সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৩:২৪
ব্রেকিং নিউজ
কলঙ্কজনক ২১ এপ্রিল

সায়েমকে উৎখাত করে যেভাবে ক্ষমতায় এলেন জিয়া

সায়েমকে উৎখাত করে যেভাবে ক্ষমতায় এলেন জিয়া

উত্তরণবার্তা প্রতিবেদক : ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কময় দিন। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভ্রূণ ধ্বংস করেছিলেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রের যে বীজ রোপিত হয়েছিল, তার ভয়ঙ্কর প্রকাশ ঘটেছিল এদিন। গভীর রাতে বন্দুক ঠেকিয়ে রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।

সায়েমকে সরানোর অন্যতম কারণ ছিল জিয়ার নির্বাচনের ভয়। সায়েম যেকোনো সময় নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, এই ভয় থেকে তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন জিয়া। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরিতে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিল। কেন তিনি এই ভূমিকা রেখেছিলেন, তার কাজের মধ্য দিয়েই তা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, প্রথমে সায়েমকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন জিয়া। পরে তিনি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাও কব্জা করে নেন। গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘বিএনপি সময়-অসময়’ বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। বইটিতে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। পরে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন।
 
সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস করতে চেয়েছিলেন জিয়া
১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। বাংলার সবুজ জমিনকে রক্তে লাল করে দিতে তাদের কোনো চিন্তা করতে হয়নি। নির্বিচারে তারা হত্যা করেছে অগণিত মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ, পাকিস্তানি হানাদারদের বুলেট থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বিদ্রোহ করেন জিয়া। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে জিয়া চট্টগ্রামে অসামরিক টেলিফোন অপারেটরকে বলেন, চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার, পুলিশের এসপি ও ডিআইজি এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের জানাতে যে, ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা।’

তবে জিয়াউর রহমান কী আসলেই যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের লেখায় কিন্তু ভিন্ন তথ্যই উঠে আসে। তিনি এক লেখায় উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর শক্তি বাড়াতে যত ধরনের আয়োজন দরকার, সবই করছিলেন ইয়াহিয়া খান। ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সব ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন শ্রীলঙ্কার ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক ফ্লাইট আসতো। জাহাজে অস্ত্র ও সৈন্য আসছে, সোয়াতে আসছে। সেই সোয়াত থেকে অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করে বাঙালি সৈনিকরা।

তখন চট্টগ্রামের সেনানিবাসের বাইরে ষোলোশহর এলাকায় একটি নতুন মার্কেটের কাঠামো করা হয়েছিল। যেটি চালু হয়নি। সেখানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অস্থায়ীভাবে ছিল। সেখান থেকে তারা পাকিস্তানে চলে যাবে। সেটির কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার খান জানজুয়া। সেই ইউনিটে কর্মরত ছিলেন মেজর জিয়া। তখন সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাসের দায়িত্ব দেয়া হয় জিয়াকে। সেই অস্ত্র দিয়েই বাঙালিদের হত্যার পরিকল্পনা ছিল।
 
‘এরমধ্যে ইপিআরের উইং কমান্ডার মেজর রফিক বীর উত্তম (তখন তিনি ক্যাপ্টেন) বিদ্রোহ করেন। চট্টগ্রামের রেলওয়ে এলাকায় পাহাড়ের ওপর একটি কাঠের গেস্ট হাউসে অবস্থান করছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের ২৫ বা ২৬ মার্চ রাতে সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাওয়ার কথা ছিল। তখন পথে পথে বেরিকেড দেয়া হয়েছিল। জিয়া এই বেরিকেড ভেঙেই সোয়াত থেকে অস্ত্র নামাতে যেতে চেয়েছিলেন। তখন কর্নেল অলি একটি গাড়িতে এসে মেজর জিয়াকে বলেন যে, ঢাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে।’

অধ্যাপক মান্নান বলেন, ‘অলিই সেই সময় জিয়াকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেই জিয়াই এখন বড় নেতা।’ পরে তৃতীয় ও অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে একটি ব্রিগেড তৈরি করা হলে জুনের শেষ দিকে মেজর জিয়াকে এর কমান্ডার নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরের নির্দেশে মেজর জিয়ার প্রথম অক্ষর নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর এই ব্রিগেডের নাম রাখা হয় জেড ফোর্স। জিয়াকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদায়ন করা হয়।
 
সেনাপ্রধান না হতে পেরে ক্ষুব্ধ ছিলেন জিয়া
১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিয়োগ দেয়া হয় সফিউল্লাহকে। আর জিয়াউর রহমানকে করা হয় ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। সেনাপ্রধান না হতে পেরে জিয়ার মনে ক্ষোভ ছিল। এ নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছিল।
তার অনুগত একজন লে. কর্নেল আবু তাহের। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর ভাষ্য অনুযায়ী, তাহের একবার তার কছে এসে বলেছিলেন, ‘স্যার, এতদিন তো চিফ থাকলেন, এখন এ পদটা জিয়াউর রহমানের জন্য ছেড়ে দেন।’ জবাবে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘ইউ আর ডাউন ক্যাটাগোরাইজড; এখনই সিএমএইচে গিয়ে সসম্মানে মেডিকেল বোর্ড আউট হয়ে যাও।’
 
