রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৮:০৯
ব্রেকিং নিউজ

অনুকূল পরিবেশে প্রাণবন্ত প্রাণীরা বেড়েছে প্রজনন

অনুকূল পরিবেশে প্রাণবন্ত প্রাণীরা  বেড়েছে প্রজনন

উত্তরণ বার্তা ডেস্ক : খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আয়েশি ঘুম দিচ্ছেন সুন্দরবনের রাজা। কেউ তাকে বিরক্ত করছে না। পাশের খাঁচায় সিংহ মামা তখনো খাওয়া শেষ করতে পারেননি। হাড় থেকে মাংস ছড়ানোর যুদ্ধে লিপ্ত তিনি। গত পরশু দুপুরে  গিয়ে জাতীয় চিড়িয়াখানায় দেখা গেল এমন চিত্র। তবে মানুষের সঙ্গে খুনসুটি করে যাদের সময় পার হয়, সেই বানরগুলোকে দেখা গেল অনেকটাই মনমরা হয়ে বসে আছে। অনেকগুলো কলা ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে মাটিতে। এগুলো খেতেও যেন তাদের আগ্রহ কম। বিরক্তিহীন সময় পার করা জিরাফগুলো মানুষ দেখলেই এখন এগিয়ে আসছে। অথচ মানুষ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ তাদের। কেউ কলা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলে হাত থেকেই নিয়ে খাচ্ছে। প্রাণীগুলোর মধ্যে এখন যেন প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে।

মানুষের কোলাহলহীন চিড়িয়াখানায় এখন গাছে গাছে ঝুঁলছে কাঁঠাল, আম। এবার এগুলো চড়া দামেই বিক্রি হয়েছে। চিড়িয়াখানার কর্মী রনজু আহমেদ জানালেন, এবার চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকার কারণে আম আর কাঁঠালের ফলনও ভালো হয়েছে। কেউ চুরি করে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে না। প্রকৃতিও সতেজ। দেখা গেল, রোদ পোহাতে ওপরে আসা জলহস্তীগুলোর বাচ্চারাও মায়ের সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত। বিশাল এলাকায় ছুটে বেড়াচ্ছে হরিণের শাবকগুলো।

কর্তৃপক্ষ বলছে, কেউ বিরক্ত না করায় প্রাণীদের রোগব্যাধিও কমে গেছে। ফলে প্রজনন ক্ষমতা বেড়েছে। গত দেড় বছরে বেড়েছে প্রায় ২০০ প্রাণী। এটাকে করোনা মহামারির ‘সুফল’ হিসেবে দেখছেন জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। দর্শনার্থী না থাকায় এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে ঢেলে সাজানো হচ্ছে চিড়িয়াখানাকে। নেয়া হয়েছে মাস্টারপ্ল্যান। সেখানে ১৬ কোটি টাকার উন্নয়মূলক কাজ চলছে। সিঙ্গাপুরের আদলে চিড়িয়াখানাকে এখন অনেকটা সাফারি পার্কের রূপ দেয়া হচ্ছে। হাতিকে শেখানো হচ্ছে ফুটবল খেলা। শিশুদের জন্য তৈরি হচ্ছে পার্কের আদলে একটা প্লে জোন। লেক দুটিকে বানানো হচ্ছে নান্দনিক।

১৯৭৪ সালে শুরু হওয়া এই চিড়িয়াখানায় আগে কখনো প্রাণীরা এত নিরিবিলি থাকার সুযোগ পায়নি। ফলে বহু প্রাণীর ঘরে এসেছে নতুন অতিথি। এই অতিথিদের নিয়ে খানিকটা বিপাকেও আছে কর্তৃপক্ষ। বন্যপ্রাণী আইন মেনে হরিণ ও ময়ূর বিক্রির উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ২০ জন আবেদনও করেছেন কেনার জন্য। শুধু কি বিরক্ত না করার কারণে প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা বেড়েছে? কর্তৃপক্ষ বলছে, বিরক্ত না করার কারণে তাদের খুব একটা রোগব্যাধিও হচ্ছে না। ফলে প্রাণীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো। অনেক প্রাণী মানুষের উপস্থিতি বাচ্চা প্রসব করে না, এ সময় জিরাফও বাচ্চা দিয়েছে। দেখতে অনেকটা মুরগির বাচ্চার মতো ময়ূরের ৩৬টি বাচ্চা এখন শেডে যাওয়ার অপেক্ষায়।

বেড়েছে প্রজনন ক্ষমতা, নতুন অতিথি প্রায় ২০০ : গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে চিড়িয়াখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। সাত মাস ১০ দিন বন্ধ থাকার পর পহেলা নভেম্বর থেকে আবারও খোলা হয়। এরপর ২ এপ্রিল থেকে আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় লকডাউনে চিড়িয়াখানায় জন্ম নেয় ১১৬টি প্রাণী। এর মধ্যে জলহস্তী একটা, ইমপালা একটা, কমন ইলেন একটা, জিরাফ একটা, বানরের তিনটা বাচ্চাসহ অনেক প্রাণীর ঘরে নতুন অতিথি আসে। পরে দফায় লকডাউনে আফ্রিকান হর্স দুটা, জেব্রা দুটা, জলহস্তী একটা, ইমুপাখি ১৬টা, ৩৬টা ময়ূরের বাচ্চাসহ ৬২টি নতুন অতিথি আসে। এছাড়া প্রত্যেক সপ্তাহে দুই-তিনটা চিত্রা হরিণ জন্ম নেয়। এর মূল কারণ এখন কেউ তাদের ডিসটার্ব করে না। কোনো অসুখ নেই। যে সমস্ত বাচ্চা হচ্ছে, তার মধ্যে মৃত্যুর হার একেবারেই নগণ্য। ফলে দিন দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নতুন অতিথিদের নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।

চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. আব্দুল লতীফ বলেন, ‘লোকজনের সমাগম থাকলে প্রাণীরা বিরক্ত হয়। লোকজন না থাকায় খুব আরামে খাবার খাচ্ছে প্রাণীগুলো। ভালো খাবার পাচ্ছে, ইমিউনিটি ভালো আছে, প্রজনন ক্ষমতা অনেক বেড়েছে তাদের। গতবারের লকডাউনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এরকম পরিস্থিতিতে প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এটার ফল আমরা পাব পাঁচ থেকে ছয় মাস পর।’

বিক্রি হবে হরিণ-ময়ূর : জাতীয় চিড়িয়াখানায় হরিণ-নীল ময়ূর কিনতে এখন পর্যন্ত ২০টি আবেদন জমা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি হরিণ ও আটটি নীল ময়ূর রয়েছে। এছাড়া এসব প্রাণী কিনতে অনেকে নানাভাবে যোগাযোগ করছেন। বন্য প্রাণী লালন-পালনে বন বিভাগের অনুমোদন ও নির্ধারিত অর্থ পেলে প্রাণী হস্তান্তর করবে কর্তৃপক্ষ।

কর্তৃপক্ষ বলছে, যারা আবেদন করেছেন তাদের অধিকাংশ ক্রেতাই বাসাবাড়িতে এসব প্রাণী লালন-পালন করার জন্য কিনতে চাচ্ছেন। এছাড়াও অনেকে ফোনে যোগাযোগ করে কেনার আগ্রহের কথা বলছেন। প্রাণী কিনতে বন বিভাগের অনুমোদনসহ নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে চিড়িয়াখানায় বিক্রিযোগ্য ১৫০টি হরিণ রয়েছে। আর ময়ূরের ডিম ফুটে বাচ্চ হয়েছে ৩৬টা। সবমিলিয়ে চিড়িয়াখানার তিনটি শেডে বর্তমানে ৩৪০টি হরিণ রয়েছে। শেডগুলো অসমতল হওয়ায় ধারণক্ষমতা কম। চিড়িয়াখানার এসব শেডে সর্বসাকুল্যে ৩০০ হরিণের অবাধ বিচরণের সুযোগ রয়েছে। অথচ এখন হরিণের সংখ্যা ৩৪০টি। এ কারণে অতিরিক্তগুলো বিক্রি করা হবে।

বিক্রির জন্য নির্ধারিত হরিণ শাবকগুলোর সরকারি মূল্য প্রতিটি ৭০ হাজার টাকা। কেউ এক জোড়া কিনলে তাদের এক লাখ ৪০ হাজার টাকা দিতে হবে। যেহেতু হরিণের নিয়মিত প্রজনন হচ্ছে, তাই এখন প্রতিমাসে অন্তত ২০টি হরিণ শাবক বিক্রি করা সম্ভব। অন্যদিকে চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ৭২টি নীল ময়ূর রয়েছে। এসব ময়ূর বিক্রি করা হবে। নীল ময়ূরের জন্য পর্যাপ্ত স্থান থাকলেও বিরল প্রজাতির পাখি হওয়ায় এগুলো বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এই পাখির বিচরণ বাড়বে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব খাতে আয়ও বাড়বে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ। এক জোড়া নীল ময়ূর ৫০ হাজার টাকা অর্থাত্ প্রতিটি ২৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করা হবে।

কাজ চলছে মাস্টারপ্ল্যানের : নতুন মাস্টারপ্ল্যানে চিড়িয়াখানাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই মাস্টারপ্ল্যানের কাজ ইতিমধ্যে ৪৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ধাপে ধাপে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলবে। এই পরিকল্পনার আওতায় রাজা বাহাদুর ও সুন্দরী নামের দুইটি হাতিকে ফুটবল খেলা শেখানো হচ্ছে। এখন তারা দৌড়ে ফুটবল খেলতে পারে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী একদম জঙ্গলের অনুভূতি দিয়ে সাজানো হবে চিড়িয়াখানা। মানুষ যখন প্রাণীর খাঁচার সামনে যাবে তখন কোনো দেয়াল দেখবে না। একদম প্রাকৃতিক মনে হবে। দেয়ালের বদলে থাকবে ইলেকট্রিক ফেন্স। এগুলো এমনভাবে সাজানো থাকবে যে দেখলে মনে হবে অনেকটা জায়গা জুড়ে জঙ্গল আছে। আবার অনেক প্রাণীকে জলাধার দিয়ে পৃথক রাখা হবে।

আব্দুল লতীফ বলেন, বর্তমানে চিড়িয়াখানায় প্রাণীগুলোর এলোমেলো খাঁচাগুলো সুনির্দিষ্ট জোনভিত্তিক করা হচ্ছে। পাঁচটি জোনে থাকবে প্রাণীগুলো। সুন্দরবন কেন্দ্রিক প্রাণীগুলো থাকবে একপাশে, এর নাম হবে বাংলাদেশ হ্যাবিটেট। আফ্রিকান জঙ্গলের প্রাণী জিরাফ, জেব্রা, জলহস্তীসহ এগুলো থাকবে আরেক জোনে। এর নাম হবে আফ্রিকান হ্যাবিটেট। পিট অ্যানিমেলের আলাদা একটা জোন হবে। নিশাচর প্রাণীদের দেখানোর জন্য দর্শকদের জন্য থাকবে নাইট সাফারির ব্যবস্থা। বাচ্চাদের জন্য তৈরি হবে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক।

চিড়িয়াখানা এখন লাভজনক প্রতিষ্ঠান : চিড়িয়াখানার পরিচালক আব্দুল লতীফের দাবি, এখন কিন্তু চিড়িয়াখানা লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বাদে প্রতি বছর প্রাণীদের খাবার ও ওষুধসহ আনুষঙ্গিক কাজে ব্যয় হয় ১০ থেকে ১১ কোটি টাকার মতো। এখানে ২৬০ জনের মতো স্টাফ আছেন। তবে করোনার সময় ১৭০ জনের মতো কাজ করছেন। টিকিট বিক্রি, বাথরুম ও মিউজিয়াম থেকে আয় বাবদ এখান থেকে আসে ১১ কোটি টাকার মতো। এছাড়া হরিণ ও ময়ূর বিক্রি করেও একটা অর্থ পাওয়া যায়।

এই কর্মকর্তার মতে, এখানে শুধু দিনে নয়, রাতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রতিটি প্রাণীর খাঁচায় খেয়াল রাখতে হয়। এখানকার কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গত বুধবার চিড়িয়াখানা পরিদর্শনের সময় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলছিলেন, প্রতিনিয়তই তাদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। আগেও দুজন সহকর্মী বাঘ ও ভাল্লুকের থাবায় জীবন দিতে হয়েছে। করোনার মধ্যে চিড়িয়াখানাকে জরুরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করলে এখানে যারা কাজ করেন তাদের কিছুটা আর্থিক সুবিধা মিলত। সবাই কাজেও উত্সাহ পেতেন।

কোন প্রজাতির কত প্রাণী আছে চিড়িয়াখানায় :চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ১৩৫ প্রজাতির ৩ হাজার ১০০ এর মতো প্রাণী আছে। ১৯৭৪ সালে ১৮৬ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা দেশের সবচেয়ে বড় এই মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা। এখানে মাংসাশী আট প্রজাতির ৩৮টি প্রাণী, ১৯ প্রজাতির বৃহত্ প্রাণী (তৃণভোজী) ২৭১টি, ১৮ প্রজাতির ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ১৯৮টি প্রাণী রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ১০ প্রজাতির সরীসৃপ ৭২টি, ৫৬ প্রজাতির ১ হাজার ১৬২টি পাখি, অ্যাকুরিয়ামে রক্ষিত ১৩৬ প্রজাতির প্রায় আড়াই হাজার মত্স্য। সব মিলিয়ে রয়েছে ১৩৭টি পশুপাখির খাঁচা।

জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাঘ আছে ৯টি, সিংহ পাঁচটি, জলহস্তী ১৩টি, হরিণ ৩৪০টি, জেব্রা সাতটি, জিরাফ আছে আটটি, হাতি পাঁচটি, গণ্ডার একটি, শকুন ১৩টি, ময়ূর ৭২টি, ইমু পাখি ২৮টি, চিতাবাঘ দুইটি, ভল্লুক তিনটা ও চার প্রজাতির বানর ৬০টি।
উত্তরণ বার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK
আরও সংবাদ