শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৫:০১

বেগম ফজিলাতুন নেছা শেখ মুজিবের জীবনে অর্ধেকেরও বেশি - ২য় পর্ব

বেগম ফজিলাতুন নেছা শেখ মুজিবের জীবনে অর্ধেকেরও বেশি - ২য় পর্ব

মনজুরুল আহসান বুলবুল
টুঙ্গিপাড়ার যে শিশুকন্যা রাজনীতির ঝড়ের পাখি শেখ মুজিবুর রহমানের ঝড়ো হাওয়ার সাথী হয়েছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কি তিনি নিভৃত সংসার-জীবনে ফিরে গেলেন? জবাব হলো : না। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যেদিন দেশে ফিরলেন সেদিনের বর্ণনা দিলেন শেখ হাসিনা : “বঙ্গবন্ধু যখন সব কাজ শেষে বাসায় ফিরলেন সে এক মহালগন। বেগম মুজিব আঁকড়ে ধরলেন তাঁকে, যেন সারাজীবন আর ছাড়বেন না। ছাড়েনও নি।” তাদেরসহ মৃত্যু সে-সাক্ষ্যই দেয়।
দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেগম মুজিবের শর্ত : তিনি কোনো সরকারি ভবনে উঠবেন না। দ্বিতীয় কাজটি ছিল, প্রতিদিন গণভবনে বঙ্গবন্ধুর জন্য রান্না করে খাবার পাঠানো। কিন্তু রাজনীতির সাথে তার যে সম্পর্ক তা কখনও ছিন্ন হয়নি।
এমএ ওয়াজেদ মিয়া বলছেন : “১৯৭৩ সনে ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য শেখ শহীদকে রাজি করাতে তৎপর ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। তিনি এজন্য বেগম মুজিবের সাহায্যও চাইলেন। কিন্তু বেগম মুজিব এটা চাচ্ছিলেন না। শেখ শহীদ তখন সরকারি চাকরি করছেন। বেগম মুজিবের অভিমত ছিল : ‘শেখ শহীদ চাকরি করায় আমার বোনের সংসারটি মোটামুটি চলে যাচ্ছে। সে এই চাকরি ছেড়ে ছাত্রলীগের সভাপতি হলে সংসারটা আবার অভাব-অনটনের মধ্যে পড়বে।’ পরে অবশ্য শেখ শহীদ ছাত্রলীগের সভাপতি হন।”
বেগম মুজিবকে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বলেই জানতেন, এমনকি বাংলাদেশের শত্রুরাও। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে এমনি এক ঘটনার বর্ণনা দেন এমএ ওয়াজেদ মিয়া। তিনি বলছেন : “… শাশুড়ি দুপুরে আমার অফিসে গাড়ি পাঠালেন আমাকে তাঁর বাসায় নেওয়ার জন্য। হাসিনা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সেখানেই ছিল। খাবার সময় তিনি আমাকে একটি ইংরেজিতে লেখা চিঠি দিলেন পড়ে দেখার জন্য। শাশুড়িকে পাকিস্তান মেডিকেল কোরের একজন ব্রিগেডিয়ার লিখেছেন চিঠিটি। এটি লন্ডন থেকে পাঠানো হয়েছে।… ব্রিগেডিয়ার সাহেব বঙ্গবন্ধুর শ্বাসনালী থেকে রক্তক্ষরণের সংবাদে উৎকণ্ঠিত হয়ে লিখেছেন উক্ত চিঠি। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, লাহোরে ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখ অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর শরীরে গোপনে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য মারাত্মক ক্যানসার জাতীয় ভাইরাস তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। তাঁকে বলা হয়েছিল, সেই ভাইরাস এক ক্ষুদ্র সুচের মধ্যে থাকবে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে করমর্দন করার সময় হাতে বা কোলাকুলি করার সময় ঘাড়ে বা শরীরের যে কোনো অংশে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। ব্রিগেডিয়ার বলছেন, তিনি এতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন, অন্য কেউ এই কাজটি করে থাকতে পারে।”
ঘটনা সত্য-মিথ্যা যাই হোক, বঙ্গবন্ধুর বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই চিঠি পড়ে বেগম মুজিব উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে যে কোনো কোনো মহল তখন থেকেই তৎপর ছিল এ চিঠিতে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
১৯৭৩ সাল থেকে দেশের নানা অস্থিরতা বেগম মুজিবকেও বিচলিত করে। বঙ্গবন্ধু যখন বিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সাথে লড়াই করছেন, কখনও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তখন বেগম মুজিব অতন্দ্র প্রহরীর মতোই তার পাশেই থেকেছেন। সার্বিক পরিস্থিতিতে তিনি উৎকণ্ঠিত ছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। যেদিন চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন, সেদিন বাসার পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন এমএ ওয়াজেদ মিয়া : “… শাশুড়ি বলছিলেন… আমি এই বাড়ি ছেড়ে তোমার সরকারি রাষ্ট্রপতি ভবনে যাচ্ছি না। শাশুড়ির এই কথা শুনে বঙ্গবন্ধু মিটমিট করে হাসছিলেন।”
 
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন যে বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছে, বেগম মুজিব এ বিষয়টি তার কোন দিব্যদৃষ্টি দিয়ে কীভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। তা না হলে স্বামীর অনুপস্থিতিতে এক নারীকে যখন পদে পদে লড়াই করতে হচ্ছে তখন তিনি কারাবন্দি স্বামীর হাতে তুলে দিচ্ছেন রুলটানা খাতা ও কলম, জীবনী লেখার জন্য। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলছেন : “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছো, লেখো তোমার জীবন কাহিনি।… আমার স্ত্রী, যার ডাকনাম রেণুÑ আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে বসলাম।” [অসমাপ্ত আত্মজীবনী]
শুধু কি লেখার তাগিদে দেয়াই? এই লেখা যে বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ সেটিও তিনি বুঝেছিলেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’র ভূমিকায় বেগম ফজিলাতুন নেছার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বলছেন : [১৯৭১ সনের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী জীবনে]’ “এই সময় এক মেজর সাহেব এসে বললো বাচ্চা লোগ ‘সুকুল’ মে যাও।… যা হোক স্কুলে যাবে বাচ্চারা, জামাল, রেহানা আর রাসেল। আমি বললাম, বই খাতা কিছুই তো নাই, কী নিয়ে যাবে, আর যাবেই বা কীভাবে? জিজ্ঞেস করলো বই কোথায়? বললাম, আমাদের বাসায়, আর সে বাসা তো আপনাদের দখলে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বাসা।… ওরা ঠিক করলো জামাল, রেহানা, আর রাসেলকে নিয়ে যাবে যার যার বই আনতে। আমি বললাম, আমি সাথে যাবো। কারণ একা ওদের সাথে আমি আমার ভাইবোনদের ছাড়তে পারি না। তারা রাজি হলো। আমার মা আমাকে বললেন, ‘একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস। খাতাগুলো মার ঘরে কোথায় রাখা আছে তাও বলে দিলেন।… আমি মায়ের কথামতো জায়গায় গেলাম। ড্রেসিং রুমের আলমারির উপর ডানদিকে আব্বার খাতাগুলো রাখা ছিল। খাতা পেলাম কিন্তু সাথে মিলিটারির লোক, কী করি? যদি দেখার নাম করে নিয়ে যায় সেই ভয় হলো। যা হোক, অন্য বই-খাতা কিছু হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে একখানা গায়ে দেবার কাঁথা পড়ে থাকতে দেখলাম, সেই কাঁথাখানা হাতে নিলাম, তারপর একফাঁকে খাতাগুলো এ কাঁথায় মুড়িয়ে নিলাম।… যখন ফিরলাম মায়ের হাতে খাতাগুলো তুলে দিলাম। পাকিস্তানি সেনারা সমস্ত বাড়ি লুটপাট করেছে, তবে রুলটানা এই খাতাগুলোকে গুরুত্ব দেয় নাই বলেই খাতাগুলো পড়েছিল।… আব্বার লেখা এ খাতার উদ্ধার, আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। আমার আব্বা যতবার জেলে যেতেন, মা খাতা-কলম দিতেন, লেখার জন্য বারবার তাগাদা দিতেন। আমার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন, মা সোজা জেলগেটে যেতেন আব্বাকে আনতে আর আব্বার লেখাগুলো যেন আসে তা নিশ্চিত করতেন। সেগুলো অতি যত্নে সংরক্ষণ করতেন।”
কল্পনা করা যায়! স্বামী কোথায় তিনি জানেন না, দুই পুত্র যুদ্ধক্ষেত্রে, কোন্ দিন ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কি না তা অনিশ্চিত, বাকিদের নিয়ে তিনি গৃহবন্দি, কখন কী হয় বলা যায় না। এর মধ্যেও বেগম মুজিব বুক আগলে রক্ষা করলেন বঙ্গবন্ধুর লেখা। এই লেখাগুলো শুধু রাজবন্দি শেখ মুজিবের আত্মজীবনী বা রোজনামচা মাত্র নয়, এদেশের রাজনীতি, সংগ্রাম আর মুক্তির ইতিহাস। এই একটিমাত্র কারণেই তো এই জাতির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত বেগম মুজিবের প্রতি।
 
সেই যে টুঙ্গিপাড়ার বালিকা বধূ তার জমানো টাকা থেকে কিছু দিতেন স্বামীর খরচ হিসেবে, সেই থেকে একসাথে মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার পুরো পথটিই ছিল বেগম ফজিলাতুন নেছা আর শেখ মুজিবুর রহমানের পরস্পর নির্ভরতার।
এই নির্ভরতার স্বরূপটি জানতে আমাদের ফিরতে হবে আবার তাদের দুজনের কাছেই।
১৯৬৭ সালের ২৮-৩০ এপ্রিল শেখ মুজিব ডায়েরিতে লিখেছেন : “আজ ১৪ দিন হয়ে গেছে, রেণু তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে আসবে দেখা করতে বিকেল সাড়ে চারটায়। চারটার সময় আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম।… বহুদিন পর ছেলেমেয়েদের ও রেণুর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বললাম। প্রায় দেড়ঘণ্টা। ঘর সংসার, বাড়ির কথা আরও অনেক কিছু। আমার শাস্তি হয়েছে বলে একটুও ভীত হয় নাই, মনে হয় পূর্বেই এরা বুঝতে পেরেছিল। রেণু বললো, পূর্বেই সে জানতো যে আমাকে সাজা দিবে।… ছেলেমেয়েরা একটু দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো, তবে হাবেভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না। বললাম, তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আমার কতদিন থাকতে হয় জানি না। তবে অনেকদিন আরও থাকতে হবে বলে মনে হয়। আর্থিক অসুবিধা খুব বেশি হবে না, তোমার মা চালাইয়া নিবে। কিছু ব্যবসাও আছে আর বাড়ির সম্পত্তিও আছে। আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটাইয়াছি, তোমার মা-ই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও।”
ডায়েরির আরেক অংশে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য : [রেণুকে বলছেন] “… সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি। আমি যখন জেলখানার বাইরে থাকতাম তখনও সত্যিকার অর্থে সংসার নিয়ে কোনোদিন চিন্তা করতাম না। তোমার সংসার তুমিই চালাও।”
নির্ভরতার অপর অংশের চিত্রটি দেখি। বিহারে দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় যাওয়ার আগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে রেণুকে চিঠি লিখেন শেখ মুজিব। জবাবে রেণু লিখেন : “… আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চন্ত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহ্র উপর আমার ভার ছেড়ে দেন।”
বেগম ফজিলাতুন নেছা সম্পর্কে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী খোদ শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, ‘Mujib, She is a very precious gift to you from Allah, don’t neglect her Please.’ এর চাইতে সত্যি কথা বুঝি আর হয় না।
এই সত্যকে অনুসরণ করেই বলি, বেগম ফজিলাতুন নেছাকে নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত। সেই গবেষেণায় দেখা যাবে, শুধু বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী হিসেবে নয়, তার মৌলিক চিন্তা ও কাজ আমাদের একটি বিশেষ সময়ের রাজনীতি, ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তার এই কাজ বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণতা দিয়েছে। তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা হতে পারেন সেই গবেষণার আঁকড় সূত্র। এ দুজনের স্মৃতিচারণ অনুসরণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ অডিও ভিজ্যুয়াল প্রামাণ্য হতে পারে জাতির এক বড় সম্পদ।
 
শুরুতে যে কথাটি বলেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। বিশ্বে মহান আর চির কল্যাণকর সৃষ্টির জন্য কবি সরল সমীকরণ করেছেন যে, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। কিন্তু বেগম ফজিলাতুন নেছা আর শেখ মুজিবুর রহমানের জীবণপ্রবাহ প্রমাণ করে দিচ্ছে, এই সহজ সমীকরণেরও ব্যতিক্রম আছে। শেখ মুজিবেই পূর্ণ বাংলাদেশ, এই সত্যির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি, এই পূর্ণতায় বেগম ফজিলাতুন নেছা ছিলেন শেখ মুজিবের জীবনজুড়ে অর্ধেকের চাইতেও বেশি। তাদের জীবনপ্রবাহ এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে।
 
লেখক : সাংবাদিক

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK