৪ মার্চ ছিল লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিন

উত্তরণ বার্তা ডেস্ক : একাত্তরে উত্তাল মার্চের চার তারিখ ছিল হরতালের তৃতীয় দিন। দেশব্যাপী চলছিল লাগাতার হরতাল । এই দিনের হরতাল ছিল আট ঘন্টার। খুলনা ও চট্টগ্রামে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ মিছিলে মিছিলে ঝাঁঝালো স্লোগানে উচ্চকিত সারাদেশ।

এদিনে উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে ছিল- বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের নতুন নামকরণ করেন ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র।’ পাকিস্তান টেলিভিশনের নাম পাল্টে ‘ঢাকা টেলিভিশন‘ নাম দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতে থাকে। কার্যত সারা বাংলা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ২ ও ৩ মার্চ সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ডাকা (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভাকে সামনে রেখে উজ্জীবিত মুক্তিকামী জনতা। কারণ, এ জনসভা থেকে ঘোষণা করা হবে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী।

বাংলাদেশ তখন বিদ্রোহ-বিক্ষোভে টালমাটাল। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররাও বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলন নস্যাতে তৎপর। কার্ফ্যু দিয়েও সামরিক জান্তারা বীর বাঙালীদের ঘরে আটকে রাখতে না পেরে গোপনে বাঙালী নিধনের পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। শুধু অপেক্ষা করতে থাকে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী বলেন।

আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা দফায় দফায় বৈঠকে বসেন ৭ মার্চের জনসভা সফল করার জন্য। চলতে থাকে জনসভার প্রস্তুতি। ঢাকাসহ সারাদেশেই গঠন হতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্র নেতারা গোপনে নানা স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান চালাতে থাকেন।

সারাদেশের সকল পাড়া, গ্রাম, মহল্লায় সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের আহ্বান জানানো হয়। এর উদ্যোক্তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যান্টিনে স্থাপন করা হয় ছাত্রদের যোগাযোগ কেন্দ্র। শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশেই প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাজ এলাকার স্বাধীনতাকামী নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।  

বঙ্গবন্ধু ঘোষিত পূর্ব কর্মসূচী অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক সফল হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় সাময়িকভাবে কার্ফ্যু তুলে নেয়া হলেও চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে তা বলবৎ থাকে। খুলনায় হরতাল পালনকালে নিরস্ত্র জনতার ওপর সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত হয় ও ২২ জন আহত হয়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে গতকাল আর আজ মিলে সর্বমোট ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়। সারাদেশে আহতদের জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে শত সহস্র মানুষ লাইন দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

এ রকম উত্তাল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে আওয়ামী লীগের এক মূলতবী সভায় ভবিষ্যত কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে সংগ্রামের নতুন দিকনির্দেশনায় বলেন, ‘আজ আওয়ামী লীগ নয় গোটা বাঙালী জাতিই অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। আমাদের সামনে আজ দুটো পথ খোলা আছে। একটি সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের মনোবল অটুট রেখে অবিচলভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া অথবা ভুট্টো ইয়াহিয়ার কথামতো সবকিছু মেনে নেয়া।’

নিজের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমি সারা জীবন ক্ষমতার মসনদ তুচ্ছজ্ঞান করে দেশ ও জাতির কাছে আমার জীবন মর্টগেজ রেখেছি। বাংলার মানুষ গুলি খেয়ে বন্দুকের নলের কাছে বুক পেতে দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে আমাকে মুক্ত করে এনেছে। আমার ৬ দফা কর্মসূচীর প্রতি ম্যান্ডেট দিয়েছে। এখন শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তানীদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে অবমাননাকর শর্তে কী করে ক্ষমতায় যাই।’ এরপর বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মধ্যে সারাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাঠামো তৈরির নির্দেশ দেন।
উত্তরণ বার্তা/এআর