বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৪:১৫

এগিয়ে যাচ্ছেন রানী

এগিয়ে যাচ্ছেন রানী

উত্তরণ বার্তা বিনোদন ডেস্ক : 'আমার মতন সুখী কে আছে/আয় সখী, আয় আমার কাছে/সুখী হৃদয়ের সুখের গান/শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ...' কথাগুলো লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গানের এই শব্দের পরতে পরতে জীবনকে মিলিয়েছেন রানী চৌধুরী। সমাজের সব বাধা উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিরামহীন এগিয়ে চলেছেন। 'পৃথিবীতে যার কেউ নেই, সবাই তার'- এ মন্ত্রে বিশ্বাসী রানী সফল হয়েছেন আরও আগেই। সেই ধারাবাহিকতায় এবার প্রথম ট্রান্সজেন্ডার অর্থাৎ রূপান্তরিত নারী হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত নৃত্যশিল্পী নির্বাচিত হয়েছেন।

যোগ্যতা ও গুণে শুধু নৃত্যশিল্পীই নয়, মডেল হিসেবে বিশ্বরঙসহ নামিদামি ব্র্যান্ডেও কাজ করছেন। নিজের স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের উন্নয়নের পথে শামিল করতেও কাজ করে চলেছেন। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন অধিকার আদায়ের পথে।

গত বছরের ৫ নভেম্বর অন্যদের সঙ্গে রানীও বিটিভির তালিকাভুক্ত নৃত্যশিল্পী হতে আবেদন করেন। সেখান থেকে ডাক আসার পর আরও তিনশজন নৃত্যশিল্পীর পাশাপাশি তিনিও পরীক্ষা দেন। নৃত্যশৈলী ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে বিচারকরা রানীকে নির্বাচিত করেন। তখনই তিনি বিচারকদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সগৌরবে নিজের পরিচয় তুলে ধরেন, জানান- তিনি একজন রূপান্তরিত নারী।

জুরি বোর্ডে থাকা বিটিভির প্রোগ্রাম ম্যানেজার (নৃত্য বিভাগ) ইমাম হোসাইন এ প্রতিবেদককে বলেন, 'রানীর তাকানোতে বোঝা গেলেও প্রথমে নিশ্চিত হতে পারিনি। পারফরম্যান্স শেষে সামনে আসতে বললে, রানী নিজেই তার পরিচয় দেয়। এতে আমাদের সবারই ভালো লেগেছে। রানী তার পরিচয় নয়, গুণকে ফুটিয়ে তুলেছে।'

তিনি বলেন, সমাজের সব মানুষকে নিয়েই চলতে হবে। হোক সে ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তাদের জন্য বিটিভির দরজা খোলা। তবে প্রতিটি বিভাগে তাদের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে রানী বিটিভির নিয়মিত ও বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন বলে তিনি জানান।

বিটিভির নিয়ন্ত্রক (ডিজাইন) মীর আহসান বলেন, 'বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজের কোনো মানুষকে পিছিয়ে রাখতে চান না। ট্রান্সজেন্ডার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ- সবাইকে নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব। এ বছর ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে একজন তালিকাভুক্ত হলেন এবং তা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই হয়েছেন। তবে তাদের তালিকাভুক্তির কাজটা আরও আগেই করা উচিত ছিল।'

রানীর বেড়ে ওঠা
১৯৯০ সাল। বরিশাল শহরের একটি হোটেলের কক্ষে এক নারীর মৃতদেহের পাশে কাঁদছিল সদ্য জন্ম নেয়া একটি ছেলে শিশু। নবজাতকের চিৎকার শুনে হোটেলের কর্মচারীরা ছুটে আসেন। শিশুটিকে দেখে সবার মন ছুঁয়ে যায়। তবে কে নেবে শিশুটির দায়িত্ব! এ ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে রাজধানী ঢাকার শ্যামলীর এসওএস শিশুপল্লী কর্তৃপক্ষ তাকে উদ্ধার করে। নাম দেয় মাসুদ রানা। 'মাসুদ' নামেই 'কৃত্রিম' মা-ভাই-বোনদের আদরে বেড়ে ওঠে শিশুটি। মা-বাবাও পায়। তার মায়ের নাম আলেয়া বেগম ও বাবা শাহজাহান। নিবিড় মমতায় স্নেহশীতল পরিবেশে মাসুদ বড় হতে থাকে। হারম্যান মেইনার স্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু। বিপত্তি বাধে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। নিজের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে, মিশতে পছন্দ করত সে। মেয়েদের মতো সাজতে ভালো লাগত। শারীরিক গড়ন ছেলের হলেও নিজের মধ্যে মেয়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে থাকে। শেষমেশ ২০১৮ সালে নারীতে রূপান্তরিত হন। নাম বদলে রাখা হয় রানী চৌধুরী। জীবনের এই মনস্তাত্ত্বিক দোটানায় তিনি থেমে থাকেননি। লেখাপড়ার পাশাপাশি ১৯৯৪ সাল থেকেই সংস্কৃতি চর্চা শুরু করেন। শৈশব থেকেই 'নৃত্যশিল্পী' হয়ে ওঠার স্বপ্ন তাড়া করত তাকে। রানী পেরেছেনও। কৈশরে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা) থেকে নাচের ওপর চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্সও সম্পন্ন করেন। তার নৃত্যগুরু হলেন ফারহানা চৌধুরী বেবী। লোকনৃত্য বিষয় হলেও নৃত্যের সব শাখায় তার বিচরণ।

সম্প্রতি রানী চৌধুরী বলেন, বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন তিনি। জন্মের পর থেকে অসংখ্য বাধার মুখে পড়েছেন। তবুও দমে যাননি। লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরের বরেণ্য নৃত্য শিক্ষকদের কাছ থেকেও তালিম নিয়েছেন। সেই নৃত্যে ও ছন্দে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন রানী।

রানী বলেন, 'হার মেনে নেব না। সমাজে টিকে থাকতে হলে নিজের অধিকার, নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে। মানুষ আঘাত দিয়ে কথা বললে ঠান্ডা মাথায় সয়ে গেছি, কাজটি সঠিকভাবে করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এ সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অবহেলিত। তাদের কোনো দোষ নেই। তবুও তারা এই একটা পরিচয়ের কারণে সমাজছাড়া, পরিবারছাড়া। তাদের দুঃখগুলো বোঝা প্রয়োজন। মানুষ বিপদে না পড়লে রাস্তায় নামে না। তাই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।'

নিজের সমাজসেবামূলক কাজকে প্রসারিত করতে এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের হয়ে অধিকার আদায়ে কথা বলতে রানী চৌধুরী নেতৃত্বে আসতে চান। তিনি বর্তমানে মানবিক বাংলাদেশ সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছেন। কাজ করছেন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সদস্য হিসেবেও। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে সংসদে আসতে চান রানী চৌধুরী।

রানীর স্বপ্ন
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার রক্ষায় তাদের অংশগ্রহণে রানী চৌধুরী দেশে প্রথমবারের মতো রিয়েলিটি শো 'আমিই পারি' আয়োজন করতে যাচ্ছেন। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবেন। রানী বলেন, 'পৃষ্ঠপোষকের অভাবে এখনও অনুষ্ঠানটি চূড়ান্ত করতে পারছি না। তবে এটাই এখন আমার ধ্যান-জ্ঞান। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে চাই- বাইরের সৌন্দর্য মূল নয়, ভেতরের সৌন্দর্যটাই আসল।'
উত্তরণ বার্তা/এআর


 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK