শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৮:১৭

এই ৫টি খাবার আপনার বার্ধক্য রোধ করবে আর আপনাকে দিবে দীর্ঘ জীবন

এই ৫টি খাবার আপনার বার্ধক্য রোধ করবে আর আপনাকে দিবে দীর্ঘ জীবন

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
ভাল খাবার খেলে স্বাস্থ্য ভাল থাকে, এই মন্ত্রটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু, কোন কোন খাবার খেলে এটা হবে? এখানে আমরা ৫ টি পুষ্টিগুণে ভরপুর স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যাপারে আলোচনা করব। আনুষ্ঠানিক ফল অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে জাপান, প্রিন্সিপালিটি অফ মনাকো এবং সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের গড় আয়ু সবচেয়ে বেশী। এই দেশের বাসিন্দারা উপভোগ করেন একটি সুন্দর জীবন এবং এর কারণ স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ।
 
কিছু কিছু খাবার আছে যা অন্যান্য খাবারের তুলনায় বেশী পুষ্টিকর, এবং গবেষণায় দেখা গেছে এসব খাবার অনেক রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। আর কিছু খাবার আছে অস্বাস্থ্যকর এবং এগুলো অনেক রোগের কারণ হতে পারে। এখানে আমার তালিকে অনুযায়ী ৫টি খাবার আপনাকে দেবে একটি সুখী, স্বাস্থ্যকর জীবন এবং আপনাকে সাহায্য করবে বার্ধক্য রোধ ক’রে বেশীদিন বেঁচে থাকতে। 
 
১। সয়বিন ও টোফু
শত শত বছর ধরে এশিয় দেশের মানুষ কাঁচা সয়বিন (Edamame) খেয়ে আসছেন। এই বীন বার্ধক্য রোধ করার জন্য বহুল পরিচিত। পশ্চিমা বিশ্বে এই খাদ্যটির জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে। সেসব দেশে সয়বিন সুপ ও অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়।
 
সয়বিনে আছে প্রচুর পরিমাণে আইসোফ্ল্যাভোন (isoflavones)। আইসোফ্ল্যাভোনের আছে এন্টিওক্সিডেন্ট ও ক্যান্সার বিধ্বংসী গুণ। তাই সয়বিন শরীরের প্রদাহ কমাতে, ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করতে, বার্ধক্য রোধ করতে ও কিছু কিছু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। টোফু হচ্ছে সয়বিন দিয়ে তৈরী পনির সদৃশ এক ধরনের খাদ্য। এটা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভাল। টোফুতে আছে অনেক স্বাস্থ্যোপকারিতা, বিশেষ করে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে টোফু বার্ধক্য রোধ করতে পারে। টোফুতে আছে ৮টি এসেনশিয়াল এমিনো এসিডের সবগুলোই এবং এটা প্রোটিনের একটা ভাল উৎস। এতে আরো আছে আয়রন, ক্যালশিয়াম, ম্যাঙ্গানিয, ফসফরাস, সেলেনিয়াম, কপার, ম্যাগনেশিয়াম, যিঙ্ক এবং ভাইটামিন বি-১। টোফু স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভাল এবং এটা হৃদরোগ ও ক্যান্সের থেকেও আপনাকে রক্ষা করতে পারে। টোফু খেলে অনেকক্ষণ পেট ভরা থাকে, তাই এটা আপনাকে বেশী খাওয়া থেকে বিরত রাখে ও ওজন কমাতে সাহায্য করে।
 
২। গাজর
গাজর বিশ্বজুড়ে খুবই জনপ্রিয় একটি সবজি। গাজরে থাকা বেটা ক্যারোটিন এবং ক্যারটিনয়েড স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর প্রায় সব সভ্যতা ও দেশের মানুষই গাজর খেয়ে আসছে। যদিও আমরা কমলা রঙের গাজর সম্বন্ধেই বেশী জানি, গাজর কিন্তু অন্যান্য রঙেরও হয় যেমন, হলুদ, বেগুনি, লাল এবং সাদা। আপনি যখন গাজর খান তখন আপনার শরীর বেটা-ক্যারোটিনকে ভাইটামিন এ-তে রূপান্তরিত করে, যা আপনার ইমিউন সিস্টেম এবং দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে। আমাদের শরীর ভাইটামিন এ উৎপাদন করে না, তাই এটা আমাদের খাদ্য থেকেই গ্রহণ করতে হয়।
 
বেটা-ক্যারোটিন হচ্ছে এক ধরনের এন্টি অক্সিডেন্ট, যা বার্ধক্য রোধ করতে শরীরের কোষগুলিকে ফ্রী র‍্যাডিক্যাল দ্বারা ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। বেটা ক্যারটিন রঞ্জক গাজরকে এর কমলা রঙ দেয়। এছাড়া ক্যারোটিনয়েডযুক্ত খাবার যেমন গাজর ম্যাকুলার ডিজেনারেশান (macular degeneration) থেকে রক্ষা করে। ম্যাকুলার ডিজেনারেশান হচ্ছে বার্ধক্যজনিত অন্ধত্ব। গাজর ত্বকও ভাল রাখে এবং দ্রুত ক্ষত সারাতে সাহায্য করে।
 
সাদা গাজর সাদা দেখায় কারণ এতে কোন বেটা ক্যারটিন নেই। কিন্তু, সব রঙের গাজরেই ফ্যালকারিনল (falcarinol) নামের পরিপোষক আছে যা ক্যান্সার থেকে শরীরকে রক্ষা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে গাজর কাঁচা খাওয়াই ভাল, তবে বিশেষ কিছু রান্নার পদ্ধতি অনুসরণ করলে গাজর রান্নার পরেও এর সব গুণাগুণ অবশিষ্ট থাকতে পারে।
 
যুক্তরাজ্যের নিউ ক্যাসল ইউনিভার্সিটির কার্স্টেন ব্র্যান্ড ফ্যালকারিনলের ক্যান্সার বিধ্বংসি গুণের ওপর গবেষণা করেন। তাঁর মতে আপনি গাজর রান্না করতে চাইলে তা সেদ্ধ করুন, এভাবে গাজরের সব গুণাগুণ থাকবে। কার্স্টেন ব্যাখ্যা করেন যে যখন আপনি গাজর টুকরো করে কাটেন তখন রান্না করলে গাজরের সব গুণাগুণ চলে যায়। কিন্তু, পুরোটাই সেদ্ধ করে পরে কাটলে এর সব গুণাগুণ অবশিষ্ট থাকে।
 
৩। ক্রুসিফেরাস সবজি
ক্রুসিফেরাস সবজি হচ্ছে ব্রকলি, ফুলকপি, বাঁধা কপি, বাক চয়, মূলা ইত্যাদি। এই সব্জিগুলো স্বাস্থ্য উপকারিতার অসংখ্য পুষ্টিগুণে ভরপুর। ক্রুসিফেরাস সবজি সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্বে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে এর ক্যান্সার বিধ্বংসি গুণাগুণের কারণে। এই সবজি গুলোর মধ্যে প্রত্যেকেরই আছে নিজ নিজ গুণাগুণ। ক্রুসিফেরাস সব্জিতে আছে প্রচুর পুষ্টিগুণ যেমন ভাইটামিন (সি, ই, কে এবং ফোলেট); মিনারেল (ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম এবং সেলেনিয়াম); ক্যারটিনয়েড (বেটা-ক্যারটিন, লুটিন, এবং যিয়ায্যান্থিন)।
 
গ্লুকোসিনোলেট (glucosinolate) উপাদান এই সব্জিকে দেয় এর কটুগন্ধ। গবেষণায় দেখা গেছে গ্লুকোসিনোলেটে আছে অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা। কিছু কিছু গ্লুকোসিনোলেট শরীরে প্রদাহ এবং চাপ কমাতে সহায়তা করে, আবার কিছু আছে যা ক্যান্সার বিধ্বংসি। কিছু নতুন গবেষণায় দেখা গেছে সবুজ শাক সবজি এবং কিছু ক্রুসিফেরাস সবজি বার্ধ্যক্যকালে স্মৃতিশক্তি অটুট রাখতে সাহায্য করে। গবেষকদের মতে প্রতিনিয়দ খাদ্যের সাথে সবুজ শাকসবজি খেলে আপনার মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ভাল থাকবে। সবশেষে ক্রুসিফেরাস সব্জিতে আছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ (soluble fiber) যা ব্লাড সুগার লেভেল স্বাভাবিক রাখতে এবং চর্বি কমাতে সহয়তা করে।
 
 
৪। স্যামন মাছ
মেডিটেরেনিয়ান ডায়েট বহু বছর ধরেই স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে পরিচিত। গবেষণায় দেখা গেছে এই খাবার বার্ধক্য রোধে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীদের মতে মেডেটেরেনিয়ান ডায়েটে প্রোটিনের সবচেয়ে ভাল উৎস হিসেবে থাকবে স্যামন এবং অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ। স্যামন মাছ স্যাস্থ্যকর আমিষ এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডে ভরপুর। ওমেগা-৩ দৃষ্টিশক্তি এবং মস্তিষ্কের জন্য ভাল। গবেষণায় দেখা গেছে এই ফ্যাটি এসিড বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রম রোধ করতে পারে। স্যামন মাছের প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম হৃদপিন্ডকে সুস্থ রাখে। স্যামন মাছের সেলেনিয়াম থাইরয়েড গ্ল্যান্ড ভাল রাখে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ড শরীরের হর্মোনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। স্যামন মাছের ওমেগা-৩ ত্বক ভাল রাখতে সাহায্য করে।
 
৫। কমলা জাতীয় ফল (Citrus fruits)
কমলা, ট্যাঞ্জারিন, গ্রেপফ্রুট, লেবু ইত্যাদিতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভাইটামিন সি। ভাইটামিন সি’র এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাবলী ইমিউন সিস্টেম ভাল রাখতে, ইনফেকশান দূর করতে এবং প্রদাহজনিত ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। সিট্রাস ফ্রুটে আরো আছে প্রচুর ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট যেমন, চিনি, আঁশ, ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, ফোলেট, ভাইটামিন বি-৬, নায়াসিন, থিয়ামিন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, রাইবোফ্ল্যাভিন, কপার এবং প্যান্টথেনিক এসিড। জাপানের ওকিনাওয়া অঞ্চলের মানুষ অনেকদিন বাঁচে। এটার কারণ হতে পারে এই অঞ্চলের লোকজন প্রতিনিয়ত শিকুওয়াসা নামের এক ধরনের সিট্রাস ফ্রূট খায়। গবেষণায় দেখা গেছে শিকুওয়াসা লিভার ভাল রাখতে সাহায্য করে।
 
পরিশেষে
যদিও এখানে উল্লেখিত ৫টি খাবারে অনেক স্বাস্থ্যকর গুণাবলী আছে, তথাপি আপনাকে মনে রাখতে হবে যে আপনি সুষম খাদ্য এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা ছাড়া স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারবেন না। এছাড়া অনেক গবেষণায় দেখা গেছে বংশগত কারণেও আমাদের আয়ু কম-বেশী হতে পারে। এই খাদ্য তালিকাটি মনে রাখুন এবং সেসব খাবার খান যা আপনার জন্য উপযোগী।
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK