সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
ক্লান্তি দূর করতে আমরা সবসময় কাপের পর কাপ চা অথবা কফি পান করে থাকি। চিনি এবং ক্যাফিন আপনাকে দিবে বিমানের মত দ্রুত গতি, কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হ’তে পারে বিমানের ক্র্যাশ ল্যান্ডিং। কিছু খাদ্য আছে যা প্রাকৃতিকভাবে ক্লান্তি দূর করবে আর আপনার ক্লান্ত শরীরে দিবে শক্তি। তাই আপনি যদি দীর্ঘস্থায়ী এনার্জি চান তাহ’লে বেছে নিন জটিল শর্করা (complex carbohydrate), আমিষ (protein), এবং আঁশযুক্ত (fiber) খাবার। নীচের তালিকার ১০টি খাবার ও পানীয় আপনার ক্লান্তি দূর করতে সহায়তা করবে।
১। পানি
যদি কখনো ক্লান্তবোধ করেন, চেষ্টা করুন বেশী বেশী পানি পান করতে। আপনার ক্লান্তির কারণ হ’তে পারে শরীরের নির্জলতা (dehydration). এই নিরূদন আপনাকে দিতে পারে মাথা ব্যথা, নষ্ট করতে পার আপনার মনোযোগ, এবং আপনার মেজাজকে করতে পারে খিটখিটে, তাই বেশী বেশী পানি পান করুন।
২। ডিম
দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হচ্ছে নাশতা এবং ডিমকে বলা হয় নাশতার তারকা। ডিমে আছে যে কোন খাদ্যের তুলনায় সবচেয়ে পরপূর্ণ রূপের আমিষ। ডিম থেকে আপনি পাচ্ছেন দিনের প্রয়োজনীয় আমিষের ৩০% ভাগ। ডিমে আরো আছে এমিনো এসিড যা আপনার দেহ মাংসপেশী পুনঃনির্মাণের কাজে ব্যবহার করে। ডিমে আছে প্রচুর পরিমাণে ভাইটামিন বি, যা আপনার শরীর কাজে লাগায় খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করতে।
৩। কলা
একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা কলার সাথে শর্করাযুক্ত স্পোর্টস ড্রিঙ্ক এর তুলনা করেন। তাঁরা দেখতে পান কলা সাইকেল চালকদের শর্করাযুক্ত স্পোর্টস ড্রিঙ্কের সমাপরিমাণ শক্তি দেয়। কারণ? কারণ কলায় আছে, পটাশিয়াম, আঁশ, ভাইটামিন এবং সঠিক পরিমাণ শর্করা যা আপনাকে প্রাকৃতিকভাবে দিতে পারে শক্তি। এছাড়া কলা হচ্ছে সস্তায় শক্তি জোগানোর জন্য একটি উপযুক্ত খাদ্য।
৪। গ্রীন টি
গ্রীন টি’র উপকারিতার কথা আমরা সবাই জানি। গ্রীন টি’তে ক্যাফিন থাকলেও এতে আছে এল থিয়ানিন (L-theanine), যা আপনাকে দিবে শক্তি কিন্তু আপনার স্নায়ুকে করবে না দুর্বল। বোনাসঃ গবেষণায় দেখা গেছে গ্রীন টি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়। তাই আপনি যখন আপনি অফিসের কাজে ক্লান্ত অনুভব করেন, তখন এক কাপ গ্রীন টি পান ক’রে দেখুন কাজে লাগে কিনা।.
৫। ওট্মিল
ওট্মিল শুধু নাশতা হিসেবে নয়, দিনের যে কোন সময় আপনি খেতে পারেন এবং এটা আপনার শক্তি বর্ধনে সহায়তা করবে। কারণ, এতে আছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ ও পর্যাপ্ত পরিমাণে আমিষ। এছাড়া ওট্মিল ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। মনে রাখতে হবে, ইন্সট্যান্ট ওট্মিলে আছে প্রচুর পরিমাণে চিনি ও লবন, তাই ইন্সট্যান্টের পরিবর্তে নর্মাল ওট্মিল স্বাস্থ্যসম্মত। দুধে ওট্মিল মিশিয়ে তাতে কিছু মধু এবং কলা যোগ করলে সেটা আরো বেশী শক্তি যোগাতে সহায়তা করবে।
৬। বাদাম
বাদাম শুধু যে সুস্বাদু তাই নয়, এতে আছে অনেক পুষ্টি যা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল এবং একই সাথে ক্লান্তি দূর করতে সহায়তা করে। বাদামের পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (polyunsaturated fat) শরীরে শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। বিভিন্ন ধরনের বাদাম যেমন, চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম, ইত্যাদিতে আছে প্রচুর আমিষ, যা চর্বি ও শর্করা থেকে উৎপন্ন শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাদামে থকা এমিনো এসিড মগজের নিউরোট্র্যান্সমিটারের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং মেজাজ ভাল রাখতে এবং শরীরকে সজাক রাখতে সাহায্য করে।
৭। ডাল এবং বীন
ক্লান্ত অনুভব করার অন্যতম কারণ হচ্ছে শরীরে আয়রনের অভাব। আয়রন রেড ব্লাড সেলের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেন পরিবহণ করতে সাহায্য করে, তাই আয়রণ কমে গেলে আমরা ক্লান্ত বোধ করি। বীন ও ডালে আছে প্রচুর আয়রন। এক কাপ মুসুরের ডালে আছে ৬.৬ মিলিগ্র্যাম আয়রন। এছাড়া ডাল এবং বীনে আছে শর্করা, আমিষ ও আঁশ। আমিষ পেট ভরা রাখে, শর্করা দেয় শক্তি আর আঁশ রক্তের চিনি (blood sugar) নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া এই খাদ্যগুলিতে আছে প্রচুর ভাইটামিন সি, যা শরীরের আয়রন শোষণ করতে সহায়তা করে।
৮। পালং শাক
পালং শাকে আছে প্রচুর আয়রন, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম। শরীরে খাদ্য থেকে শক্তি রূপান্তরের শেষ ধাপে আছে একটি মলিকিউল যার নাম এডিনোসিন ট্রাইফসফেইট (adenosine triphosphate)। ম্যাগনেশিয়াম এডিনোসিন ট্রাইফসফেইট উৎপাদনে সহায়তা করে। প্রতিদিন নিয়মিত ম্যাগনেশিয়ামযুক্ত খাবার খেলে ক্লান্তি এবং শারিরীক দুর্বলতা দূর হবে।
৯। দই (চিনি ছাড়া বা কম চিনি)
দই এক প্রকার প্রোবায়োটিক (probiotics), যার মানে “ভাল ব্যাক্টেরিয়া”। দই খেলে অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, হজমে সহায়তা করব এবং ক্লান্তি দূর করবে।
১০। কমলা ও আনারস
কমলায় আছে প্রচুর ভাইটামিন সি, ফোলেট এবং পটাশিয়াম, যা শরীরে শক্তি যোগায় ও হৃযন্ত্রের কার্যকারিতা ভাল রাখতে সহায়তা করে। একটি কমলায় ৩৩৩ মিলিগ্র্যাম পটাশিয়াম আছে। আনারসেও আছে প্রচুর ভাইটামিন সি ও শর্করা। এছাড়া আনারসে ব্রোমিলেইন নামে একটি এনযাইম আছে যা হজমে সাহায্য করে। আনারসের শর্করা শক্তি দেয় ও ব্রোমিলেইন দেয় রোগমুক্তি।
ক্লান্তি দূর করার অন্যান্য উপায়
-
ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল। ঠান্ডা পানির স্নান আপনাকে সকালে জেগে উঠতে এবং সজাগ থাকতে সাহায্য করবে। দিনের মাঝামাঝি সময়ে যদি আপনি ক্লান্ত অনুভব করেন, তাহলে চোখে-মুখে একটু ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে নিন।
-
ভিটামিন সেবন। স্বল্প নিদ্রা ক্লান্তি বোধের অন্যতম কারণ। তাই আপনি যদি স্বল্প নিদ্রার কারণে ক্লান্তি বোধ করেন, তাহলে মাল্টি ভাইটামিন সেবন করতে পারেন। সেন্ট্রাম (Centrum), বেরোকা (Berocca) ইত্যাদি ভাইটামিন দিনভর আপনাকে শক্তি দিতে ও মানিসিক কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
-
সূর্যের আলো। কখনো কখনো সূর্যের রশ্মি ও সামান্য ভাইটামিন ডি আপনাকে সজাগ থাকতে এবং শক্তি যোগাতে সাহায্য করতে পারে।
-
হালকা ঘুম। হতে পারে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার কারণে আপনি ক্লান্ত বোধ করছেন। তাই যদি হয় তাহ’লে ২০-৩০ মিনিট ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করুন।
পরিশেষে
আপনি যদি প্রতিনিয়ত ক্লান্ত বোধ করেন, তাহ’লে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আপনি স্বল্প নিদ্রা বা বেশী পরিশ্রমের কারণে ক্লান্ত বোধ করতে পারেন, অথবা এটা পুষ্টিহীনতা বা অন্য কোন রোগের কারণেও হতে পারে। তাই, সব সময় ক্লান্ত বোধ করলে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক