শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
ঢাকা সময়: ১২:১৫

বিজিএমইএ ভবন নুয়ে পড়েছে আরো সুন্দর হাসবে হাতিরঝিল

বিজিএমইএ ভবন নুয়ে পড়েছে  আরো সুন্দর হাসবে হাতিরঝিল

উত্তরণ বার্তা ডেস্ক : রাজধানীর হাতিরঝিলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ ভবন ভাঙার কাজ এক বছরেও শেষ হয়নি। ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি কারওয়ান বাজার সংলগ্ন বিজিএমইএ ভবন ভাঙার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। ভবন ভাঙার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজ বলছে, বেইসমেন্টসহ ১৭ তলা ভবন ভাঙার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভবনটি ভাঙতে ভাঙতে এখন দৃশ্যমান আছে মাত্র তিন তলা। করোনা মহামারি আর সনাতন পদ্ধতিতে ভাঙার কাজ চলায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। তবে আগামী জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলে প্রতিষ্ঠানটি আশা প্রকাশ করছে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিজিএমইএ ভবন নুয়ে পড়েছে। বোঝারই উপায় নেই যে বছরখানেক আগে সেখানে ঝকঝকে কাচের দালান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। শ্রমিকদের কর্মতৎপরতা দেখা গেল। তাঁরা সনাতনি পদ্ধতিতে (হাতুড়ি) ভাঙছেন ভবনটি। ধুম ধুম শব্দের মধ্যেই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছিলেন কেয়ারটেকার শহীদ। ভবনের গেটের ভেতর ঢুকতেই সতর্ক হয়ে যান শহীদ। ভবন ভাঙার ছবি তুলতে চাইলে কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে বলে জানালেন তিনি। কথা হলো শ্রমিক হালিম মিয়ার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘কাপড় সেলাই করে বিদেশ থেকে অনেক টাকা নিয়ে আসত গার্মেন্টসের মালিকরা। আর তাগো অফিস ছিল এই বিল্ডিংয়ে। কোট তাগো এখান থাইকা বাইর কইরা দিছে। আর আমরা হাতুড়ি দিয়া হারাদিন ধইরা ভাঙ্গি তাগো এই ভবন।’

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শাহজান হোসেন বললেন, প্রায় এক বছর ধরে হাতুড়ি দিয়ে টুকটাক করে চললেও এখন কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় হ্যামার দিয়ে ভাঙার কাজ চলছে। বিজিএমইএ ভবন ভাঙার কাজ বেশ চ্যালেঞ্জিং বলে জানালেন শ্রমিকদের সুপারভাইজার আলী হোসেন। তিনি বলেন, ‘ভবনটি ঝিলের মাঝখানে, কোনোভাবেই যাতে ঝিলের পানি দূষিত না হয়—এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ছিল। এক পাশে সোনারগাঁও হোটেল, অন্য পাশে নান্দনিক হাতিরঝিল। তাই বেশি শব্দ করে ভাঙার কাজও করা যায়নি। তা ছাড়া নিরাপত্তার ভয় ছিল সব শ্রমিকের মধ্যে। কেউ কেউ প্রথম প্রথম কাজে আসতে চায়নি। র্যাংগস ভবন ভাঙতে গিয়ে শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনার কারণে সবাইকে ভয় নিয়ে কাজ করতে হয়েছে।’

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নসরুল্লাহ খান রাশেদ জানান, গত বছরের ২২ জানুয়ারি কাজ শুরু হলেও ভবনের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতেই দুই মাস পেরিয়ে যায়। তখন ছয় মাসের মধ্যে ভবন ভাঙার সময় দেয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। করোনার কারণে ২৬ মার্চ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জুলাই থেকে আবার কাজ শুরু হয়। এ সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়। সার্বিক পরিস্থিতিতে রাজউকের কাছে আগামী জুন পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়েছে। মৌখিকভাবে ওই আবেদনের সম্মতি মিলেছে। শুরুতে দুই শিফটে ১৪০ জন শ্রমিক দিন-রাত কাজ করতেন। এখন কাজ করছেন ১৫ থেকে ২০ জন। এসব শ্রমিক প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করে গড়ে ৭০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা আয় করে থাকেন। রাশেদ আরো জানান, বিজিএমইএ ভবন থেকে প্রতি রাতে ১০ থেকে ১৫ ট্রাক রাবিশ বের হয়। ৩০০ ফিটসহ রাজধানীর বিভিন্ন খালি জায়গা ভরাটে এসব ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান মমতা এন্টারপ্রাইজকে ট্রাকপ্রতি ৫০০ টাকা করে খরচ দেয়া হয়। নসরুল্লাহ খান রাশেদের কথায়, ‘আধুনিক যন্ত্রপাতির মধ্যে মাত্র হ্যামার গাড়ি ব্যবহার করতে শুরু করেছি। বেইসমেন্টে আরো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে। রাজউকের তত্ত্বাবধানে করা এই কাজ আগামী জুনের মধ্যেই শেষ হবে বলে আশা করি।’

রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী রায়হানুল ফেরদৌস জানান, ভবন ভাঙার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আরো ছয় মাস সময় চেয়েছে। তাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী জুন পর্যন্ত সময় বর্ধিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। ভবনটির তৃতীয় তলা ভাঙার কাজ চলছে এখন। এটি জুনের মধ্যে শেষ হবে বলে তিনি আশা করছেন। রায়হানুল বলেন, ‘চুক্তি অনুসারে ভবনটি ভেঙে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাজউককে এক কোটি ১০ লাখ টাকা দেবে। আমাদের মূল্যায়ন আছে যে ভাঙার পর অন্য উপকরণ ছাড়াও কমপক্ষে ৩০০ টন রডই পাবে ঠিকাদার।’ প্রসঙ্গত, নব্বইয়ের দশকে হাতিরঝিলে অবৈধভাবে বিজিএমইএ ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০৬ সালের দিকে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। জলাশয়ে ভবনটি নির্মাণ করায় শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছিলেন পরিবেশবাদীরা।

২০১০ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণে রাজউকের অনুমোদন না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। পত্রিকার প্রতিবেদনটি নজরে নিয়ে ভবনটি কেন ভাঙা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পরে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলতে রায় দেন। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট ভবন ভাঙার নির্দেশ দেয়ার পর এর বিরুদ্ধে বিজিএমইএ লিভ টু আপিল করে। ওই আপিল ২০১৬ সালের ২ জুন আপিল বিভাগে খারিজ হয়। রায়ে বলা হয়, ভবনটি নিজ খরচে অবিলম্বে ভাঙতে আবেদনকারীকে (বিজিএমইএ) নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে। এতে ব্যর্থ হলে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজউককে ভবনটি ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হলো। পরে ভবন ছাড়তে উচ্চ আদালতের কাছে সময় চায় বিজিএমইএ। প্রথমে ছয় মাস এবং পরে সাত মাস সময়ও পায় তারা। সর্বশেষ ২০১৯ সালে নতুন করে এক বছর সময় পায় সংগঠনটি। সে সময় তারা মুচলেকা দেয়, ভবিষ্যতে আর সময় চাওয়া হবে না।
উত্তরণ বার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK