শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১১:৩৩

একটু হাসুন : চাপচাপ বেদনা

একটু হাসুন : চাপচাপ বেদনা

উত্তরণবার্তা ডেস্ক : রবিন সাহেবের দিন-দ্যা ডে শুরুই হয় চাপ নিয়ে। বাথরুম থেকে চাপমুক্ত হয়ে এক হাতে টুথব্রাশ নিয়ে অন্য হাতে দিলেন টুথপেস্টে চাপ। বেসিনের আয়নার দিকে ঝুঁকে টুথব্রাশ দাঁতে চেপে ধরেছেন মাত্র, অমনি তেড়ে এলেন মিসেস জয়া, ‘আয়নার দিকে তাকিয়ে কী দেখো? কার কথা মনে পড়ে গেল শুনি?’ ঝট করে ঘুরে কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন রবিন সাহেব। বউ আর বস এই দুই ‘ব’-এর সঙ্গে কখনো বড় গলায় কথা বলতে হয় না। হাসি মুখে সব কথা মেনে নিতে হয়।

বাড়তি কোনো চাপ না নেয়ার বাসনায় খাবারের টেবিলে উঁকি দিলেন রবিন সাহেব। সদ্য বানানো নাশতা থেকে ধোঁয়া উঠছে। চেয়ারে বসতেই ঘড়ির দিকে নজর গেল। খেয়ে গেলে নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে। ওদিকে সকাল নয়টার পর অফিসে ঢুকলে হাজিরা খাতা আর পাওয়া যায় না। চলে যায় বসের টেবিলে। বসের রুমে গিয়ে হাজিরা খাতায় সাইন করতে যাওয়া মানেই বিরাট যন্ত্রণা!

মিনমিনিয়ে সে কথা বলতেই রান্নাঘর থেকে গরম খুন্তি হাতে ধেয়ে এলেন মিসেস জয়া, ‘সময়মতো অফিসে যাওয়ার ব্যাপারে এত চাপ? কই, অফিস শেষে বাসায় ফেরার ব্যাপারে তো এত চাপ দেখি না? আজই একটা হাজিরা খাতা আনবে। অফিস থেকে কয়টার সময় ফের, সময় লিখে সাইন করবে।’

রবিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন, খুব একটা ভুল বলেনি বউ। দুটোই তো অফিস! দুই জায়গাতেই তো অর্ডার পালন করে টিকে থাকতে হয়। পার্থক্য ছিল, বাসায় হাজিরা খাতাটা মেনটেইন করতে হতো না। এখন থেকে সে পার্থক্যটাও আর থাকবে না! আফসোস!

গরম খুন্তির কারণেই হোক কিংবা সময়মতো অফিসে ঢোকার চাপের কারণেই হোক, রবিন সাহেব নাশতা মুখে চেপে ধরে আর দেরি করলেন না। বের হয়ে পড়লেন রাস্তায়। যা আশঙ্কা করেছিলেন, রাস্তার অবস্থা ঠিক তাই। কিছুই চলছে না। বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যান সব স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকালবেলা রাস্তার দিকে তাকালেই মনে হয়, চাপাচাপিময় এ রাস্তায় কেন বের হলাম?

কোনোমতে একটা লোকাল বাসে চেপে চুপে উঠে পড়লেন রবিন সাহেব। ভেতরে ঢুকেই চাপের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে দিলেন। সিটে যারা বসে আছেন, তাদের কোল ঘেঁষে চেপে দাঁড়িয়ে আছেন এক লাইন মানুষ। সেই লাইনটাকে চেপে দ্বিতীয় কাতারে দাঁড়ানো আরেক লাইন মানুষ। নড়াচড়ার সুই পরিমাণ জায়গা না থাকলেও বাস কন্ডাক্টর চিৎকার করেই যাচ্ছে, ‘পিছান পিছান। পিছনে পুরা বাসটাই খালি!’

এরমধ্যেই এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যায় নতুন বাস ভাড়া নিয়ে। কন্ডাক্টরের কথা হলো, ডিজেলের দাম বাড়ছে, অকটেনের দাম বাড়ছে, বাড়তি ভাড়া দিতেই হবে। প্যাসেঞ্জার-প্যাসেঞ্জার ভাই-ভাই। মুহূর্তেই সব প্যাসেঞ্জার এক যোগে বাড়তি ভাড়ার বিপক্ষে অবস্থান নিল। ওদিকে কন্ডাক্টর একাই একশ। কোনোভাবেই তার সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না। ক্ষেপে গিয়ে কিছু যাত্রী গালাগালি করতে করতে গন্তব্যে নেমে যাচ্ছেন। আবার দ্বিগুণ যাত্রী চেপে চেপে সে স্থান পূর্ণ করে দিচ্ছে কন্ডাক্টর। রবিন সাহেব গেটের ধারে কাছেই ছিলেন। ভিড় বাসে ঠেলার চোটে কখন যে একেবারে পেছনের সারিতে চেপে গিয়েছিলেন, টের পাননি। বেশ কয়েক জোড়া জুতার পাড়া খেয়ে ইন করা শার্টের দুটো বোতাম খুইয়ে যখন বাস থেকে নামলেন, মুখে তখন যুদ্ধ জয়ের হাসি।

হাসি অবশ্য অফিসে ঢুকতেই মিলিয়ে গেল। আজও পনেরো মিনিট লেট। সাইন করতে বসের রুমে ঢুকতেই ভুরু কুঁচকে তাকালেন বস, ‘রবিন সাহেব, আজকের পনেরো মিনিট লেটের গল্পটা কী?’ কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবার আগেই ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বস বললেন, ‘পনেরো মিনিট আগে শেষ কবে অফিসে ঢুকেছিলেন, মনে পড়ে?’

বসের চাপ খেয়ে মুখ ফুলিয়ে সিটে বসতেই পাশের চেয়ারের জামান সাহেব বললেন, ‘এত চাপ নেয়া যায়?’ জামান সাহেব হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি, যার কাছে বিশ্বের সব খবর এসে আশ্রয় নেয়। যে খবর এখন পর্যন্ত কোনো মিডিয়ায় আসেনি, সেটাও জানেন তিনি।

ব্যক্তিগত অপমানের মোক্ষম একটা জবাব দেয়ার জন্য রবিন সাহেব ঝট করে তাকাতেই জামান সাহেব বললেন, ‘রাশিয়া কীভাবে ইউক্রেনকে চেপে ধরেছে দেখেছেন? যার প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভারত যে যাকে যেভাবে পারছে চেপে ধরছে। সে চাপের ঠেলায় বিশ্বজুড়ে চলছে মুদ্রাস্ফীতি। ডলার তার কলার উঁচিয়ে গোটা পৃথিবীকে ইচ্ছামতো চাপছে। চাপের ভাপে শ্রীলংকা আজ দেউলিয়া। আরও কত দেশ দেউলিয়া ঘোষণা দেওয়ার পাইপ লাইনে-ওদের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমাদের দেশের অবস্থা দেখেন। প্রায় প্রতিটা জিনিসের দাম বেড়েছে। বাড়েনি শুধু আয়। তাই বলছিলাম, এত চাপ নেয়া যায়?’

মনে চাপ নিয়ে টেবিলের ফাইলের চাপে ডুবে গেলেন রবিন সাহেব। অফিস শেষে বাজার নিয়ে ঘরে ঢুকতেই বাজার দেখে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলেন জয়া, ‘পচা মাছ আর পচা তরকারি ছাড়া ভালো কিছুই কি তোমার চোখে ধরা পড়ে না?’ বউয়ের কথা শুনে রবিন সাহেব টিভির রিমোট চেপে সাউন্ড বাড়িয়ে দিলেন। সব কথা শুনতে নেই। শুনতে গেলে এক ‘আনো’ শব্দ দিয়েই জীবন কয়লা বানিয়ে ফেলবে। চাল আনো, ডাল আনো দিয়ে আনাআনি শুরু, এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। চাপ আর চাপ। না চাইলেও প্রচণ্ড চাপের মধ্য দিয়েই কাটাতে হয় প্রতিটা দিন। রবিন সাহেবের রাত-দ্য নাইট এর সমাপ্তিও হয় চাপচাপ বেদনা নিয়ে। চাপ নাকি হিরা তৈরি করে। একদিন হিরা হয়ে যাওয়ার আশায় নাক ডাকতে শুরু করলেন রবিন সাহেব।
উত্তরণবার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK