বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ২২:১৫
ব্রেকিং নিউজ

পিলখানা হত্যাকাণ্ড সুদূরপ্রসারী এক ষড়যন্ত্র

পিলখানা হত্যাকাণ্ড সুদূরপ্রসারী এক ষড়যন্ত্র

অভিমত

 
মোহাম্মদ হানিফ হোসেন
 
বাংলাদেশের ইতিহাসে আরও এক জঘন্য ও ঘৃণ্যতম অধ্যায় হলো ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির বিডিআর হত্যাকাণ্ড। পাকিস্তানীরা একাত্তরে যেভাবে বাঙালিদের ওপর নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছিল সেদিন ঠিক তারই একটি খণ্ডিত চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছি পিলখানায়। দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন হত্যাযজ্ঞ চলে এক পৈশাচিক উন্মাদনায়।  দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয় পিলখানার বধ্যভ‚মিতে। আমাদের জাতীয় জীবনের কলঙ্কময় অধ্যায়ের সাক্ষ্য হয়ে আছে ২৫ মার্চ কালরাতের নৃশংসতম ঘটনা, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ড, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ ২৪ জনের হত্যাকাণ্ড এবং ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। এই ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশের মানুষকেই মর্মাহত, বিস্মিত ও আতঙ্কিত করেনি, বিশ্ববাসীকেও হতবাক করেছে। মেধাবী ও দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের নির্মম হত্যাকাণ্ড জাতির এক কলঙ্কিত অধ্যায়। একটি সদ্য নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মাত্র ৪৭ দিনের মাথায় দেশকে অস্থিতিশীল, সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বিপন্ন করতেই এই ষড়যন্ত্রমূলক নির্মম ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। বলা চলে সুপরিকল্পিতভাবে বিদ্রোহের নামে ঘটানো হয়েছিল এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রæত সময়ে উদ্যোগ নিয়ে এই নৃশংস ঘটনা প্রতিকারে সফল হয়েছেন। তার সহযোগিতা ও সহমর্মিতা পেয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার হত্যাকান্ড এমন এক সময় ঘটেছিল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তখন সবেমাত্র বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসেছে। এই আকস্মিক ঘটনা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছিল। সারাদেশের মানুষ স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশে কীভাবে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। তবে পিলখানা ট্র্যাজেডির শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। এটা নিছক হত্যাকাণ্ড ছিল না, ছিল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ব্যর্থ করে দুটি নিয়মাবর্তী বাহিনীর মধ্যে স্থায়ী অস্থিরতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তি জড়িত ছিল। সরকার অত্যন্ত দক্ষতা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ওই বিদ্রোহ মোকাবেলা করেছিল। তা না হলে সারা দেশে এ বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ত। যা সামাল দেয়া রাষ্ট্রের পক্ষে হয়তো সম্ভব হতো না। 
অভিযোগ রয়েছে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা বিএনপির নেতা যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক ফজলুর রহমানসহ আরও কয়েকজন। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্থানীয়ভাবে কাজ করে বিএনপি নেতা নাসিরুদ্দিন পিন্টু। পাকিস্তানভিত্তিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এ ঘটনার পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল বলে সেসময়কার পত্রপত্রিকায় খবর এসেছিল। অভিযোগ রয়েছে বিডিআর বিদ্রোহের দিন লন্ডন থেকে তারেক রহমান ফোন করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছাড়তে বলেছিলেন। উল্লেখ্য, এই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে, কারণ বিদ্রোহ শুরুর আগেই খালেদা জিয়া সকালে বাড়ি ছাড়েন। সে সময় কোন কোন মহল থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার প্রেক্ষিতে বিডিআর-এর কয়েকজন সদস্য নৃশংস, জঘন্য হত্যাকাণ্ড চালায় সেনাবাহিনীর অফিসারদের ওপর। তবে এটা ছিল নিছক অজুহাত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তির সরকারের ওপর আক্রোশ থেকে উগ্র মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী এটা ঘটিয়েছে, আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের সহযোগিতায়। সেনাবাহিনীর মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার সম্পর্কে যাতে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয় তারই অপচেষ্টায় অংশ হিসেবে দেশবিরোধী ও মানবতাবিরোধী চক্র এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। আত্মঘাতী বিদ্রোহীদের তৎপরতা যে সুগভীর ষড়যন্ত্র তা  শ্বেতপত্রে প্রকাশিত হয়। এ সুগভীর ষড়যন্ত্র দেশ, জাতি, গণতন্ত্র, বাঙালিত্ব ও সরকারের বিরুদ্ধে চালিত। দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ সব সময়েই গণতন্ত্রের পক্ষে অপশক্তির বিরুদ্ধে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত সরকারের জন্য বড় পরীক্ষা ছিল। সরকার এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু সরকারের শত্রুপক্ষ নির্মূল হয়নি। তারা এখনো নানাভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা এখন বিডিআর আর সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। 
হত্যাকাণ্ড যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। কেবল তাই নয়, দুর্ঘটনায় শহীদ অফিসারদের হেলিকপ্টারে করে লাশ বহন করা ও  পরিবারকে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ১. প্রধানমন্ত্রী সব পরিবারকে (সর্বমোট ৬১টি পরিবার) ১০ লাখ টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। ২. সব শহীদ পরিবার পেনশন কম্যুটেশন বেনিফিট পেয়েছেন। ৩. সেনাবাহিনী কল্যাণ তহবিল থেকে সব পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে অনুদান প্রদান করা হয়েছে। ৪. সেনাবাহিনী পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্প তহবিল থেকে সব পরিবার ৮ লাখ টাকা (সৈনিক পরিবার ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা) করে পেয়েছেন। ৫. বিডিআর তহবিল থেকে সব পরিবার (সৈনিক পরিবার ছাড়া) ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান পেয়েছেন। সৈনিক পরিবার স্যাপার্স কল্যাণ তহবিল থেকে ৩ হাজার টাকা পেয়েছেন। ৬. অফিসার কল্যাণ তহবিল থেকে সব পরিবার নির্ধারিত হারে (পিতা/মাতা, স্ত্রী ও সন্তান) ভাতা পেয়েছেন। ৭. ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রত্যেক পরিবারকে (সৈনিক পরিবার ছাড়া) মাসিক ৪০ হাজার টাকা করে (বার্ষিক ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা) ১০ বছর পর্যন্ত মোট ৪৮ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। সৈনিক পরিবারকে সেনাবাহিনী কল্যাণ তহবিল থেকে মাসিক ১০ হাজার টাকা করে (বার্ষিক ১ লাখ ২০ হাজার টাকা) মোট ১০ বছর পর্যন্ত ১২ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। ৮. ২ লাখ টাকার ট্রাস্ট ব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ড প্লেসমেন্ট শেয়ার গ্রহণ করেছে ৫৬টি পরিবার। ৯. প্রত্যেক পরিবার সিএসডি থেকে এককালীন ২১ হাজার ৩০০ টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং সিএসডি ডিসকাউন্ট কার্ড পেয়েছেন। ১০. শহীদ পরিবারের ৪ জন সদস্য ভর্তি/টিউশন ফি ছাড়া বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছেন। ১১. সেনাবাহিনীর অধীন বিভিন্ন স্কুল/কলেজে অধ্যয়নরত শহীদ পরিবারের মোট ৪৫ জন শিশুর ভর্তি/টিউশন ফি মওকুফ করা হয়েছে। ১২.  সেনাবাহিনী অধীন নয় এমন স্কুল/কলেজে অধ্যয়নরত (পিটারপেন, রাজউক, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল, শাহীন স্কুল) শহীদ পরিবারের মোট ৩২ জন শিশুরও ভর্তি/টিউশন ফি মওকুফ করা হয়েছে। ১৩. শহীদ পরিবারের মোট ১১ জন ছেলেমেয়েকে বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৪. মোট ৩১ জন শহীদ পরিবারের সদস্যকে বিভিন্ন চাকরি দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৩ জন বিদেশে চাকরি পেয়েছেন (দুজন লন্ডনের বাংলাদেশ হাই কমিশন এবং একজন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশন)। ১৫. সব শহীদ পরিবার সিএমএইচে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাচ্ছেন। ১৬. মোট ৬০টি পরিবারের মধ্যে (একজন অবসরপ্রাপ্তসহ) ১২ জন অফিসার আগেই ডিওএইচএস/রাজউকের প্লট পেয়েছিলেন। বাকি ৪৭ জনকে চাকরির দৈর্ঘ্য বিবেচনায় নিম্নলিখিতভাবে প্লট/ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে- ক. ৩৮টি শহীদ পরিবারকে ডিওএইচএস মিরপুর, মহাখালী ও চট্টগ্রামে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খ. ৬টি শহীদ পরিবারকে ডিওএইচএস মিরপুরে ২টি করে ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে। গ. ৪টি শহীদ পরিবার যারা পুনর্বিবাহ করেছেন তাদের ডিওএইচএস মিরপুর একটি করে ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে (১৮ বছর চাকরি পূর্ণ না হওয়ায় প্লটপ্রাপ্ত হননি)। ঘ. সৈনিক পরিবারকে সাভার খেজুরটেক সেনাপল্লী আবাসন প্রকল্পে ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে। ১৭. সকল শহীদ পরিবারকে এএইচএসে প্লট ( সৈনিক পরিবার ছাড়া) প্রদান করা হয়েছে যা, ডিওএইচএসে প্লট প্রাপ্তির অতিরিক্ত। শহীদ একজন সৈনিকের পরিবারকে সাভার খেজুরটেক সেনাপল্লী আবাসন প্রকল্পের বিনা মূল্যে ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে। ১৮. সকল শহীদ পরিবারের সেনানিবাসের বাসায় অবস্থানকালে সামরিক টেলিফোন সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। ১৯. ১৫টি শহীদ পরিবারের হাউস বিল্ডিং লোন (মূলসহ) মওকুফ করা হয়েছে। ২০. সেনানিবাসে অবস্থানরত সব শহীদ পরিবারকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দুগ্ধ কার্ড এবং ঘি প্রদান করা হয়েছে। ২১. ৩টি শহীদ পরিবারের কম্পিউটার লোন মওকুফ করা হয়েছে। ২২. আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য ০৫ (পাঁচ) জন শহীদ অফিসারের পিতা/মাতাকে সেনাবাহিনী কল্যাণ তহবিল থেকে ২০১৬ সালে ১৫ লাখ টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। ২৩. এখন পর্যন্ত শহীদ পরিবারদের চাহিদা অনুযায়ী প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকারের এই উদার সহযোগিতা সত্যিই মনে রাখার মতো।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে অপশক্তি যে নোংরা রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ করতে চেয়েছিল তারা সফল হয়নি। তারা সফল হবেও না। আসলে অভ্যন্তরীণ কোন সংঘ বা সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ বা সংঘাতে কোন গণতান্ত্রিক সরকার সম্পৃক্ত থাকে না। ঘটনা সংঘটনের পর তার সুষ্ঠু ও আইনানুগ সমাধানই সরকারের দায়িত্বের অংশ। শেখ হাসিনা সরকার সেই সমাধানের সঠিক কাজটিই করেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনায় যেসব সেনা কর্মকর্তা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন আমরা তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক সেটা কাম্য নয়। 
 
লেখক : রাজনৈতিক কর্মী  
 
 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK