রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১১:০৫
ব্রেকিং নিউজ

কাল বদলে হারাচ্ছে মধুবৃক্ষ

কাল বদলে হারাচ্ছে মধুবৃক্ষ

উত্তরণ বার্তা  প্রতিবেদক : ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে দু’মাস পরপর ঋতু বদলায়। তারই ধারাবাহিকতায় দরজায় কড়া নাড়ছে শীত। আজ থেকে দশ বছর আগেও কার্তিক মাসের শেষের দিকে হালকা শীতের আভাস পেলেই গাছিরা খেজুর গাছের ডালপালা পরিষ্কার করে রস সংগ্রহের আগাম প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এখন তা শুধুই স্মৃতি। নতুন প্রজন্মের সিংহভাগ জানেনই না খেজুরের রস বলতে কিছু আদৌ আছে। এখনও প্রকৃতিতে শীত আছে আগের মতোই, কিন্তু নেই পর্যাপ্ত খেজুর গাছ।  

শীতের আমেজে বাঙালির প্রাণের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে খেজুর রস। শীতের সকালে খেজুর রস, মিষ্টি রোদ, কৃষক-কৃষাণির মিষ্টি হাসি দারুণ প্রাণশক্তি বটে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে এসব দৃশ্য। দেখা মিলছে না আর সারি সারি খেজুর গাছের। কাকডাকা ভোরে খেজুরের রস, মন মাতানো ঘ্রাণ এ শহরে বিরল। কবির ভাষায়, ‘এমন শীতলমিষ্টি কোথা আছে নীরব? পান মাত্র তৃষিতের জুড়ায় শরীর’। তাই এ গাছকে প্রবীণদের অনেকেই ‘মধুবৃক্ষ’ বলে থাকেন।

বাংলা অগ্রহায়ণ মাস থেকে সাধারণত খেজুর রস সংগ্রহ শুরু হয় ও চলে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। তবে পৌষ ও মাঘ মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। কারণ এই দু’মাসে শীতের প্রকোপ থাকে সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া যত ঠাণ্ডা থাকে, রসও তত বেশি পাওয়া যায়। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রসও কমতে থাকে।

প্রকৃতির তৈরি চোখ জুড়ানো খেজুর গাছের সারি আর রসের হাঁড়ি প্রায় অদৃশ্যের পথে। পালাক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে দোয়েল, বুলবুলি, শালিকসহ হরেক রকম পাখিদের রস খাওয়া আর উড়াল দেয়ার দৃশ্য। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে মৌমাছিদের রস খাওয়ার আশায় ভোঁ ভোঁ করে উড়ে বেড়ানো। একসময় গ্রামীণ জনপদে খেজুর রসের পায়েস পিঠার উৎসব, রাত জেগে পায়েস রেঁধে খাবার উৎসব, গভীর রাতে গাছে গাছে ঝুলে খেজুরের রস খাওয়াসহ অনেকের জীবনে চুরি করে রস খাওয়া শৈশবের অম্লান স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে। আজ গ্রামীণ মেঠোপথ আর খেজুর গাছের সারির সেই মুগ্ধতা হারাতে বসলেও হারায়নি খেজুর রসের গ্রাহক সংখ্যা।

আগে গাছিদের রস বিক্রির জন্য হাটে যেতে হতো। আর এখন গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামাতে দেরি হয়, কিন্তু হাঁড়ি শেষ হতে দেরি হয় না। খুব ভোরে গিয়ে বসে থাকেন ক্রেতারা। কারণ, বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা ও গাছি কমতে কমতে বিলুপ্ত প্রায়। আগে এক কেজি খেজুরের গুড়ের দাম ছিল ৩০-৪০ টাকা। বর্তমান বাজারে এক কেজি গুড়ের দাম ৪০০-৫০০ টাকা। এতো বিবর্তনেও কমেনি এর কদর ও চাহিদা।

আগে একমাত্র গুড় বিক্রি করেই চলতো গাছিদের সংসার। দুপুর হলেই গাছিরা হাঁড়ি কাধে ছুটে যেত গ্রামের বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় খেজুর গাছ কাটতে। এখন আর দেখা মেলে না গাছিদের। ৬-৭টি গ্রাম ঘুরলেও একজন গাছি পাওয়া দুষ্কর।

বছর কয়েক আগেও খেজুরের রস ও গুড় ছাড়া শীতের পিঠাপুলি ভাবা নিতান্তই অপ্রকৃত ব্যাপার ছিল। কুয়াশা ঘেরা সকালে গাছ থেকে নামানো কাঁচা রসের স্বাদ যেমন বর্ণনায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, তেমনি জ্বাল করা রসের তৈরি বিভিন্ন খাবারের স্বাদ ও চাহিদা ছিল ঢের। কাঁচা রসের তৈরি পায়েসের গন্ধটা বেশ দারুণ ছিল। এছাড়াও খেজুরের রসের পাটালি গুড়েরও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে গ্রামবাংলায়। এই গুড় দিয়ে হরেক রকম পিঠা বানায় গাঁয়ের বধূরা। ভাপা, সিদ্ধপুলি, রসের চিতইয়ের মতো বহু রকম পিঠা। আর এই পিঠা বানানোকে ঘিরে শিশু-বৃদ্ধার বসে থাকার দৃশ্য বাংলার এক পুরনো সংস্কৃতিরই অংশ। প্রচলিত খাদ্য হিসেবে খেজুর রস বেশ সস্তা, পুষ্টিকর ও উপাদেয়। খেজুর রসে অ্যাসপারটিক এসিড, নাইট্রিক এসিড ও থায়ামিন বিদ্যমান।

এখন প্রতি বছরই বিপুলসংখ্যক খেজুর গাছ ইট ভাটায় ব্যবহার হচ্ছে জ্বালানি হিসাবে। অবশ্য খেজুর গাছ নিধনের জন্য এককভাবে ইট ভাটা মালিকরাই দায়ী তাও নয়। কৃষকদের অসচেতনতায় অনেক গাছ মরে যায়। ফলে রস-গুড় উৎপাদন করে লাভবান হতে না পেরে গাছিরা গাছ কাটা থেকে নিষ্কৃয় হয়ে গেছে। অথচ গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যবাহী কিছু গাছের মধ্যে খেজুর গাছ ছিল অন্যতম। এ গাছ বাঁচিয়ে রেখে অর্থনীতি চাঙ্গাকরণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের বিকল্প নেই। তাহলেই এ গাছের দেখা মিলবে গ্রামবাংলায়, আর সংস্কৃতিও বাঁচবে।

উত্তরণ বার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK
আরও সংবাদ