লে. কর্নেল হামিদের ভাষ্য অনুযায়ী, সফিউল্লাহ ও খালেদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ‘অনুগত’। তখন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে সফিউল্লাহর পর খালেদই সেনাপ্রধান হবেন। জিয়াকে অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে করা হতো। এ সময়ে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে বার্লিনে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে যায়। এটা জেনে তখনকার কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার) খুরশীদ উদ্দিন আহমেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে তদবির করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি পেতে তার রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন জিয়া। একবার রেগে গিয়ে কর্নেল হামিদকে জিয়া বলেন, ‘শেখকে ওই ব্যাটারাই (সফিউল্লাহ, খালেদ) আমার বিরুদ্ধে খেপিয়েছে’।
 
১৯৭৫ সালের ২৫ মে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। জিয়া তাকে প্রায়ই বলতেন, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি; সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের পদটি তারই পাওয়া উচিত ছিল। অধ্যাপক নূরুল ইসলামের ভাষ্যানুযায়ী, ‘পদাতিক বাহিনীর কাঠামোবিন্যাস নিয়ে একদিন আমি, প্রতিরক্ষাসচিব মুজিবুল হক, জেনারেল সফিউল্লাহ ও জিয়ার মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। সে সময় খবর পাই, সফিউল্লাহকে তিন বছরের মেয়াদশেষে আরও তিন বছরের জন্য সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু। এটি জানার পর জিয়াউর রহমান আমার অফিসে এসে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে বলেন। প্রতিরক্ষাসচিব মুজিবুল হককেও বিষয়টি জানান তিনি।

‘‘আমি জিয়াউর রহমানকে দুই-একদিন অপেক্ষা করতে বলি এবং বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে জানাই। সেদিন বঙ্গবন্ধু খুবই রেগে গিয়ে বলেন, ‘তুমি এখনই তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। তুমি জানো না, জিয়া অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী।’’
নূরুল ইসলাম লিখেছেন, ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের দুই দিন আগে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে আমাকে অবহিত করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করি। বঙ্গবন্ধুও মনে হয়, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের কাছ থেকে আগে কিছু আভাস পেয়েছিলেন।

ডিজিএফআইয়ের প্রধানও আমার সঙ্গে আলোচনা করে সফিউল্লাহকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, কেন নেয়া হয়নি তা এখনো আমার অজানা। এর দুই-দিন পরেই ঘটে এ দেশের ইতিহাসের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।এরপরই রাজনীতিতে দেখা দেয় পালাবদলের হাওয়া। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ একটি ঘোষণা দিয়ে সামরিক আইন জারি করেন। এতে বলা হয়, ১৫ আগস্ট ভোরবেলা থেকে সামরিক আইন কার্যকর হয়েছে।

জিয়ার ভাগ্য খুললো
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনাবাহিনীতে পরিবর্তনের প্রথম ধাক্কা লাগে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর ওপর। ২৪ আগস্ট তাকে সরিয়ে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
সেনাপ্রধান হওয়ার খবর পেয়ে তিনি কেবল খুশিই হননি, মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের সিগন্যাল মেসের গ্রাউন্ডে অফিসার ও জওয়ানদের জড়ো করে তিনি চিৎকার করে জানিয়ে দেন, ‘আজ থেকে আমি চিফ অব স্টাফ’।
 
সেনাবাহিনী প্রধান পদে জিয়াউর রহমানকেই চাইছিল ১৫ আগস্টের ঘাতকরা। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লিখেছেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেনাবাহিনী প্রধানের পদটি নিয়ে। রশিদ ও ফারুক এ পদে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে স্থলাভিষিক্ত করতে চাইছিল।’
 
জিয়াউর রহমান কীভাবে সেনাবাহিনী প্রধানের পদে বসেছিলেন সে বিষয়ে তার ঘনিষ্ঠ লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, “জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট ফোন করে তার কাছে যেতে বলেন। আমি একটু পরে আসছি বলায় তিনি রেগে বলে ওঠেন- শাট আপ, এক্ষুণি আস। আমি তার অফিসে গেলে তিনি বলে ওঠেন-  যথাযথভাবে স্যালুট দাও। তুমি এখন সেনাবাহিনী প্রধানের কক্ষে প্রবেশ করছ। পরদিন জিয়া প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন- আজ থেকে আমি সেনাবাহিনী প্রধান। সকলকে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
 
বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী জিয়া
 
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর সকাল ৬টায় কর্নেল রশিদ তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায় যান। শাফায়াতের কাছে সব শুনে বিচলিত না হয়ে জিয়া বলেন, ‘সো হোয়াট, প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। গেট ইয়োর ট্রুপস রেডি। আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন।’ অর্থাৎ (রাষ্ট্রপতি মারা গেছেন, তাতে কী হয়েছে, উপরাষ্ট্রপতি আছেন। সৈন্যদের প্রস্তুত রাখো, সংবিধান অনুসারে চলো।)

৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি শপথ নেন। এরপরে বেতার ও টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ন্যূনতম সময়ের মধ্যে অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।’

এরপর জিয়া, ওসমানী, খলিল, তাওয়াব, এমএইচ খান, মাহবুব আলম চাষী ও আবু তাহের সভায় বসেন। সেখানে দেশের শাসন কাঠামো নিয়ে কথা হয়। সেখানে বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও তাকে উপপ্রধান আইন প্রশাসক হিসেবে থেকে যেতে হলো।

যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচন করার সুযোগ
পঁচাত্তরের নভেম্বরে শুধু শাসকই বদল হয়নি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তিতেও পরিবর্তন চলে আসে। পঁচাত্তরের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি সায়েমের নামে সামরিক আইনের দ্বিতীয় ফরমানের তৃতীয় সংশোধনী আদেশ জারি করা হয়েছে। এতে বলা ছিল, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোনো অপরাধে দণ্ডিত হলে তিনি সংসদে নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন।

রাষ্ট্রপতির আদেশে এ উপধারাটি বাতিল হওয়ায় দালাল আইনে অভিযুক্ত একাত্তরের পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগীদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকল না। নির্বাচন দেয়া হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসবে সেই আশঙ্কা থেকে বিচারপতি সায়েমকে দিয়ে নির্বাচন স্থগিত করার ঘোষণা দেন জিয়া। ১৯৭৬ সালের ২১ নভেম্বর বেতার ও টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে সংসদ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন রাষ্ট্রপতি সায়েম। নির্বাচন স্থগিতের ঘোষণা জারির এক সপ্তাহের মধ্যেই জিয়া প্রেসিডেন্টের ডানা ছেঁটে দেন।

জিয়ার অভ্যুত্থান মঞ্চায়ন
মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘বিএনপি: সময়-অসময়’ বইয়ে লিখেছেন, ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর রাতে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন। তখন এটিকে রক্তপাতহীন বিপ্লব বলা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ২৮ নভেম্বর ঢাকার বঙ্গভবনে এই নাটকের পুনর্মঞ্চায়ন হয়েছে।

জিয়া উপলব্ধি করেন, বিচারপতি সায়েম একাধারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকলেও তার জন্য এটি বিপজ্জনক হতে পারে। রাষ্ট্রপতি সায়েম নির্বাচন দিলে জিয়ার আকাঙ্ক্ষা মাটিতে মিশে যাবে। তখন জিয়াকে সরিয়ে অন্য কাউকে সায়েম সেনাপ্রধান নিয়োগ দিতে পারে বলেও কথা শোনা যাচ্ছিল।

এরপর ২৮ নভেম্বর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে বঙ্গভবনে যান। রাষ্ট্রপতিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে বলেন জিয়া। কিন্তু তাতে রাজি হননি সায়েম। পরে রাত একটায় রণভঙ্গ দিলেন সায়েম। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তরের কাগজে সই করেন তিনি। এরমধ্য দিয়ে মধ্যরাতে আরেকটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বরে জারি হলো সামরিক আইনের তৃতীয় ফরমান।

জিয়ার হাতে সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণ
দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন জিয়া সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করান। মোশতাককে গ্রেফতারের বিষয়টি রাষ্ট্রপতি সায়েম জানতেন না। তাকে না জানিয়ে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতিকে কেন গ্রেফতার করা হলো, সায়েমের এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, ‘স্যার, এটা ঘটে গেছে। প্লিজ, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবেন না।’

এরমধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে যারা জিয়ার জন্য অস্বস্তি তৈরি করতে চান, তাদের চুপ হয়ে যাওয়ার বার্তা দেয়া হয়। সায়েম নামেমাত্র রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। এরপর তাকে পুরোপুরি ছাঁটাই করে দিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেন সায়েম। রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ পান জিয়া। জিয়াউর রহমান একাধারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস আরও লিখেছেন, সেদিন বঙ্গভবনে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল যাতে মনে হতে পারে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে জোরপূর্বক রাষ্ট্রপতি সায়েমকে ক্ষমতাচ্যুত করেন জিয়া।

জিয়াউর রহমান তার কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছেন- এ নিয়ে অসন্তুষ্টি গোপন রাখেননি বিচারপতি সায়েম। তিনি লিখেছেন, “কীভাবে সেনাপ্রধান (মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান) একটি স্থায়ী সার্ভিসের অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে স্থল, নৌ ও বিমান- তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেকটির ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এ সব পদে জেনারেল ইয়াহিয়া বহাল ছিলেন বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তি ও বিজয় না হওয়া পর্যন্ত।”
সূত্র: বিএনপির সময়-অসময়, মহিউদ্দিন আহমেদ; বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি, বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
উত্তরণবার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK