শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৭:১১
ব্রেকিং নিউজ

মানসিক স্বাস্থ্য কিভাবে আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে

মানসিক স্বাস্থ্য কিভাবে আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
গত ১০ অক্টোবর সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হল মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সারা বিশ্বে মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। মহামারিকালের বিধিনিষেধে মানসিক স্বাস্থ্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
 
বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ২০২১ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশে বয়স্কদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ কোন না কোন সময় মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। দেশের জনসংখ্যার হিসাবে এই সংখ্যা তিন কোটির বেশি।
 
সাধারণভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বলতে আমরা বুঝি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য তা মেনে চলা। মানসিক রোগের লক্ষণ জানা, চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া ও প্রয়োজনে সঠিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করাও মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা।
 
যখন একজন মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তখন সে একজন মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হয়। যদি সমস্যাটা হয় শারীরিক তাহ’লে সে যাবে একজন ডাক্তারের কাছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে দু’টি সমস্যাই অসম্পর্কিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে দার্শনিক রেনে দেকার্ট বলেছিলেন মন এবং শরীর, এরা সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি সত্তা। যদিও এই দ্বিবিভাজিত চিন্তাধারা আধুনিক বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছে, অতি সাম্প্রতিক কালের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি থেকে আমরা জানতে পারছি যে মন এবং শরীর মোটেও  দ্বিবিভাজিত নয়। বিশেষ করে একজন রোগীর সুষ্ঠু চিকিৎসার জন্য এই দু’টির সম্পর্কের দিকে অবশ্যই মনোযোগ দিতে হবে।
 
স্নায়ুবিজ্ঞানী এন্তোনীও দামাসিও তাঁর বই "Descartes' error" -এ প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে আমাদের মস্তিষ্ক, মেজাজ, এবং বিবেচনা এসবকিছুই একে অপরের সাথে প্রবলভাবে বিজড়িত। 
 
মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারিরীক স্বাস্থ্যের সম্পর্কের সবচেয়ে পরিষ্কার উদাহরণ হচ্ছে আয়ু। অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে স্কিৎযোফ্রেনিয়া (schizophrenia) এবং বিষণ্ণতাগ্রস্ত (depression) রোগীদের আয়ু হয়  স্বাভাবিক মানুষদের তুলনায় কম। কোন কোন গবেষকের মতে এর কারণ মানসিক রোগীরা শারীরিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখে না বা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না এবং এসব রোগীদের থাকে বিভিন্ন ধরনের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস যেমন, ধূমপান, মদ্যপান, ড্রাগ সেবন ইত্যাদি। কিন্তু, এছাড়াও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের আয়ু স্বল্প হওয়ার পেছনে অন্যান্য অনেক কারণ আছে।
 
২০১২ সালে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা আশাবাদী মনোভাব এবং এবং হৃদরোগ ও হৃদরোগের অগ্রগতির মধ্যে এক যোগসূত্র খুঁজে পায়।     
 
“নেতিবাচক চিন্তার অনুপস্থিতি আর ইতিবাচক চিন্তার উপস্থিতি এক জিনিষ নয়। গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি যে আশাবাদী মনোভাব, জীবনের সন্থুষ্টি এবং সুখের সাথে হৃদরোগের ঝুঁকি কম হওয়ার একটি যোগসূত্র আছে, এবং একজন মানুষের বয়স, ওজন, ধূমপানের অভ্যাস এবং সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে এখানে কোন তারতম্য দেখা যায়নি,” বলেন গবেষণার নেত্রী জুলিয়া বোম। 
 
বোম আরো বলেন, নিরাশাবাদী মানুষদের তুলনায় আশাবাদী মানুষদের হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০% কম। নতুন একটি গবেষণায় ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া – সান ফ্রান্সিস্কো’র ঈফা ডনোভান, পি এইচ ডি, এবং তাঁর সহকর্মী আন্ড্রিয়া নাইলস, পি এইচ ডি, শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের প্রভাব পরীক্ষা করতে চেষ্টা করেন।   
 
গবেষকরা ১৫,৪১৮ বৃদ্ধের (বয়স ৬৮ বছর ও তার বেশী) স্বাস্থ্য ৪ বছর ধরে পরীক্ষা করেন। তাঁদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় আমেরিকান সাইকলজিক্যাল এসোসিয়েশনের সাময়িকী “হেলথ সাইকলজি” -তে।
 
অংশগ্রহনকারীরা তাঁদের ওজন, ধূমপানের অভ্যাস, এবং অসুখ-বিসুখের তথ্য প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের জানান। সকল অংশগ্রহনকারীর মধ্যে ১৬% ছিলেন খুব বেশী মাত্রায় উদ্বিগ্ন (anxiety), ৩১% ছিলেন অতিস্থূল এবং ১৪% ছিলেন ধুমপায়ী।
 
গবেষকরা দেখতে পান যে, যারা ছিল অতি মাত্রায় উদ্বিগ্ন, তাদের স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ৬৫% বেশী, স্ট্রোকের আশঙ্কা ছিল ৬৪% বেশী এবং ৫০% বেশী সম্ভাবনা ছিল উচ্চ  রক্তচাপের। এছাড়া তাদের আর্থ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ৮৭% বেশী।   
 
কিন্তু, বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে, মানসিক রোগ ও উদ্বেগের সাথে ক্যান্সার হওয়ার কোন যোগসূত্র ছিল না। 
 
ডিপ্রেশানের কারণে যেসব সমস্যা হতে পারেঃ
  • ওজন বৃদ্ধি
  • অকারণেই হাত, পা বা জয়েন্টে ব্যথা
  • হৃদরোগ 
  • প্রদাহ
  • যৌন অক্ষমতা  
  • ঘুমের সমস্যা
  • গ্যস্ট্রিকের সমস্যা 
বিষণ্ণতা সফলভাবে নিরাময় করা সম্ভব। ঔষধ, চিকিৎসা ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে বিষণ্ণতার সাফল্যজনক নিরাময় সম্ভব। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক, উভয় সমস্যারই সমাধান সম্ভব। মনে রাখবেন, আপনি যদি বিষণ্নতায় ভুগে থাকেন, এটা শুধু আপনার একার সমস্যা নয়, আপনার বিষণ্ণতা আপনার পরিবার এবং নিকটজনের অনেক ক্ষতি করতে পারে। তাই, আপনি যদি বিষণ্ণতায় ভুগে থাকেন,  দেরী না করে শীঘ্রি একজন মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হোন।   
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK