উত্তরণবার্তা প্রতিবেদক : শুক্রবারে পুরান ঢাকা বিভিন্ন রাস্তায় শিশুদের খেলার ধুম পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা ক্রিকেট খেলে। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার ব্যাডমিন্টনও খেলতে দেখা যায় তাদের। মাঠে কিংবা পার্কে না, রাস্তাতেই এখন এলাকার শিশুরা খেলছে। এই খেলার নিয়মিত খেলোয়াড় সজীব জানায়, রাস্তায় খেলতে তাদের বেশ অসুবিধা হয়। কারণ গাড়ি, রিকশা এলে তাদের খেলা থামিয়ে রাখতে হয়। নয়াবাজারের সিটি করপোরেশনের মাঠটি বেশ কয়েক বছর আগে সংস্কার করা হয়। এখন পার্কের চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে, এর সঙ্গে বদলে গেছে মাঠের চরিত্র। আগে এই মাঠেই খেলত বাসাবাড়ী লেন সুইপার কলোনির শিশুরা। এখন সকাল-বিকাল এলাকার মুরব্বি আর ডায়াবেটিস রোগীরা হাঁটে বলে তারা একটি কমিটি গঠন করে মাঠটি রক্ষণাবেক্ষণ করছেন।
ফলে শিশুরা খেলতে পারছে না বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা কাসেম। শুধু এখানেই নয়, শহরের বেশির ভাগ জায়গাতেই মাঠ নেই বলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা রাস্তায় খেলছে বলে জানা যায়। আরও অনেকেই খেলার সুযোগ পাচ্ছে না এবং যার প্রভাব পড়ছে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর। ব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধা পাচ্ছে শিশুরা। নগর পরিকল্পনাকারীরা বলছেন, পরিকল্পনায় স্থান পাচ্ছে না শিশুদের বিনোদন। সিটি করপোরেশন বলছে, শিশুর বিনোদন বাড়াতে চেষ্টা চলছে। বিজ্ঞজনেরা বলছেন, খেলাধুলা শিশুর অধিকার—এমন বাস্তবতার মধ্যে আজ ২০ নভেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস। ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর বিশ্বনেতারা শিশু অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়ন করেন। সেই থেকে পালিত হয় দিবসটি।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই বেশি বঞ্চিত: নবরায় লেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সবুজ জানায়, তাদের স্কুলে কোনো মাঠ নেই। অনন্তময়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও নেই মাঠ। শিক্ষার্থী শিখা রানী জানায়, তারা ক্লাসে আর রাস্তায় খেলে, তাদের খলতে ইচ্ছা করে তবে খেলতে পারে না। তাঁতীবাজারের বাসিন্দা এলিজা জানান, তার বাচ্চাদের তিনি রাস্তায় খেলতে দেন না। তারা বাসার ছাদে এখন ব্যাডমিন্টন খেলে। গরমের দিন মোবাইলে তাদের খেলা হয়। খেলতে না পারায় শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বিকাশের বড় মাধ্যম খেলা থেকে বঞ্চিত হয়ে ছেলে শিশুরা বেপরোয়া ও মেয়ে শিশুরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কারণ তারা আবেগ নিয়ে খেলতে পারছে না, তাদের ব্যক্তিত্ব বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তিনি বলেন, শহরের সুবিধাভোগী শ্রেণি তাদের শিশুদের বিনোদনের কিছু ব্যবস্থা করেন। মাঠ-পার্ক কমে যাওয়ায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে এবং এর প্রভাবে তারা নেশাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। যেসব অভিভাবক শিশুদের বিনোদনকে গুরুত্ব দেন না, তাদের শিশুরা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং তাদের এমন রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।
খেলতে চায় শিশুরা :২০১৩ সালে তথ্যমন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে করা এক গবেষণায় ৪ হাজার ২০০ শিশুর কাছে তাদের আশা কী, জানতে চাওয়া হয়। ৮৩ শতাংশ শিশু জানায়, তারা এলাকায় একটি খেলার মাঠ চায়। ৭৩ শতাংশ শিশু চায় এলাকায় সাংস্কৃতিক সংগঠন। ৭৬ শতাংশ শিশু এলাকায় শিশুপার্ক চায়। ৬৭ শতাংশ শিশু শরীরচর্চা কেন্দ্র চায়। ৩ শতাংশ শিশু পাঠাগার ও ২ শতাংশ শিশু চিড়িয়াখানা করার কথা বলে। কোনো জরিপ না থাকলেও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকার ৯৫ শতাংশ স্কুলে খেলার মাঠ নেই বলে জানা যায়। ‘ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট’-এর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকার ২৯ শতাংশ শিশু কোনো খেলাধুলাই করে না এবং ৪৭ শতাংশ শিশু দিনে গড়ে তিন ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় টেলিভিশন দেখে। ৬৪ শতাংশ স্কুলে খেলাধুলার কোনো ক্লাসই নেওয়া হয় না। বেশির ভাগ স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। ৬৭ শতাংশ শিশুর বাড়ির কাছাকাছি খেলাধুলা করার কোনো সুযোগ নেই। ৩৭ শতাংশ শিশু ঘরের মধ্যে খেলাধুলা করে।
পরিকল্পনায় গুরুত্ব হারায় শিশু : কাগজে কলমে রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের মোট ৫৪টি পার্ক ও ২৫টি খেলার মাঠ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এগুলোর অস্তিত্ব দিনদিন কমছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স-এর সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান। তিনি বলেন, যখন কোনো পরিকল্পনা করা হয় তখন শিশু, প্রবীণ, নারীদের কথা চিন্তা করেই করা হয়। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে কাটছাঁট পর্যায়ে শিশুদের বিনোদন গুরুত্ব হারায়।
উত্তরণবার্তা/এআর