রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ২১:৫৮
ব্রেকিং নিউজ

বিজয়নগরে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘর

বিজয়নগরে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘর

উত্তরণবার্তা প্রতিবেদক : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ‘গরিবের রাজপ্রসাদ’ খ্যাত মাটির ঘর। রুচিবোধের পরিবর্তন ও পারিবারিক নিরাপত্তার কারণে এখন আর কেউ মাটির ঘরে থাকতে চান না। সচ্ছল মানুষ এখন ঝুঁকে পড়েছেন পাকা দালানের দিকেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের বাড়িতেই ছিল মাটির ঘর। কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থা আর নেই| দ্রুত বদলে গেছে ঐ পরিবেশ| উপজেলার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, আগে উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিঙ্গা, মকুন্দপুর, দাড়িয়াপুর, কামালমোড়া, সেজামোড়া, ভিটি দাউদপুর, দুরানাল ও কচুয়ামোড়া, বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর, কালাছড়া, বক্তারমোড়া, ছতরপুর ও দুলালপুর, পত্তন ইউনিয়নের আদমপুর ও শ্রীপুর, হরষপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া, পাঁচগাঁও, বাগদিয়া, হরষপুর, সোনামোড়া, বড়চাল ও মেঘশিমুল, সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের মেরাশানী, রানুর বাজার, আলীনগর ও কাঞ্চনপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে ছিল মাটির ঘর| বর্তমানে ঐসব গ্রামের হাতেগোনা কিছু বাড়িতে মাটির ঘর থাকলেও অধিকাংশ বাড়িতে নির্মিত হয়েছে দালান ঘর ও সেমিপাকা টিনের ঘর।

এলাকাবাসী জানান, উপজেলার যেসব জায়গায় লাল মাটি ও এঁটেল মাটি পাওয়া যেত সেইসব এলাকার লোকজনই বাড়িতে মাটির ঘর তৈরি করতেন। লাল মাটি ও এঁটেল মাটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে প্রথমে প্যাক করা হতো| পরে সেই প্যাক দিয়ে তৈরি করা হতো ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া দেওয়াল। প্রতি বার এক-দুই ফুট উঁচু করে দেওয়াল তৈরি করে সেই দেওয়ালকে পাঁচ-ছয় দিন রোদে শুকানো হতো। তারপর এই দেওয়াল আবারও এক-দুই ফুট উঁচু করে শুকানো হতো। এভাবে পর্যায়ক্রমে ১০-১২ ফুট উঁচু দেওয়াল নির্মাণ করা হতো। পরে এই দেওয়ালের ওপর টিনের চালা বা ছন দিয়ে চালা (ছাউনি) নির্মাণ করা হতো। প্রতিটি ঘর নির্মাণ করতে সময় লাগতো প্রায় দুই-তিন মাস| বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘরের ভেতরের দিকে ধানের তুষ (কুড়া) দিয়ে দেওয়ালের ওপর প্রলেপ দেওয়া হতো । বাইরের দিকে দেওয়া হতো চুনের প্রলেপ বা আলকাতরা । চুনের প্রলেপ দিলে ঘরের সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি পেত তেমনি ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকেও মাটির দেওয়াল রক্ষা পেত । বন্যা বা ভূমিকম্প না হলে এসব ঘর শতাধিক বছর পর্যন্ত টিকে থাকত । মাটির ঘর নির্মাণের কারিগরদের বলা হতো দেয়ালী । উপজেলার হরষপুর ইউনিয়নের নিদারাবাদ গ্রামের দেয়ালী নোয়াজ আলী জানান, মাটির ঘর তৈরি করার উপযুক্ত সময় হচ্ছে কার্তিক মাস। কারণ এই সময় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না ।তিনি বলেন, আমরা প্রতি হাত ঘর নির্মাণে ১০ টাকা করে নিতাম । আবার অনেক সময় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা চুক্তিতেও ঘর নির্মাণ করে দিতাম । তিনি বলেন, মানুষ এখন আর মাটির ঘর নির্মাণ করে না, তাই আমরা এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি।

উপজেলার বিষ্ণুপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকতার হোসেন খান বলেন, আগে আমাদের গ্রামের প্রতি বাড়িতেই মাটির ঘর ছিল । বর্তমানে মাটির ঘরের সংখ্যা খুবই কম । লাল মাটি ও এঁটেল মাটির অভাব, কারিগর সংকটের কারণে মানুষ এখন আর মাটির ঘর তৈরি করতে চায় না। তাছাড়া গ্রামের মানুষ বিদেশে গিয়ে এখন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল| তাদের রুচিবোধেরও পরিবর্তন হয়েছে| তিনি বলেন, বাড়িতে একটি দালান থাকাটা অনেকেই স্ট্যাটাসের অংশ হিসেবে মনে করেন । এ ব্যাপারে বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনিরুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, মানুষ এখন কর্মমুখী । মানুষের আয়-রোজগার বাড়ার কারণে দিনদিন শৌখিন হয়ে উঠছে । এছাড়া এলাকার প্রচুর মানুষ বিদেশ গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়েছেন। এলাকার প্রবাসীরা ও সচ্ছল ব্যক্তিরা তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে মাটির ঘরে থাকতে চায় না| এজন্য মাটির ঘর ভেঙে পাকা দালান, সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করছেন।
উত্তরণবার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK