মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
ঢাকা সময়: ১৭:১১

আমার সৌভাগ্য আমি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম

আমার সৌভাগ্য আমি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম

কাজী মো. সালাহ্উদ্দিন: হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি; তিনি বাঙালি জাতির পিতা। দেশপ্রেম ও যাবতীয় কর্মকা- মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু একজন কীর্তিমান পুরুষ। বঙ্গবন্ধু আমার চোখে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি যখনই গিয়েছি তখনই দেখতাম একটা আদর ও ভালোবাসা জড়িয়ে থাকত তার কথাবার্তার মধ্যে। উনি যে বঙ্গবন্ধু- জাতির পিতা। সত্যিকার অর্থেই তিনি বাঙালি জাতির পিতা ছিলেন। আমার সৌভাগ্য আমি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম আর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম।
খেলাধুলায় কী সফলতা পেয়েছি, না পেয়েছি এটা পরের কথা, আমি বঙ্গবন্ধুকে চিনেছি-দেখেছি এবং আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখতে পেরেছি- এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। এ দুটি বিষয়ই আমার জীবন সার্থক করে দিয়েছে। আমি যদি এক কথায় বলে দেই, খেলাধুলা করে যা পেয়েছি- সেটা সম্মানের। আর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পেয়েছি আত্মতৃপ্তি। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কথাই চলে আসে। বঙ্গবন্ধু আমাদের কেবল স্বাধীনতার স্থপতি বা জাতির পিতাই নন, তিনি ছিলেন একাধারে সফল একজন রাষ্ট্রনায়ক, খেলোয়াড় ও ক্রীড়া সংগঠক। দেশের সব বিষয়ে ছিল তার সমান দৃষ্টি। ক্রীড়াঙ্গনেও তিনি রেখে গেছেন অনন্য অবদান। পারিবারিকভাবেই বঙ্গবন্ধু খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন একজন ফুটবল-প্রেমিক। গোপালগঞ্জের প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টগুলোতে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন তিনি। গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব দলটির অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করতেন বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান। অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় ফুটবলে হাতেখড়ি হয় বঙ্গবন্ধুর। ১৯৩৭ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল মিশন স্কুলের ফুটবল দল। স্কুল দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। স্কুল দলের হয়ে তিনি তার বাবার বিপক্ষে বেশ কয়েকবার ফুটবল ম্যাচ খেলেছেন। গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাবের বিপক্ষে ৫টি ড্র আছে মিশন স্কুলের, যা বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। উৎসুক জনসাধারণ বাবার বিপক্ষে তার খেলা বেশ উপভোগ করতেন।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে ১৯৪০ সালের শুরুর দিকে মাঠ মাতাতেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৪৩-৪৪ মৌসুমে বগুড়ায় আয়োজিত গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে তার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। এই ক্লাবের হয়ে ফুটবলের পাশাপাশি ভলিবল, বাস্কেটবল এবং হকিতে মাঠে নেমেছেন তিনি। বেশ কিছুদিন ক্লাবটির সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু। এছাড়া ধানমন্ডি ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালেই দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। এর ঠিক দু-বছর পরেই বাফুফে পেয়ে যায় ফিফা ও এএফসি’র সদস্যপদ। ফুটবল, ক্রিকেট, কাবাডির পাশাপাশি অন্যান্য খেলা যেমন- হকি, ভলিবল, বাস্কেটবল, দাবা, জুডো-কারাতেসহ সব খেলাকেই সমান প্রাধান্য দিতেন বঙ্গবন্ধু।
ক্রীড়ার মান উন্নয়নে ক্রীড়া অবকাঠামোর সুবিধাদি এবং সঠিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন বঙ্গবন্ধু। ক্রীড়া প্রতিভা অন্বেষণ, প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের পরিচর্যার পাশাপাশি যোগ্য প্রশিক্ষক এবং ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে হবে এসব কথা মাথায় রেখে ১৯৭৪ সালে বিশেষ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে-লক্ষ্যে তিনি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় প্রকল্প আকারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস (বিআইএস) প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন।
ফুটবলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অন্যরকম ভালোবাসা। সুযোগ পেলেই তিনি খেলা দেখতে মাঠে চলে আসতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ। তার হাজারো ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি আমাদের সময় দিতেন। তার বড় ছেলে শেখ কামাল আমার ক্লাসমেট ছিল। বিকেলবেলা খেলাধুলা শেষে শেখ কামালের সঙ্গে ওদের বাসায় যেতাম।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। ১৯৬৮ সালের কথা বলছি। আমি আর শেখ কামাল তখন একই স্কুলে পড়তাম। আমাদের একটা অভ্যাস ছিল; আমরা দুপুরবেলায় স্কুলের পরে একেকদিন একেকজনের বাসায় ভাত খেতে যেতাম। সেদিন ছিল কামালের বাসায় খাবারের পালা। আমি, কামাল আর তান্না (তানভীর মাজহারুল ইসলাম) স্কুলড্রেস পরেই গিয়েছিলাম। আমরা তিনজন খেতে বসেছি, তখন বঙ্গবন্ধু কোথাও বের হচ্ছিলেন। উনাকে দেখে আমি সালাম দিলাম। তিনি বললেন, তোমরা কি স্কুল থেকে এসেছ? আমি বললাম- জ্বি, আমরা স্কুল থেকে এসেছি। এই হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। সেদিন এর বেশি কথা হয়নি। পরে বহুবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। বাসার বাইরে মাঠে কিংবা ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোলাগা বা ভালোবাসা যেটাই বলি না-কেন, তা তৈরি হয়েছে ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কারণে। যা কখনও ভোলার নয়। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেই ভাষণের কথা। এখনও মনে হলে গায়ে কাঁটা দেয়। বঙ্গবন্ধু বললেন- আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব…। মঞ্চের সামনে যেসব মানুষ বসা ছিল, সেখানেই ছিলাম। তখন স্কুল থেকে মাত্র কলেজে গিয়েছি। টগবগে যুবক, বঙ্গবন্ধু তখন আমাদের যা বলবেন, আমরা তা-ই করতে প্রস্তুত ছিলাম। তখনই যেন যুদ্ধে নেমে যাব- ব্যাপারটা এমন ছিল। সেদিন ঢাকা ছিল লোকে-লোকারণ্য। আমি কিন্তু ১৯৭১ সালের কথা বলছি। তখনই সবাই যুদ্ধে নেমে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল। সেই সময়কার কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এর অনুভূতিই অন্যরকম। আমার মতে, বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের পর সেদিনই দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। গোটা ইতিহাসটাই আমি সামনে থেকে দেখেছি।
মুক্তিযুদ্ধের পরও অনেক স্মৃতি রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। যেমন- আমি কামালের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। আবার আমার খেলা দেখতে এসেছেন জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু অনেকবারই মাঠে এসেছেন। আমার কাছে ছবিগুলো আছে। তিনি খেলার প্রধান অতিথি ছিলেন, আমাদের সঙ্গে মাঠের ভেতরে ফটোসেশন করেছিলেন। এটা ১৯৭২-৭৩ সাল হবে। আবাহনী ক্লাব চালাত কামাল, তাই তিনি এটা নিয়ে চিন্তা করতেন না। তিনি সব সময় দেশের কথা বলতেন। বলতেনÑ দেশের মান রাখবি। শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, তার পুরো পরিবারটিই খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। শেখ কামাল আবাহনী ক্লাব গঠন করে। স্বাধীনতার পর দেশের ক্রীড়া উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতার কমতি ছিল না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা আর আন্তরিক সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলাদেশে ফুটবল মাঠে গড়ায় মাত্র দু-মাসের ব্যবধানে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাঠের বেশ ক’টি স্মৃতি রয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘটনা না বললে নয়। একবার তিনি মাঠে এসেছিলেন, আমার চুল তখন অনেক বড় ছিল। ফটোসেশনের সময় তিনি তার হাতটা আমার মাথার ওপর দিয়েছিলেন। তখন তো গ্যালারি পরিপূর্ণ ছিল। পরদিন রটে যায় বঙ্গবন্ধু না-কি আমাকে বলেছেন চুল কাটতে; কিন্তু এমন কোনো কথাই হয়নি। তো পরের ম্যাচে তখনও আমার লম্বা চুলই ছিল। সবাই তখন বলছিল- বঙ্গবন্ধু বলেছেন চুল কাটতে, তুমি চুল কাটাওনি? তখন আমি বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধু আমাকে চুল কাটতে বলেননি, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সবাই বুঝেছিল বঙ্গবন্ধু আমার মাথায় হাত দিয়েছেন বুঝি চুল কাটতে বলবেন বলে।
এছাড়া যখন কামালের সঙ্গে দেখা করতে বাসায় যেতাম তখনও দেখা হতো। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে দেখা হতো। তার ছোট বোন শেখ রেহানাও সঙ্গেও থাকতেন। ওই বাসায় গেলে আমাদের কোনো কিছু বলতে হতো না। তারা আমাদের খুব আপ্যায়ন করতেন। চা, পানি, মিষ্টি চলে আসত আমাদের রুমে। বাসায় গেলে চাচীকে (বঙ্গমাতা) সালাম দিয়েই আমরা লুকিয়ে যেতাম। আসলে উনাদের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক মধুর ছিল। আপা যখন বিদেশ থেকে আসতেন, তখন কামালকে বলতেন- তোর জন্য কী আনব? কামাল বলত, আমাদের দুজনের জন্য জার্সি আনবে। শুধু কামালের জন্য নয়, আপা জার্সি আনতেন পুরো আবাহনী টিমের জন্য।
শেখ কামালের নেতৃত্বে আমরা আইএফএ শিল্ড খেলার জন্য ভারত সফরে গিয়েছিলাম। তখন শেখ মুজিবুর রহমান ফোন করে কামালকে বললেন, সব খেলোয়াড়দের জানিয়ে দিও, যদি তোমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারো, তাহলে তোমাদের বিমানে করে দেশে নিয়ে আসা হবে। একজন প্রধানমন্ত্রীর শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও তিনি যে খেলার প্রতি এতটা খোঁজ রাখতেন তা সত্যি বিরল। শুধু তাই নয়, আমরা একবার মালয়েশিয়ায় মারদেকা কাপে খেলতে যাব। তার আগে আমাদের সবাইকে ওনার অফিসে ডেকে চা এবং বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করে বললেন, যাও ভালো করে খেলো। দেশের মান রাখবে কিন্তু।
১৯৭২ সালে কলকাতার মোহনবাগান টিম আমাদের সঙ্গে খেলতে ঢাকায় আসে, সেই সময় খেলার আগে মাঠে এসে আমাদের সব খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করেছেন বঙ্গবন্ধু। সেই ম্যাচে আমরা জয় পেয়েছি। ঠিক পরের বছর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মিনস্ক ডায়নামো নামে একটা ক্লাব ঢাকায় খেলতে আসে। সেই ম্যাচের দিন বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে ভিআইপি গ্যালারিতে বসে খেলা উপভোগ করেছিলেন।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। তারকা ফুটবলারদের সমন্বয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ একাদশ ও রাষ্ট্রপতি একাদশের মধ্যে সেই ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সবাইকে নিয়ে গড়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু একাদশ আর বাছাইকৃতদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি একাদশ দল। খেলায় রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর দল ২-০ গোলে জয় পেয়েছিল। গোল দুটো করেছিলেন টিপু ও গফুর। সেদিনও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাঠে উপস্থিত ছিলেন।
এর মধ্যেই ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনাও মনে পড়ছে। আজ আমরা ‘মুজিববর্ষ’ পালন করছি। অথচ সেদিন জাতির পিতাকে কী নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি সেই হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পর্যন্ত জারি করা হয়েছিল। ১৫ আগস্টের ঘটনা স্মরণ হলে, আসলে আর কিছু মনে আসে না। কী বলব! এত বড় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ! স্বাধীনতার স্থপতি, আমার বন্ধু কামাল, চাচী, শিশু রাসেলÑ ভাবতে পারি না আজও সেদিনের কথা।
তখন আমি বাংলাদেশে ছিলাম না। আমাদের খেলা ছিল মালয়েশিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে। তো সন্ধ্যায় খেলা থাকায় সেদিন সকালে একটু দেরি করেই আমি নাশতা করতে নেমেছিলাম লবিতে। সেই সময় তান্না মালয়েশিয়া এসেছিল। আমরা নাশতা করতে করতে এক ভারতীয় শিখ নাগরিক আমাদের টেবিলে এলেন। কুয়ালালামপুরে একমাত্র অ্যাডিডাসের দোকান ছিল তার। তার দোকান থেকে আমরা বুট, জার্সি কিনতাম। তাই ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছিল। তিনি এসে বললেন- তোমার সঙ্গে কথা আছে। তোমার দেশে ক্যু হয়েছে। তোমাদের বঙ্গবন্ধুর গোটা পরিবারকে মেরে ফেলা হয়েছে। তিনি আরও বললেন, আমি ভোরবেলায় ব্যাংকে গিয়েছিলাম, ব্যাংকের টেলেক্স বোর্ডে নিউজ আসছিল যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। এই বুলেটিন দেখেই আমি তোমার কাছে এলাম।
তখন নাশতা ফেলে আমি আর তান্না একটা ট্যাক্সি করে বাংলাদেশ দূতাবাসে চলে গেলাম। আমি তখন ট্র্যাক স্যুট পরা। গিয়ে দেখি অ্যাম্বাসি খালি। শুধু রিসেপশনে একজন পিয়ন বসা। আমরা বললাম, অ্যাম্বাসেডর অফিসে আছেন? উনি বললেন, আছেন। আমাকে দেখে তিনি চিনে ফেলেছিলেন। তখন আমরা তার রুমে ঢুকলাম। আমাদের দিকে তাকিয়ে তিনি মাথা নিচু করে বললেন, তোমরা যা জান, আমিও তাই জানি। এর বেশি কিছু জানি না।
সেদিন আমাদের খেলা ছিল। আমরা সবাই হতাশ হয়ে পড়ি। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ হিসেবে আমরা খেলব না। এরপর মালয়েশিয়া ফুটবল ফেডারেশনের লোকজন এলো, তাদের সঙ্গে কোরিয়ার ম্যানেজারও ছিলেন। আমরা তাদের বললাম, মানসিকভাবে কোনো ফুটবলারই খেলার জন্য প্রস্তুত নন। অ্যাম্বাসি থেকেও আমাদের বোঝাল- তোমরা যদি এখন না খেলো এটা তো বিশ্বব্যাপী নিউজ হবে। তোমরা দেশেও ফিরতে পারবে না। তখন আমাদের ম্যানেজার বললেন, সালাউদ্দিন জিদ করো না, খেলো। তখন আমি বলেছিলাম, খেলার আগে বাংলাদেশের পতাকাটা অর্ধনমিত রাখতে হবে। তখন মালয়েশিয়ার ফুটবল ফেডারেশন বলল, ঠিক আছে- আমরা তা করে দেব। আর কোরিয়ানরা বলল, তোমরা ঘাবড়িও না; আমরা তোমাদের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলব। আমরা জানি, তোমাদের খেলার কোনো মানসিকতা নেই। মাঠে এসে দাঁড়াও, না দাঁড়ালে তোমাদেরই ক্ষতি হবে। আর আমরা তো নিউজটা এখনও কমপ্লিটলি জানি না, আসলে কী হয়েছে। শুধু নিশ্চিত ছিলাম যে বঙ্গবন্ধু শহিদ হয়েছেন। এ খেলায় পতাকা অর্ধনমিত ছিল। সেখান থেকে দেশে আসতে ১৫-২০ দিন লেগেছিল। কারণ ফ্লাইট ছিল না, আরও অনেক ঝামেলা ছিল। বাংলাদেশে আসার আগেই শুনেছি আমার বন্ধু শেখ কামালও শহিদ হয়েছে। ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনার পর যখন দেশে ফিরলাম তখন একবারে অচেনা মনে হলো প্রিয় বাংলাদেশকে। ধানমন্ডি এলাকা বা আবাহনী ক্লাব সব যেন অচেনা মনে হতে লাগলো। সে-সময় মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছিলাম। পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলা করাটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমার খালি মনে হতো, আমি কেন দেশে ফিরে এলাম তা নিজেই জানি না। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা বাংলাদেশ ছিল না। বাড়ি থেকে বের হতে পারতাম না। আবাহনী ক্লাবে যেতে পারতাম না।
এরপর আপা (বাংলাদেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) যখন দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন, তারপরে তার সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। সেটা তো খুব হৃদয়বিদারক ছিল। আপা ফিরেছেন বলে একদিকে আনন্দ ছিল, তবে বেদনাটাই ছিল বেশি। আমার বন্ধু কামাল নেই। আমাকে দেখে আপা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। কারণ তার মাথার মধ্যে পুরনো স্মৃতিগুলো ফিরে এসেছিল।
এসব কথা লিখতে এখনও আমার চোখে পানি এসে গেছে। আমি যেন ফিরে গেছি সেই সময়ে। সেই ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে। একটা কথা না বলে পারছি না। এই তো এ-বছরই যখন ব্রাজিলের গোলরক্ষক জুলিও সিজার ঢাকায় এসেছিলেন, তখন তাকে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ছিল ববি (রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক)। সিজারকে যখন ভেতরে নেওয়া হচ্ছিল, তখন ববি আমাকে বলেছিল- মামা আপনিও যান। কিন্তু আমি ভেতরে যাইনি। কারণ আমি ভেতরে গেলে ছবিগুলো দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারব না। তখন আমি ববিকে বলেছিলাম, ববি তুমি নিয়ে যাও, আমি এখানে ঢুকতে পারব না। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর রক্তে মিশে ছিল ফুটবল। তিনি নিজে ফুটবল খেলেছেন। শেখ কামাল আর শেখ জামালও ফুটবল খেলেছেন। ফুটবল নিয়ে তার যদি ভালোবাসা না-ই থাকত, জাতীয় দল যখন বিদেশে যায়, শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের ফটোসেশনের জন্য সময় কীভাবে দেন? ওখানেই প্রমাণ হয়ে যায় ফুটবল নিয়ে তার স্বপ্ন কতটা ছিল। আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শত ব্যস্ততার মাঝে ছেলেদের টিম কিংবা মেয়েদের টিম যারাই ভালো করে, তাদের নিজের কাছে ডেকে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যা করেছেন, একই কাজ করছেন তিনিও। খেলাধুলা নিয়ে বাবা আর মেয়ের আন্তরিকতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আজকের ক্রীড়াঙ্গন যে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে তার পেছনে বঙ্গবন্ধুর অবদান অসামান্য। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
 
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK