শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৫:৩২

এখনই প্রয়োজন করোনা ভ্যাকসিন নীতিমালা

এখনই প্রয়োজন করোনা ভ্যাকসিন নীতিমালা

 কেবল বাংলাদেশ নয়, কার্যকর একটি করোনা ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে পুরো বিশ্ব। শুরু থেকেই ভ্যাকসিন নিয়ে পৃথিবী ব্যাপী কাজ হলেও এগিয়ে রয়েছে অল্প কয়েকটি দেশ। এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা চীনের একটি ভ্যাকসিনের বাংলাদেশে ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ট্রায়াল হলে বাংলাদেশ সেই ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। তাছাড়া গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ ভ্যাকসিনের আবেদন করেছে। বিশ্বে ৬০টি দেশ টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন কিনবে। আর ৯২টি দেশ বিনা পয়সায় পাবে, যার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। তবে দেশে ভ্যাকসিন আসার পর সেটা প্রথমে কারা পাবেন, কীসের ভিত্তিতে পাবেন, তাদের বাছাই করা হবে কী প্রক্রিয়াতে– এসব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এখনই এ সম্পর্কিত নীতিমালা তৈরি না করা হলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হবে।
 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য কেবল চুক্তি করে কাজ হবে না, অগ্রিম অর্থ দিয়েও ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা পাওয়ার পথ পরিষ্কার রাখতে হবে। আর এখনই নির্ধারণ করতে হবে, দেশে ভ্যাকসিন এলে কারা আগে পাবেন, কীসের ভিত্তিতে পাবেন। ভ্যাকসিন পরিবহন, স্টোরিং, পুরো দেশে পরিচালনসহ সবকিছুর নীতিমালা করতে হবে এখনই। তবে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে ফ্রন্টলাইন ফাইটার, বয়স্ক ও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত, শিশুদের প্রাধান্য দিতে হবে। একই সঙ্গে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালু করতে হবে। কারণ কারও যদি শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায় তাহলে তার ভ্যাকসিন দেওয়া অর্থহীন।
 
প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০২টি গবেষণা চলছে ভ্যাকসিন নিয়ে। তার মধ্যে এতদিন আটটি ভ্যাকসিনের গবেষণা ছিল তৃতীয় ধাপে, যার মধ্যে চার থেকে পাঁচটিকে ভ্যাকসিন হিসেবে পাওয়া যাবে। এছাড়া প্রায় ৩০টির মতো রয়েছে প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে। সব মিলিয়ে কোভিড মহামারি মোকাবিলায় নয় ধরনের ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ হচ্ছে, যার মধ্যে ছয় ধরনের ভ্যাকসিন বিশ্বের ইতিহাসে এবারই প্রথম।
 
তবে সবচেয়ে আলোচিত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল। এর তৃতীয় ও শেষ ধাপের ট্রায়ালের অংশ নেওয়া একজন স্বেচ্ছাসেবী অসুস্থ হয়ে পড়লে ট্রায়াল স্থগিত করা হয়।
 
ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে কোভিড-১৯ জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ছিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকাতে যেসব ভ্যাকসিন শেষ ধাপে রয়েছে সেসবের ট্রায়ালেও যেন বাংলাদেশ অংশ নিতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিজেই সলিডারিটি ট্রায়াল নামে একটি ট্রায়াল দেবে কয়েকটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দেখার জন্য। আর তাতে বাংলাদেশে অংশ নিতে পারে কিনা সে বিষয়েও আলোচনা চলছে।
 
গত বছরের শেষ দিকে চীনের উহানে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর এ বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তার ১০ দিন পর প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর দেয় সরকার। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (১০ আগস্ট) দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনায় মোট মারা গেলেন চার হাজার ৬৩৪ জন। আর ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৮৯২ জন এবং এখন পর্যন্ত মোট শনাক্ত হলেন তিন লাখ ৩২ হাজার ৯৭০ জন। ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ৭৪৬ জন এবং এখন পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন দুই লাখ ৩৩ হাজার ৫৫০ জন।
 
ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই বা গ্যাভি-টিকা বিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট) কাজ করছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গত ৪ জুন গ্লোবাল ভ্যাকসিন সামিটে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন এক্সেস ফ্যাসিলিটি বাকো-ভ্যাক্স’ ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে পৃথিবীর সবাই যেন সমহারে ভ্যাকসিন পায়।
 
বাংলাদেশ এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) সাবমিট করেছে গত ৯ জুলাই। কো-ভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি এবং গ্যাভি ইতোমধ্যে জানিয়েছে যে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পাবে। কিন্তু ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে উন্নত দেশ কিনে নেবে, আর আমাদের মতো মধ্যম আয়ের দেশ কো-ফাইন্যান্সিং হিসেবে যাবে। পৃথিবীর ১৭১টি দেশ এই কো-ফাইন্যান্সিংয়ের ভেতরে রয়েছে।
 
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য তারা গত তিন মাস ধরে প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইতোমধ্যে এ সম্পর্কিত গ্রাউন্ড ওয়ার্কও শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্ত একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাবনা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করে কার্যক্রম তৈরি করবে।
 
ইতোমধ্যেই জাতীয় জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটি নীতিমালা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে। গত ২৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ভ্যাকসিন ট্রায়াল চলার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ, কারা পাবেন, কীভাবে পাবেন, ভ্যাকসিন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ব্যবহার, সরবরাহ ও গবেষণা বিষয়ক নীতিমালা তৈরি করতে হবে। 
 
দেশে ভ্যাকসিন আসলে সেটা কারা কিসের ভিত্তিতে পাবেন জানতে চাওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. শাহ মুনীরের কাছে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ এবং তার ওপর ভিত্তি করে কর্মপরিকল্পনা ছাড়া ভ্যাকসিন যদি বাংলাদেশে আসে তাহলে খুব খারাপ একটা অবস্থা হয়ে যাবে। প্রতিটি মানুষ তখন এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না।’ এ বিষয়ে প্রস্তুতির জন্য এখনই উপযুক্ত সময় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা দরকার আমরা কীভাবে এটা গ্রহণ করবো, স্টোর করবো, কাদের ও কীভাবে দেওয়া হবে, কীভাবে বাছাই করা হবে। এখনই একটা “মাইক্রো প্ল্যানিং” করে ঠিক করতে হবে এ সবকিছু। এখানে অনেক বিষয় জড়িত।’
 
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে কমিউনিকেট করতে হবে ঠিকমতো। অনেকগুলো স্তরে ক্যাম্পেইন করতে হবে, যা এখন থেকেই শুরু করতে হবে। আর সরকার যদি এখনই “স্ট্র্যাটেজি রেসপন্স প্ল্যান” তৈরি না করে তাহলে ভ্যাকসিন যখন আসবে তখন এটা যদি করতে যায় তাহলে একটা হযবরল অবস্থা হবে।’
 
শুরুতে ভ্যাকসিন কারা নেবেন– মতামত জানতে চাইলে অধ্যাপক শাহ মুনীর বলেন, ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার্সরা এক্ষেত্রে এক নম্বরে থাকবেন। পরে বৃদ্ধ, অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তারপর সেটা ধাপে ধাপে এগোবে।’
 
ভ্যাকসিন বিষয়ে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা দরকার উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়ে পলিসি নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেখানে প্রথমেই বলা হয়েছে, কারা ভ্যাকসিন পাবে সেই প্রায়োরিটি ঠিক করতে হবে। একটি দেশের জনসংখ্যার শতকরা তিন শতাংশ হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা প্রথমে অগ্রাধিকার পাবে, তারপর পাবে ২০ শতাংশ ভালনারেল বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যারা রয়েছেন তারা।’
 
‘তবে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেও তালিকা করতে হবে এবং তাদের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করতে হবে।  কারণ, অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেলে তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া অর্থহীন। তবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে এখনও দেশে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা শুরু করা গেলো না। অথচ অ্যান্টিবডি পরীক্ষা ছাড়া ভ্যাকসিন নীতিমালা করা খুব কঠিন হয়ে যাবে।’ বলেন অধ্যাপক লিয়াকত আলী।
 
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘৮০০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে ভ্যাকসিন যখন তৈরি হবে, তখন তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হবে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বাংলাদেশেও ট্রায়াল হবে বা ভ্যাকসিন আসবে। তবে ভ্যাকসিন আনলেই কেবল হবে না। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সে ভ্যাকসিন কারা পাবেন, কারা কীভাবে স্টোর করবেন ইত্যাদিসহ নানা বিষয়।’
 
ভ্যাকসিন কে নিতে পারবে, কীভাবে তাদের বাছাই করা হবে? প্রশ্নে অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘এখানেই অ্যান্টিবডি টেস্ট দরকার। টেস্ট করে যদি কারও মধ্যে অ্যান্টিবডি পাওয়া যায় তাহলে তাকে আর এই ভ্যাকসিন দেওয়ার দরকার নেই, সেজন্য ভ্যাকসিন কার্যকর না। তাই এখনই এ সম্পর্কিত পলিসি এবং গাইডলাইন তৈরি করা দরকার এখনই। তাতে কারা প্রথমে ভ্যাকসিন পাবেন সেটা আইডেন্টিফাই করে নেওয়া দরকার এবং পরের ধাপ নির্ধারণ করতে হবে গাইডলাইনের মাধ্যমে।’
 
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ভ্যাকসিন নিয়ে আমরা চীন, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে সিরিয়াসলি কাজ করছি। তাদের মধ্যে যারাই চাইবে ট্রায়ালের সুযোগ দেওয়া হবে বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। এ সিদ্ধান্ত এজন্য যে, ভ্যাকসিন থেকে যেন কোথাও থেকে আমরা বঞ্চিত না হই। যে দেশই ভ্যাকসিন বিষয়ে এগিয়ে থাকবে, তাদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।’
 
কিন্তু ভ্যাকসিন আসার পর কারা পাবে, কীভাবে পাবে, বাছাই প্রক্রিয়া কী হবে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফ্রন্ট লাইনররা আগে পাবে। সরকার দেখবে অগ্রাধিকার কাদের দেওয়া হবে। ভ্যাকসিন নীতিমালার বিষয়ে টাস্কফোর্স করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে কাজ চলছে।’
 
দেশকণ্ঠ/অআ

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK