বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৭:৪১
ব্রেকিং নিউজ
এই উৎসব কোনো ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়

ব্রাহ্মসমাজের ১৯৩তম মাগোৎসব পালিত

ব্রাহ্মসমাজের ১৯৩তম মাগোৎসব পালিত

রাজিয়া সুলতানা : দাঁড়াও মন, অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড-মাঝে আনন্দসভা ভবনে আজ/ বিপুল মহিমাময়, গগণে মহাসনে বিরাজ করে বিশ্বরাজ/— দরাজ গলায় গাইলেন খায়রুজ্জামান কাইয়ুম। সমবেত কণ্ঠে— ‘প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে/ মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ/ তব ভুবনে তব ভবনে/ মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান/’— বিশ্ববীণার একঝাক শিল্পীর সুললিত কণ্ঠে পরিবেশিত হলো আরো অনেক গান। অভ্যাগত দর্শক-স্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন। গানের সুর-লয়-তালের বাইরে যেন সবটাই স্তব্ধ। সবাই নিমগ্ন। এই গল্পকথা ব্রাহ্মসমাজের ১৯৩তম মাগোৎসবের তৃতীয় দিনের। 
 
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনিঃশেষ গানের ভাণ্ডার থেকে— ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দ ধারা’ শীর্ষক ব্রহ্মসঙ্গীতানুষ্ঠানের পরিবেশনা ছিল মাগোৎসবের তৃতীয় দিনে। বিশ্ববীণার শিল্পীদের অনুপম সুরারোপের নেপথ্যে ছিলেন— বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী খায়রুজ্জামান কাইয়ুম। তার নেতৃত্বে বিশ্ববীণার শিল্পীরা পরমেশ্বরকে সন্তুষ্ট করার আকূল নিবেদন করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রহ্মসঙ্গীত পর্বের গানে গানে। 
 
ঈশ্বর এক ও চিন্ময়। তিনি নিরবয়ব, অনন্ত, সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান। তিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, নিয়ন্তা, বিধাতা। তিনি জ্ঞানময়, মঙ্গলময়, প্রেমময়, পুণ্যময়, আনন্দময়— এই সত্যবিশ্বাসকে ধারণ করে ‘বাংলাদেশ ব্রাহ্মসমাজ ঢাকা’ ৪দিন ব্যাপী মাগোৎসব পালন করেছে। ৭ মাঘ রবিবার উদ্বোধনের পরের দিন বিরতি দিয়ে ৯ হতে ১১ মাঘ পর্যন্ত মোট ৪ দিন ১৯৩তম মাগোৎসব ব্রাহ্মসমাজের ঢাকা কার্যালয়ে মহাধূমধামে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
 
৭ মাঘ [২২ জানুয়ারি] রবিবার উদ্বোধনী সন্ধ্যায়, ১৯৩তম মাগোৎসবের সূচনা হয়। পর্যায়ক্রমে ব্রহ্মউপাসনা ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধান দিবস স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। মাগোৎসবের দ্বিতীয় দিনে ছিল বালক-বালিকাদের গান ও কবিতা আবৃত্তির প্রতিযোগিতা। এই আয়োজনে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীরা অংশ নিয়েছে।
 
 
উপাসনা ভবন প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে ১১ মাঘ [২৬ জানুয়ারি] ব্রাহ্মসমাজের রীতি-নীতি-আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে শেষ হয়েছে মাগোৎসবের চতুর্থ দিন। সমাপনী দিন সূচিত হয়েছে পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় পর্ব আবেশিত হয়ে উঠে বৈতালিক ব্রহ্মসঙ্গীতে। সকাল ১১ টায় শুরু হয় প্রধান উপাসনা পর্ব। সেখানেই আয়োজন ছিল ব্রাহ্মসমাজের নানা উপদেশ, ধ্যান ও সম্মিলিত প্রার্থনা পর্ব। সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান সাজানো ছিল শান্তিবাচন, ধীপায়ন, প্রীতি ও শুভেচ্ছাবার্তায়। রাতে পতাকা অবনমনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়েছে এবারের ১৯৩তম মাগোৎসব। 
 
দোতলাসম উঁচু একতলা লাল রঙের ভবনে নকশাদার ফলকে সাদা রঙে লেখা—ব্রাহ্ম সমাজ। এটি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের মন্দির। অবস্থিত পুরানোর ঢাকার পাটুয়াটুলীতে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ঠিক পাশেই। ১৮৬৯ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মন্দির প্রতিষ্ঠায় কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক দীননাথ সেন প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। এই মন্দিরে প্রতিবছরই মাগোৎসবসহ নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়।
 
ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ নামে যাত্রা করেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। যা এখন বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ নামে পরিচিত। কিছুদিন আগে শত বছরের পুরোনো ভবনটির সংস্কার হয়েছে। আচার্য  দীপক পাল মন্দিরের প্রার্থনাসভাসহ বিভিন্ন কার্যকম পরিচালনা করেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ আসতে পারেন। আর মাগোৎসব হচ্ছে বিশ্ববাসীর একমাত্র অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন ধর্মোৎসব। এই উৎসব কোনো ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে গণ্ডীবদ্ধ নয়।’ তিনি আরো জানিয়েছেন, ‘এই মন্দিরে প্রতি রবিবার প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। বিশেষ বিশেষ দিনে মন্দিরে উৎসব হয়। এখানে বেদের সঙ্গে সঙ্গে কোরআন, ত্রিপিটক, বাইবেলও পাঠ করা হয়। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ১৯২৬ সালে এই মন্দিরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন। তিনি এখানে প্রার্থনাও করেছেন।’ 
 
জানা যায়, বেদান্তের একেশ্বরবাদের ওপর ভিত্তি করে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ গঠন করেন। পরে এটি ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয়। ব্রাহ্মরা নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনা করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ ও কুসংস্কার দূর করা এবং সবধরনের মুর্তিপূজা থেকে সরিয়ে আনার আহ্বান নিয়ে ব্রাহ্মসমাজের আত্মপ্রকাশ। এই আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেনসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। ১৯ শতকে গঠিত ব্রাহ্মসমাজ সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনে বাংলার পূনর্জাগরণের পুরোধা হিসেবে পরিচিত। ১৮৩০ সালের ২৩ জানুয়ারি (১১ মাঘ), জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এক অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে ব্রাহ্মসমাজের ঘোষণা করেন। এরপর থেকে ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা এই দিনটিকে মাঘোৎসব হিসেবে পালন শুরু করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজকে আনুষ্ঠিকভাবে সাংগঠনিক রূপ দান করেন। 
উত্তরণবার্তা/আসো

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK