব্য আয়োজনে এনেছিল ভিন্নমাত্রা। অনুষ্ঠানের শেষপর্বে গবেষক কামরুল ইসলামের ‘আধুনিক বাঙালি রামমোহন রায়’— গ্রন্থ উন্মোচনও সাড়া জাগিয়েছে।
 
 
 
অনুষ্ঠানের সভাপতি রাজা রামমোহন গবেষক কামরুল ইসলাম বলেন, ব্রাহ্ম সমাজ, হিন্দু ধর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো 'ব্রাহ্ম' আর 'ব্রাহ্মণ' দুটো ভিন্নার্থক শব্দ। হিন্দুদের একটি অংশের নাম ব্রাহ্মণ। অন্যদিকে ব্রাহ্ম সমাজের অনুসারীরা এক ব্রহ্মের উপাসনা করেন। বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর নিরাকার, তাকে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ব্রাহ্মদের মাঝে কোনো দেব-দেবী নেই।’
 
অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তারা বলেন, ব্রাহ্ম সমাজ প্রকৃতপক্ষে এক ধর্মীয় এবং সামাজিক আন্দোলনের নাম। রাজা রামমোহন রায় এর গোড়াপত্তন করেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। সতীদাহ, বহুবিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, জাতিভেদ, ব্রাহ্মণদের দাপট, সুদ্রের কান্নায় হিন্দুধর্মে তখন প্রতিষ্ঠিত। চলছিল নিরক্ষর সাধারণ মানুষদের খ্রিষ্টান ধর্মে রূপান্তর করার মহাযজ্ঞ। হিন্দু সমাজ ভেঙে পড়ার একদম অন্তিম পর্যায়ে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় একটি নতুন, নিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করেন। কয়েকজন সমমনা মানুষকে নিয়ে গঠন করেন একেশ্বরবাদী সমাজ, যার নাম ব্রাহ্ম সমাজ। সেই থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
 
ব্রাহ্ম সমাজে বর্ণভেদ নেই। 'বেদান্ত' এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ব্রাহ্ম সমাজ। তবে ১৮৩৩ সালে রাজা রামমোহন রায় যখন মারা যান, তখন 'ব্রাহ্ম সমাজ'-এর কার্যক্রম প্রায় থেমে গিয়েছিলো। তখন রামমোহনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজের প্রচার-প্রচারণা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিজে হাতে তুলে নেন। এভাবেই ঠাকুর পরিবারে প্রবেশ করে ব্রাহ্ম সমাজ। প্রভাবিত করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও। আবার ব্রাহ্ম সমাজের অনেক অনুসারীই কয়েক পুরুষ পর সনাতন হিন্দুধর্মে ফিরে গিয়েছন। 
 
রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালে ২২ মে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অন্ধকারময় হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত করার জন্য ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ‘আত্মীয় সভা’ গঠন করেন। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি একে ‘ব্রাহ্মসভা’য় পরিণত করেন। ১৮২৮ সালে এটি আবার ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয়। রামমোহন রায়ের অবিস্মরণীয় অবদান হল সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটানো। তাঁর প্রচেষ্টায় বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সপ্তদশ-বিধি’ নামে আইন পাস করে এই বর্বর সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি ‘হিন্দু কলেজ’ [যা পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বর্তমানে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত] স্থাপন করেন। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এই মহামানব ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন।
 
 
ঢাকার পাটুয়াটুলিতে বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরটি ১৮৬৯ সালে উদ্বোধন করা হয়। ব্রাহ্ম সমাজের এই মন্দিরে প্রতি রবিবার নিয়মিত আর্চনা-প্রার্থনা হয়। এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ আসতে পারেন। বিশেষ কিছু দিবস ধরে এখানে উৎসবের আয়োজন করা হয়। বাংলা ১১ মাঘ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিশেষ কর্মসূচি উদযাপন করা হয়। মহাধূমধামে পালন করা হয় রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম একজন মহীয়সী মানব হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালে এই মন্দিরে এসেছিলেন। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার ব্রাহ্মসমাজ ব্রাহ্ম স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী তার বাবার নামে স্কুলটির নামকরণ করেন জগন্নাথ স্কুল। বর্তমানে যা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নামে সুপরিচিত। শুধু ব্রাহ্ম সমাজের অনুসারীরাই নয়; অনেক সাধারণ মানুষও এই মন্দির পরিভ্রমণ করে স্বস্তিময় শান্তি খুঁজে ফিরেন। চাইলে যেতে পারেন আপিনও।
 
পরিশেষে ব্রাহ্ম সমাজের চিরায়ত অর্চণা স্মরণতব্য— ‘যো যোনিং যোনিম্ অধিতিষ্ঠতি একঃ যস্মিন্ ইদং সং চ বি চৈতি সর্বম্/তমীশানং বরদং দেবমীড্যং নিচায্যেমাং শান্তিম্ অত্যন্তম্ এতি’ [শ্বেতাশ্বতর-৪/১১]; অর্থাৎ : ‘ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই সবকিছুর মূল। জগৎ প্রকাশিত হলে সেই জগৎকে তিনিই পালন করেন। আবার প্রলয়কালে জগৎ তাঁর কাছেই ফিরে যায়। তিনি সবকিছুর নিয়ন্তা। একমাত্র তিনিই ভক্তদের বর দেন। তিনিই একমাত্র আরাধ্য। এই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অনুভূতি হলে শাশ্বত শান্তি লাভ করা যায়।’ বাণীস্রষ্টা কিংবদন্তি রাজা রামমোহন রায়ের ২৫১তম জন্মদিনের আসুন আবারো বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
দেশকণ্ঠ/আসো

 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK
আরও সংবাদ