শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০০:০৪

রেহানা আপার জন্মদিন

রেহানা আপার জন্মদিন

  • মোহাম্মদ হানিফ হোসেন
শেখ রেহানা এক সংগ্রামী জীবনের নাম। আজ তাঁর ৬৯তম জন্মদিন। ১৯৫৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পুরানো ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ও মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব এবং তিন ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। সে সময় শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানিতে বড় বোনের সঙ্গে থাকায় ওই নারকীয় হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যান শেখ রেহানা।  মা-বাবা ও স্বজনহারা এতিম দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। শেখ রেহানা পরে ভারত থেকে লন্ডনে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময় শেখ হাসিনা ও এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায়। ক্ষমতা বদলের খবর শুনে সেই রাষ্ট্রদূত বঙ্গবন্ধুর বেঁচে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের বাসা থেকে বের করে দেন। এই হলো আমাদের একশ্রেণির আমলা ও কূটনীতিকদের চেহারা এবং চরিত্র। যেসব আমলা ১৫ আগস্টের কালোরাতের পর, রাতারাতি বদলে গিয়েছিল, এই আমলা তাদেরই একজন। বহুবার এই ধরনের নির্মম আচরণের মুখোমুখি হয়েছিলেন জাতির পিতার বেঁচে যাওয়া কন্যাদ্বয়। অবশ্য ওই দুঃসময়ে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত প্রয়াত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ও তার স্ত্রী বেগম মাহজাবিন চৌধুরী তাদের পাশে দাঁড়ান। তারা আশ্রয় দেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগে ভূমিকা রাখেন। তারাই আগস্টের শেষ সপ্তাহে তাদেরকে দিল্লি যেতেও সাহায্য করেন। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা জানেন পরিবারের ওপর হত্যাযজ্ঞ চলেছে কিন্তু তখনও পুরোপুরি জানতে পারেননি আসলে কী ঘটেছে, কে বেঁচে আছে, কে বেঁচে নেই। পুরো খবরটা ইন্ধিরা গান্ধীর কাছে থেকেই পেলেন, বেশ কিছুদিন পর। জানতে পারলেন পরিবারের কেউ আর বেঁচে নাই। শেখ হাসিনার জবানিতে জানা যায়, ‘আমরা জার্মানি থেকে দিল্লি পৌঁছলাম ২৪ আগস্ট। ইন্দিরা গান্ধী বারবার খবর পাঠাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলো ৪ সেপ্টেম্বর। তাঁর মুখ থেকে শুনলাম, কেউ বেঁচে নেই।’
ভারতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে বসবাসরত শেখ রেহানার পড়ার কথা ছিল শান্তি নিকেতনে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সেসময়ের সরকার নিরাপত্তা দিতে পারবে না এমন পরিস্থিতিতে সেটা আর হয়ে উঠেনি। উপায় না দেখে শেখ রেহানা পাড়ি জমালেন লন্ডনে। তবে লন্ডনে যাবার টিকেটের ব্যবস্থা করতে পারছিলেন না তিনি। এক সাক্ষাৎকারে শেখ রেহানা জানিয়েছেন, ‘এটি জানতে পেরে ইন্দিরা গান্ধী তার টিকেটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।’ শেখ রেহানা দিল্লি থেকে লন্ডন গেলেন। সেখানে গিয়ে মুখোমুখি হলেন আরেক নিষ্ঠুরতার। প্রথম প্রথম চেনা লোকজনও মুখ ঘুরিয়ে নিত। এক সময় চাকরি খুঁজছিলেন হন্যে হয়ে। কিন্তু প্রথম প্রথম কেউই এগিয়ে আসছিল না। তারপর কাজ পেলেন লাইব্রেরি ও বুক পাবলিশিং হাউজে। কঠোর পরিশ্রম করতে শুরু করলেন। ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে শফিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে শেখ রেহানার বিয়ে হয় লন্ডনের কিলবার্নে। কিন্তু শেখ হাসিনাসহ পরিবারের বাকিরা কেউই টাকার অভাবে বিলেত যেতে পারলেন না। পরে শেখ হাসিনা তার ছোটবোন রেহানার সন্তান হওয়ার সময় বিলেতে যাবার সুযোগ পান।
বিয়ের পরও দুঃখ-কষ্ট তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে। সে সময় আর্থিক কষ্টটাই ছিল প্রবল। এক স্মৃতিচারণে তিনি বলেছিলেন, ‘লন্ডনে আসার পর চাকরির জন্য যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, তখন কত পরিচিতজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। চাকরি নিলাম একটি লাইব্রেরি ও পাবলিশার্স কোম্পানিতে। এর পর তো অনেক পথ পাড়ি দিলাম। আমাদের বাসায় রাত-দিন আসা-যাওয়া করত এমন ব্যক্তিও রাস্তায় দেখা হলে চোখ ফিরিয়ে নিত। অবশ্য কেউ কেউ সাহায্যও করেছেন। এর মধ্যে একজন শিপিং কর্পোরেশনের বড় অফিসার এ জেড আহমেদ আমাকে খুবই সাহায্য করেছেন। আব্বার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রুহুল কুদ্দুস ও মঈনুল ইসলাম সাহেবও আমার খোঁজখবর নিয়েছেন নিয়মিত। আমার বিয়ের উকিল ছিলেন মঈনুল ইসলাম সাহেব।  ড. শহীদুল্লার নাতি মনসুরুল হক, তাকে আমরা হীরা মামা বলে ডাকি- তিনিও আমার জন্য অনেক করেছেন।’ বিয়ের পরপরই তিনি স্বামীর সাথে চলে আসেন সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে। থাকার ব্যবস্থা হয় এক বাঙালি পরিবারের সাথে রুম ভাগাভাগি করে। আর্থিক অনটনের কারণে, চাইলেও একক বাড়ি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তখন তাদের ছিল না। সাদাসিধে ছোট একটি আড়ম্বরহীন ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন; বাসে, টিউবে-রেলেই চলাফেরা করতেন।  তারপর শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে বাংলাদেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর শেখ রেহানা বিলেতে কাজ করছেন, টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন। ঘর সামলাচ্ছেন এবং বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। এসবই ইতিহাস।
বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনার বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে জানতে পারি, ১৯৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় শেখ হাসিনার দ্যুতির পেছনের আলোর মানুষটি শেখ রেহানা। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শেখ হাসিনা যেমন তার বাবার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার প্রত্যয় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন- ঠিক তেমনিভাবে শেখ রেহানা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ব্যক্তিত্বের আলোয় পেছন থেকে ভূমিকা রাখেন। শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে, কঠিন মুহূর্তে সাহস ও সমর্থন দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শেখ রেহানা। আরেকটি ইতিহাস হয়তো অনেকের কাছেই অজানা। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের বিচারের দাবি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রথম তুলে ধরেছিলেন শেখ রেহানা। তিনি তখন সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের বিচারের ডাক দিয়েছিলেন। বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী হলেও শেখ রেহানা বছরের একটি বড় সময় দেশেই কাটান। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছে ‘ছোট আপা’ হিসেবেই তিনি পরিচিত।
শেখ রেহানা ও শফিক আহমেদ সিদ্দিক পরিবারের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক এবং ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। বড় মেয়ে টিউলিপ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির একজন এমপি। ছেলে রাদওয়ান মুজিব একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত এবং আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের ট্রাস্ট্রি। সবার ছোট রূপন্তী লন্ডনে ‘কন্ট্রোল রিস্কস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক। এক সুখী পরিবারের প্রতিচ্ছবি। শুভ জন্মদিন রেহানা আপা। দীর্ঘজীবী হোন।
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী 
 
 
 
 
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK