রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০০:৫১
ব্রেকিং নিউজ

এই খাবারগুলি অজান্তেই আপনার কিডনির ক্ষতিসাধন করছে

এই খাবারগুলি অজান্তেই আপনার কিডনির ক্ষতিসাধন করছে

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
আপনার শরীরকে স্বাভাবিকভাবে চলতে কিডনি অনেক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রক্তের বর্জ্য পদার্থ অপসারণ থেকে শুরু করে আপনার শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে কাজ করে কিডনি। এছাড়া এই আভ্যন্তরিন অঙ্গটি আপনার শরীরে লাল রক্ত কণিকা প্রস্তুতের জন্য হরমোন নিঃসরণ করতে, হাড় ভাল রাখতে এবং ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
 
খাদ্য, ঔষধ সেবন এবং পরিবেষগত বিষাক্ত পদার্থের মাধ্যমে আমরা আমাদের কিডনিকে জেনে বা না জেনে অনেক ধরনের কঠিন পরিস্থিতির সম্মুক্ষিন করি। এর ফলস্বরূপ যা হয় তা হচ্ছে কিডনি ক্যান্সার, কিডনির পাথর, কিডনি রোগ এবং কিডনি ফেইলিউর। [আরো পড়ুন ৭টি খাবার যা প্রাকৃতিকভাবে আপনার কিডনি পরিষ্কার করে। 
 
কিডনির কিছু কিছু চাপ বন্ধ করা যায় না কারণ কিডনিকে প্রাকৃতিকভাবে বানানো হয়েছে শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ অপসারণের জন্য। কিন্তু কোন অঙ্গ যখন অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়ে তখন সেটার ক্ষতি সাধন হতে পারে। আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন যে আমরা নিয়মিত খেয়ে থাকি এমন অনেক খাদ্য আছে যা আমাদের কিডনির ক্ষতি করে। তাই এই খাদ্যগুলি বেশী পরিমাণে খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। 
 
১। লবণ
লবণে আছে সোডিয়াম। কিডনি সঠিকভাবে কাজ করার জন্য আপনার শরীরে দরকার পানির ভারসাম্য বজায় রাখা, এবং সোডিয়াম ও পটাশিয়াম সম্মিলিতভাবে এই কাজ করে। কিন্তু আমাদের কেউ কেউ খাবারের সাথে অধিক পরিমাণে সোডিয়াম খেয়ে থাকি। এই সোডিয়াম সবচেয়ে বেশী থাকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে। 
 
শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে গেলে কিডনি শরীরের পানি নির্গত না করে তা শরীরেই রেখে দেয় কারণ আপনার কিডনি তখন শরীরের লবণ গলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটা আপনার কিডনির উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করে। দীর্ঘ সময় ধরে বেশী পরিমাণে লবণ খেলে তা ব্লাড প্রেশার বাড়ায় এবং কিডনির নেফরনের (nephrons) ক্ষতিসাধন করে। নেফরন কিডনির বর্জ্য অপসারণের কাজে সহায়তা করে। তাই লবণজাত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন এবং সবসময় ফ্রেশ খাদ্য খেতে চেষ্টা করুন।
 
২। এনার্জি ড্রিঙ্কস
এনার্জি ড্রিঙ্কস এখন যত্রতত্র পাওয়া যাচ্ছে এবং এটা অল্প বয়স্কদের মধ্যে ব্যপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এনার্জি ড্রিঙ্কস নামের এই পানীয় এনার্জি হয়ত দিচ্ছে কিন্তু অন্যদিকে এটা কিডনরিও ক্ষতিসাধন করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে এনার্জি ড্রিঙ্কস শুধু কিডনিরই ক্ষতি করে না, এটা মানসিক স্বাস্থ্যহানি ঘটায় এবং মানুষকে আসক্তির দিকে ঠেলে দেয়।
 
এনার্জি ড্রিঙ্কস দাঁতের ক্ষতিসাধন করে, ঘুম নষ্ট করে এবং ওজন বৃদ্ধি করে। ফ্রন্টিয়ার্স অফ পাবলিক হেলথ নামক জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয় শুধু ক্যাফিন ও চিনিই নয়, এনার্জি ড্রিঙ্কসে থাকা অন্যান্য উপাদানও কিডনির ক্ষতি করে। গবেষকরা বিভিন্ন দেশের সরকারকে এনার্জি ড্রিঙ্কস পানের উপর আইন প্রয়োগের তাগিদ দেন।
 
৩। ক্যাফিন
ক্যাফিন একটি উদ্দীপক এলকালয়েড। এটা চা, কফি, কোক, পেপসি ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। এটা এই পানীয়গুলির উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। তাই তো ক্লান্তি ও ঝিমুনিতে চা বা কফি পান শরীরকে চাঙ্গা করে তোলে। ক্যাফিন পাকস্থলী হতে রক্তে প্যারাসিটামলের শোষণ বাড়ায়। [আরো পড়ুন এই ৭টি খাবার প্রাকৃতিক ভাবে লিভার পরিশোধন করে।
 
তবে মনে রাখতে হবে যে কফি, আপনার যদি কিডনির সমস্যা থেকে থাকে তাহলে কফি, চা বা কোমল পানীয় আপনার কিডনির ক্ষতি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে দীর্ঘ সময় ধরে ক্যাফিন খেলে তা কিডনির সমস্যা আরো খারাপ করতে পারে এবং কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
 
ক্যাফিন এক ধরনের মূত্রবর্ধক (diuretic) যা কিডনির পানি শোষণের ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে। অল্প পরিমাণে ক্যাফিন গ্রহন হয়তো কিডনির কোন ক্ষতি করবে না তবে বেশী পরিমাণে হলে তা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া ক্যাফিন রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি করে যার ফলে এটা ব্লাড প্রেশার বাড়াতে পারে। তাই আপনার ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক থাকলে ক্যাফিন সম্বন্ধে চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই কিন্তু হাই ব্লাড প্রেশার হলে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
 
৪। কোমল পানীয়
কোমল পানীয় আছে অতিমাত্রায় চিনি। এছাড়া এতে থাকা অতিরিক্ত ফসফরিক এসিড কিডনী্তে পাথর সহ কিডনীতে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষতঃ যদি প্রতিদিন ২ বা তার বেশী কোমল পানীয় পান করা হয়, সেটা আরো বেশী ক্ষতিকর। কোক, স্প্রাইট, ফান্টা, ইত্যাদি কিডনি রোগ ছাড়াও লিভারের অনেক ক্ষতি করে।
 
৫। গো-মাংস
গো-মাংসে আছে প্রচুর প্রোটিন বা আমিষ। প্রোটিন সুসাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু গো-মাংসের আমিষ বিপাক করা কিডনির জন্য হয়ে পড়ে একটা কঠিন কাজ। খাদ্যে অধিক পরিমাণে গো-মাংস থাকলে তা কিডনির পাথরের ঝুঁকিও বাড়ায়। এর ফলে যাদের কিডনির রোগ আছে তাদের উচিৎ বেশী পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ না করা।
 
এছাড়া অঙ্গজাত মাংস যেমন গরুর কলিজায় আছে প্রচুর পরিমাণে পিউরিন (purine)। পিউরিন শরীরে ইউরিক এসিড উৎপাদন বৃদ্ধি করে। ইউরিক এসিড হচ্ছে এক ধরনের বর্জ্য যা কিডনি পরিশোধন করে। তাই শরীরে বেশী ইউরিক এসিড হলে তা কিডনির পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
 
৬। জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য
গবেষণায় দেখা গেছে জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম (জিএমও) স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে কিডনি নষ্ট করতে পারে।
 
৭। প্রক্রিয়াজাত খাবার
প্রক্রিয়াজাত খাবার খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং এগুলো কিডনি রোগসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রক্রিয়াজাত মাংসে আছে প্রচুর লবণ এবং এগুলো শুকিয়ে ক্যানে ভরা হয়। এসব খাবারের স্বাদ বজায় রাখতে এতে প্রচুর লবণ দেয়া হয়, যা আপনার প্রতিদিনের লবণের চাহিদার চেয়ে অনেক বেশী। এছাড়া প্রক্রিয়াজাত খাবারে আছে অনেক বেশী প্রোটিন যা কিডনির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। প্রক্রিয়াজাত খাবারের উদাহরণঃ সসেজ, স্যান্ডুইচের মাংস, পিৎযা’র টপিং, ইত্যাদি।
 
৮। কৃত্রিম চিনি
আপনি যদি চিনি খাওয়া কমানোর জন্য কৃত্রিম চিনি, যেমন স্যাকারিনের উপর নির্ভর করেন তাহলে আপনি আপনার শরীরের ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশী করছেন। এইসব কৃত্রিম চিনি বা ডায়েট চিনি স্বাস্থ্যের জন্য অপকারি। প্রতিদিন শুধু ২ ক্যান ডায়েট কোক পান করলেও তা কিডনির ক্ষতি করতে পারে। 
 
অনেকেই চিনির পরিমাণ কমাতে চা বা সরবতে কৃত্রিম চিনি ব্যবহার করেন, কিন্তু অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যারা কৃত্রিম চিনি খান তাঁরা আসলে কম চিনি গ্রহণ করছেন না। তাই আপনার কিডনির কার্যকারিতা ঠিক রাখতে কৃত্রিম চিনি খাওয়া বন্ধ করুন।
 
পরিশেষে
কিডনি সুস্থ রাখতে সবার উচিৎ এই তালিকায় থাকা সবগুলি খাদ্যই সংযমতার সাথে গ্রহণ করা। মনে রাখবেন, আপনাকে সুস্থ রাখতে আপনার কিডনি প্রতিনিয়ত অনেক কঠিন কাজ করছে। কিডনি আপনার শরীরকে পরিশোধিত করতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, তাই আপনার উচিৎ আপনার শরীরের এই অঙ্গটির খবু ভাল যত্ন নেয়া।
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK