রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৩:৪৫

গোটা শস্য বা হোল গ্রেন কেন খাবেন? উপকারিতাগুলো জেনে নিন

গোটা শস্য বা হোল গ্রেন কেন খাবেন? উপকারিতাগুলো জেনে নিন

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
 
পৃথিবীর মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে গোটা শস্য বা হোল গ্রেন খেয়ে আসছে। গোটা শস্য খেলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে। অন্যদিকে পরিশোধিত শস্য, যেমন সাদা চাল খেলে স্থূলতা, প্রদাহ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। 
 
গোটা শস্য কি?
গোটা শস্য হচ্ছে অপরিশোধিত শস্য। গোটা শস্যের আছে ৩টি স্তরঃ ব্র্যান, এন্ডোস্পার্ম এবং জার্ম। উদাহরণস্বরূপ, ধানের তুষ ফেলে দেয়ার পর যে স্তরটা থাকে তাকে বলা হয় ব্র্যান মাঝখানের সাদা অংশকে বলা হয় এন্ডোস্পার্ম এবং এন্ডস্পার্মের ভেতরে ছোট একটি অংশকে বলা হয় জার্ম।
ব্র্যান-এ আছে ফাইবার, বি ভিটামিন, খনিজ।
এন্ডোস্পার্ম-এ আছে শর্করা, প্রোটিন। এটা শক্তি দেয়।
জার্ম-এ আছে প্রচুর পরিপোষক যেমন এন্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ই, বি ভিটামিন, এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাট।
পরিশোধিত চাল বা সাদা চালে এন্ডোস্পার্ম ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তাই এই চাল মোটেই পুষ্টিকর নয়।
গোটা শস্যের কিছু উদাহরণঃ
  • গম
  • বাজরা
  • ভুট্টা
  • যব
  • ওট
  • পপকর্ন
  • কিনোয়া
  • বাদামি চাল
  • লাল চাল
  • রাই
  • ওয়াইল্ড রাইস
  • বাকহুইট
  • বার্লি
  • আমড়ার বীজ বা আমারান্থ

গোটা শস্যের উপকারিতা

১। গোটা শস্যে আছে প্রচুর পরিপোষক ও ফাইবার
গোটা শস্যে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় পরিপোষক যেমনঃ
ফাইবার. গোটা শস্যের বেশীরভাগ ফাইবার বা আঁশ আসে এর ব্র্যান থেকে।
ভিটামিন. গোটা শস্যে আছে বেশী পরিমাণে বি ভিটামিন যেমন, নায়াসিন, থায়ামিন, এবং ফোলেট।
খনিজ. গোটা শস্যে আছে অনেক খনিজ বা মিনারেল, যেমন জিঙ্ক, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, এবং ম্যাঙ্গানিজ।
প্রোটিন. গোটা শস্যের প্রতি সার্ভিং এ আপনি পাবেন বেশ কয়েক গ্রাম প্রোটিন
এন্টিঅক্সিডেন্ট. গোটা শস্যের বেশ কিছু উপাদান এন্টিঅক্সিডেন্টের কাজ করে যেমন ফাইটিক এসিড, লিগন্যান, ফেরুলিক এসিড, এবং সালফার কম্পাউন্ড।
উদ্ভিজ্জ উপাদান. গোটা শস্যে আছে বেশ কয়েক প্রকারের উদ্ভিজ্জ উপাদান যেমন পলিফেনল, স্ট্যানল, এবং স্টেরল। এইসব উপাদান শরীরকে বিভিন্ন রোগ থেকে দূরে রাখে।
 
২। গোটা শস্য হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
গোটা শস্যের অন্যতম উপকারিতা হচ্ছে এর হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো। ১০টি গবেষণার একটি রিভিউতে দেখা গেছে, প্রতিদিন ২৮ গ্রাম গোটা শস্য খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি ২২% কমে। 
একই সাথে ১৭,৪২৪ জন মানুষের উপর ১০ বছর ব্যাপি চালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা তাদের শর্করার বেশীরভাগ খেয়েছেন গোটা শস্যের খাবার থেকে তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি ৪৭% কমেছে।
তাই গবেষকরা বলেন, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হলে বেশী বেশী গোটা শস্য খেতে হবে এবং পরিশোধিত শস্য, যেমন সাদা চাল বা সাদা ময়দা, খেতে হবে খুবই কম পরিমাণে।
 
৩। স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় গোটা শস্য
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে গোটা শস্য স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। আড়াই লক্ষ মানুষের উপর চালিত ৬টি গবেষণার একটি বিশ্লেষণে দেখা যায় যারা সবচেয়ে বেশী গোটা শস্য খেয়েছেন তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি ছিল সবচেয়ে কম গোটা শস্য খাওয়া মানুষদের তুলনায় ১৪% কম। এছাড়া গোটা শস্যে থাকা ফাইবার, ভিটামিন কে, এবং এন্টিঅক্সিডেন্টও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। ড্যাশ (DASH) ডায়েট ও মেডিটেরেনিয়ান ডায়েটে গোটা শস্য খেতে বলা হয়।
 
৪। স্থূলতার ঝুঁকি কমায়
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খুব দ্রুত আপনার পেট ভরে ফেলবে, ফলে আপনি অতিরিক্ত খাবার খাবেন না। এই কারণেই ওজন কমাতে বিশেষজ্ঞরা ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে বলেন। গোটা শস্য দিয়ে প্রস্তুত খাবার পরিশোধিত খাবারের চেয়ে দ্রুত পেট ভরা রাখে এবং স্থূলতার ঝুঁকি কমায়। ১২০,০০০ মানুষের উপর চালিত ১৫টি গবেষণার পর্যালোচনায় দেখা গেছে প্রতিদিন ৩ বার গোটা শস্যের খাবার খেলে পেটের মেদ এবং বডি ম্যাস ইন্ডেক্স (বিএমআই) কমে।
 
৫। গোটা শস্য টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়
পরিশোধিত শস্যের পরিবর্তে গোটা শস্য খেলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। ১৬টি গবেষণার একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে পরিশোধিত খাবার বাদ দিয়ে দিনে ২ বার গোটা শস্য খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। অন্যান্য অনেক গবেষণায় দেখা গেছে গোটা শস্য খেলে ফাস্টিং ব্লাড সুগার কমে ও ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি ভাল হয়।
 
৬। হজমে সহায়ক গোটা শস্য
গোটা শস্যে থাকা ফাইবার হজম ভাল হতে সহায়তা করে। প্রথমত ফাইবার মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। দ্বিতীয়ত কিছু কিছু ফাইবার প্রিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। এর মানে এসব ফাইবার অন্ত্রের ভাল ব্যাক্টেরিয়ার খাবার দেয়, যা ভাল হজমে সহায়ক।
 
৭। প্রদাহ কমায় গোটা শস্য
বিভিন্ন ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি রোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রদাহ। গবেষণায় দেখা গেছে গোটা শস্য প্রদাহ কমাতে সহায়ক। একটি গবেষণায় দেখ গেছে যেসব নারী সবচেয়ে বেশী গোটা শস্য খেয়েছেন, তাদের ক্রনিক রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল খুবই কম। এছাড়া অসংখ্য আরও গবেষণায় ক্রনিক রোগ দূর করতে গোটা শস্যের উপকারিতা ধরা পড়েছে।
 
৮। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় গোটা শস্য
গবেষণায় দেখা গেছে গোটা শস্য মলাশয় ক্যান্সার (কোলন ক্যান্সার) এর ঝুঁকি কমায়। এছাড়া গোটা শস্যে আছে প্রচুর ফাইবার, যা প্রেবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। গোটা শস্যের অন্যান্য উপাদান ফাইটিক এসিড, ফেনোলিক এসিড, এবং স্যাপোনিন ক্যান্সারের বিকাশ ধীর করে।
 
৯। গোটা শস্য অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি কমায়
যদি ক্রনিক রোগে আপনার মৃত্যুর ঝুঁকি কমে তাহলে একই সাথে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিও কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছ গোটা শস্য খেলে হৃদরোগ বা অন্য যে কোন রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে। গবেষণা মতে প্রতি ২৮ গ্রাম গোটা শস্য খাওয়ার সাথে মৃত্যু ঝুঁকি ৫% কমে।
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK