বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৯:৫৬

উন্নয়নের নতুন অভিযাত্রা

উন্নয়নের নতুন অভিযাত্রা

উত্তরণ বার্তা ডেস্ক : আর্থসামাজিক উন্নয়নে নতুন মাইলফলক অর্জন করল দেশ। জাতিসংঘের বিচারে চূড়ান্তভাবে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়নের নতুন অভিযাত্রা শুরু হলো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জন্য যা এক অনন্য অর্জন। বিশেষ এ স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের শ্রেণি থেকে বেরিয়ে আসবে।

জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের ভিত্তিতে কোনো দেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করে থাকে। কমিটির পাঁচ দিনব্যাপী ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা শুরু হয় ২২ ফেব্রুয়ারি। গতকাল বৈঠকের শেষ দিনে বাংলাদেশকে দ্বিতীয়বারের মতো এবং চূড়ান্তভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করে কমিটি। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল, ভুটান ও লাওস চূড়ান্তভাবে এলডিসি থেকে বের হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে।

প্রথম দফায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রথমবারের মতো এবারও তিনটি সূচকেই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করেছে। দেশের এ অর্জন উপলক্ষে আজ শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। বিকেলে গণভবন থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারের নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা জাতিসংঘের এ স্বীকৃতিকে উন্নয়নের যাত্রায় বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন। তবে এর জন্য সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে, তা মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।

এলডিসি থেকে বের হতে সিডিপির পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পেতে হয়। স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রস্তুতির জন্য সাধারণত তিন বছর এলডিসি হিসেবে থাকে একটি দেশ। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সম্প্রতি এ বিষয়ক এক্সপার্ট গ্রুপের সভায় প্রস্তুতির জন্য সময় তিন বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করার আহ্বান জানিয়েছে। উত্তরণ প্রক্রিয়াকে মসৃণ ও টেকসই করা এবং করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বাড়তি দু'বছর সময় চায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে সিডিপি।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর সুবিধার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে। উন্নয়নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে। বাংলাদেশের বড় ধরনের ব্র্যান্ডিং হবে। এখানকার অর্থনীতি উদীয়মান, বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছে- এমন বার্তা বিশ্ববাসী পাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম শর্ত হলো অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া। বাংলাদেশ এ শর্ত পূরণ করতে পেরেছে মানে অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম ঝুঁকি রয়েছে। এসব বিষয় বিনিয়োগকারীদের উপলব্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে এলডিসি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ শুল্ক্ক ও কোটামুক্ত সুবিধাসহ অন্যান্য যেসব অগ্রাধিকার পায়, তা থাকবে না। সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণ কমে যাবে। ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক আইনকানুনের অব্যাহতি থাকবে না।কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, এ অর্জন অবশ্যই দেশের জন্য গৌরবের। ভালো খবর হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রস্তুতির জন্য দুই বছর বেশি সময় পাচ্ছে। এই সময়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য
চুক্তি (এফটিএ) এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার উদ্যোগ নিয়েছে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, পণ্যের বহুমুখীকরণসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রস্তুতি চলছে। ২০৩০ ও ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জনে সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বেসরকারি খাতকে উদ্যোগী করার কাজ চলছে। তবে বেসরকারি খাতকেও স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে হবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, এ অর্জন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, এ অর্জন সরকারের পরিকল্পিত উন্নয়নের ফসল। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০২১ সাল অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছরকে সামনে রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানো হয় এবং সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অষ্ঠম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সে অনুযায়ী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন হবে না। তবে পরিকল্পনাগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন দরকার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্জন হিসেবে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর চ্যালেঞ্জও আছে। জাতিসংঘের এই স্বীকৃতির ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা বর্তমানে পায়, তা বন্ধ হওয়ার সময় গণনা শুরু হলো। মূল চ্যালেঞ্জ বিশ্ববাজারে বিপণন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ। একমাত্র ভুটান ছাড়া কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ বা পিটিএ নেই। দেশের বাণিজ্যে স্থানীয় শিল্পের জন্য সুরক্ষা কমানো না হলে অন্য দেশ পিটিএ বা এফটিএতে আগ্রহী হবে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জিএসপি প্লাস পাওয়াও কঠিন। সেখানে রপ্তানি একটি পণ্যে কেন্দ্রীভূত। এক্ষেত্রে ইইউর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার হবে।

বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারগুলোতে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তিন বছর রপ্তানিতে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হবে। সে অনুযায়ী ইইউর বাজারে ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। ইইউর বাইরে অন্যান্য দেশে ২০২৬ সালের পর শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। করোনার কারণে এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর কয়েক বছর এ সুবিধা যাতে অব্যাহত থাকে সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে তদবির করছে। বাংলাদেশসহ উত্তরণ প্রক্রিয়ায় থাকা দেশগুলোর এ সুবিধার জন্য সিডিপিও সুপারিশ করেছে।

সিডিপি তিনটি সূচকের মানের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা মূল্যায়ন করে। সূচকগুলো হচ্ছে- মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই প্রয়োজনীয় মান অর্জন করে। এ বছর পর্যালোচনার মানদআেন্তর্জাতিক পদ্ধতির হিসাবে গড় মাথাপিছু আয়ের প্রয়োজন এক হাজার ২২২ ডলার। গত বছর শেষে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা তার বেশি স্কোর থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ২০২০ সাল শেষে স্কোর দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ৩। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পয়েন্ট রয়েছে বাংলাদেশের। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা তার কম স্কোর থাকতে হবে। বাংলাদেশের স্কোর ২৭ দশমিক ৩। তিনটি সূচকেই আগের মতো এবারও উত্তীর্ণ হয়েছে, যা সচরাচর দেখা যায় না। বাংলাদেশসহ ৪৬টি দেশ এখন এলডিসির তালিকায় রয়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেসরকারি খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্নেষকরা। একই সঙ্গে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠান বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন তারা। পরিবহন, বন্দর, আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।
উত্তরণ বার্তা/এআর

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK