শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৪:৪৫
ব্রেকিং নিউজ

ক্ষতি বিবেচনায় ফলের জুস কোমল পানীয়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয়

ক্ষতি বিবেচনায় ফলের জুস কোমল পানীয়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয়

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
ফলের রস স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু অনেকেই বুঝতে পারেন না যে ফলের রসেও আছে প্রচুর পরিমাণে চিনি। সত্যি কথা বলতে কি, ফলের জুসে কোমল পানীয় যেমন কোক, পেপসি, ফান্টা, ইত্যাদির প্রায় সমপরিমাণ ক্যালরি এবং চিনি আছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এতে আছে কোমল পানীয়ের চেয়েও বেশী চিনি ও ক্যালরি।
 
নিউট্রিশান (Nutrition) নামক জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায় প্রতি লিটার ফলের জুসে ফ্রুকটোয (fructose) আছে প্রায় ৪৫.৫ গ্র্যাম, আর মিষ্টি পানীয়ে আছে ৫০ গ্র্যাম। ফলের জুসে থাকা সামান্য পরিমাণে ভাইটামিন ও এন্টি অক্সিডেন্ট এতে থাকা চিনির ক্ষতি কমাতে পারে না!
 
দুঃখের ব্যপার হচ্ছে খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুতকারীরা তাঁদের পণ্যের ব্যপারে সব সময় সত্যি কথা বলেন না। আপনি সুপার শপে যে ফ্রুট জুসটি কিনছেন হতে পারে সেটা আপনি যা ভাবছেন তা নয় – যদিও লেবেলে লেখা আছে “১০০% পিওর” কিংবা “কন্সেন্ট্রেট থেকে নয়” (not from concentrate)। এখন শুনুন বিদেশী নামিদামী ব্র্যান্ডের ফলের জুস প্রস্তুতকারীরা কিভাবে জুস বানায়। ফলের রস ফল থেকে নিংড়ানোর পর রাখা হয় অক্সিজেন বিহীন হোল্ডিং ট্যাঙ্কে প্রায় এক বছর ধরে। 
 
এই প্রণালীটির আসল সমস্যা হচ্ছে যে ফলের সব ফ্লেভার এতে নষ্ট হয়ে যায়। তাই, প্রস্তুতকারীরা ফ্লেভার ফিরিয়ে আনতে এতে মেশায় “ফ্লেভার প্যাক”। তাই,আপনি যদি সবচেয়ে ভাল মানের ফ্রুট জুস কিনে থাকেন, এটা মোটেই আসল ফলের রস নয়। আর কম দামী ফলের রসকে বলতে পারেন ফ্রুট ফ্লেভার দেয়া চিনির পানি।
 
ফলের জুসে আছে ভাইটামিন, মিনারেল ও এন্টি অক্সিডেন্ট, কিন্তু এতে নেই কোন আঁশ (Fiber) এবং আছে প্রচুর পরিমাণে চিনি 
একটি উদাহরণঃ 
অরেঞ্জ জুসে আছে ভাইটামিন সি, ফোলেট, পটাশিয়াম এবং ভাইটামিন বি১২।
এতে আরো আছে এন্টি অক্সিডেন্ট।
কিন্তু, ক্যালরির পর ক্যালরি কিংবা চিনির পরিমাণের পর চিনির পরিমাণ তুলনা করলে বলতে হয় কমলার জুস আস্ত কমলার তুলনায় এমনকি অন্যান্য শাক-সব্জির তুলনায় কম পুষ্টিকর।
কেন? কারণ, ফলের জুসে নেই কোন ফাইবার, কিন্তু আছে প্রচুর চিনি।
 
নীচে দেখুন ১২ আউন্স কোক এবং আপেল জুসে কি কি উপাদান আছেঃ
কোকঃ ১৪০ ক্যালরি এবং ৪০ গ্র্যাম চিনি (১০ চা চামচ)
আপেল জুসঃ ১৬৫ ক্যালরি এবং ৩৯ গ্র্যাম চিনি (৯.৮ চা চামচ)।
এটাই হচ্ছে ফলের রসের নোংরা সত্যতা! বেশীরভাগ জুসেই আছে মিষ্টি পানীয়ের সমপরিমাণ চিনি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশী।
 
নীচের চার্টটি দেখুন (সূত্রঃ নিউট্রিশান জার্নাল)
 
 
ফলের জুস পানে অতিরিক্ত চিনি খুব সহজেই খাওয়া হয়
আমরা যখন ফল খাই তখন তা খেতে হয় চিবিয়ে তারপর গিলে। এর মধ্যে থাকা চিনি ফলের আঁশের সাথে মিশে থাকে যার ফলে হজমের সময় এটা ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যায়। শুধু তাই নয়, ফল খেলে পেট ভরে যার ফলে খুব বেশী খাওয়া যায় না। এসব কারণে ফলে থাকা চিনি খুব ধীরে ধীরে এবং কম পরিমাণে লিভারে পৌঁছে। লিভার এই চিনি অল্প অল্প করে শোষণ করে নেয়।
 
কিন্তু, আপনি যখন একটি গ্লাসে ফলের জুস পান করেন তখন এটার মানে আপনি অনেকগুলি ফল এক সাথে খাচ্ছেন এবং খাচ্ছেন ফলের আঁশ ছাড়া। জুসে থাকা প্রচুর পরিমাণে চিনি খবু দ্রুত যকৃতে পৌঁছে ঠিক আপনি যখন মিষ্টি পানীয় পান করেন সেভাবে। ফলের জুসে থাকা চিনির বেশীরভাগই ফ্রুকটোয। লিভার যখন অতিরিক্ত ফ্রুকটোয গ্রহণ করে তখন এর কিছু পরিমাণ চর্বিতে রূপান্তরিত হয়। এই চর্বির কিছু অংশ লিভারে জমা হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় ইন্সুলিন রেযিস্ট্যান্স এবং ফ্যাটি লিভার।
 
যদিও অল্প পরিমাণে ফলের জুস (কিংবা মিষ্টি পানীয়) একজন স্বাস্থ্যবান মানুষের খুব বেশী ক্ষতি করবে না, কিন্তু অতি স্থূল মানুষের জন্য এটা হতে পারে বিপদজনক! বিভিন্ন গবেষণায় ফলের রসের অপকারিতা ধরা পড়েছে। যদিও বেশীরভাগ গবেষণায় চিনি বা ফ্রুকটোয দ্বারা মিষ্টি করা পানীয় ব্যবহার করা হয়েছে, কিছু কিছু গবেষণায় ১০০% খাঁটি ফলের রসও ব্যবহার করা হয়।
 
উদাহরণঃ
একটি গবেষণায় আসল আঙ্গুরের রস ব্যবহার করা হয়। দেখা যায় প্রতিদিন ৪৮০ মিলিলিটার (১৬ আউন্স) আঙ্গুরের রস ৩ মাস ধরে পান করার পর ইন্সুলিন রেযিস্ট্যান্স হয় এবং কোমরের আয়তন বেড়ে যায়। নারীদের উপর চালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন ২ গ্লাস বা তার বেশী ফলের জুস পান করলে মহিলাদের গেঁটে বাত (gout) হওয়ার ঝুঁকি হয় দ্বিগুণ।
 
তরল ক্যালরি অতি মাত্রায় মেদ বৃদ্ধিকারী
আমাদের মস্তিষ্ক শরীরের শক্তির তারতম্য বজায় রাখে। আমরা যখন খাদ্য খাই তখন আমাদের মস্তিষ্ক আমাদেরকে অন্যান্য খাবার খাওয়া থেকে বিরত রাখে। আমরা যদি প্রতিদিন এক প্লেট ভাত খেয়ে অভ্যস্ত হই তাহলে আমরা নিজের অজান্তেই অন্যান্য খাবার খুব বেশী খাব না, যার ফলে আমাদের মোট ক্যালরি গ্রহণের পরিমান খুব একটা বৃদ্ধি পাবে না।
 
কিন্তু, তরল ক্যালরি কঠিন খাদ্য থেকে গ্রহন করা ক্যালরির মত একইভাবে কাজ করে না। যখন আপনি খাবারের সাথে কোক বা আপেল জুস যোগ করবেন তখন আপনাকে সেটা অন্য খাবার কম খেতে উদবুদ্ধ করবে না। এজন্যই মিষ্টি পানীয় অতি মাত্রায় মেদ বৃদ্ধিকারি খাদ্যের মধ্যে অন্যতম। এগুলো আপনার পেট ভরা রাখে না এবং আপনাকে অনেক বেশী খেতে প্ররোচিত করে। শিশুদের উপর চালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে মিষ্টি পানীয় তাদের অতস্থূল হওয়ার সম্ভাবণা ৬০% বৃদ্ধি করে। অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে ফ্রুট জুস অতিস্থূলতা ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায় এবং আস্ত ফল খেলে এসব ঝুঁকি কমে।
 
ফলের উপকারিতা পেতে আস্ত ফল খান এবং জুস খাবেন না
আজকাল বেশীরভাগ মানুষই খুব বেশী মাত্রায় চিনি খাচ্ছে, তাই ফলের জুসের পুষ্টির চেয়ে বেশী দরকার চিনি খাওয়া কমানো। ফলের জুস না পান ক’রে আস্ত ফল খাওয়ার অভ্যাস করুন। এর ফলে আপনি পাবেন ফলে থাকা ফাইবার, এন্টি অক্সিডেন্ত, ভাইটামিন এবং মিনারেল। খুব সামান্য পরিমাণে ফলের রস পান করা কারো কারো জন্য ঠিক হতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে ফলের জুস আর কোক, পেপসি, স্প্রাইট, ফান্টা ইত্যাদি পান করা একই কথা। সবচেয়ে আসল কথা, আপনার যকৃৎ এই পার্থক্য ধরতে পারে না, এবং কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর প্রভাব ফলের জুসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK