শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৯:০০
ব্রেকিং নিউজ

হোয়াটসঅ্যাপের বিকল্প তুর্কি অ্যাপ ‘বিপ’ কেন জনপ্রিয় হচ্ছে?

হোয়াটসঅ্যাপের বিকল্প তুর্কি অ্যাপ ‘বিপ’ কেন জনপ্রিয় হচ্ছে?

উত্তর বার্তা তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক : গত কয়েকদিন ধরে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন ব্যবহার নীতি নিয়ে তুরস্কে চলছে যথেষ্ট তর্ক-বিতর্ক।নতুন ব্যবহার নীতি অনুযায়ী হোয়াটসঅ্যাপ তার ব্যবহারকারীর সব তথ্য তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে।  ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ব্যবহারকারীদের এই নতুন গোপনীয় নীতি চুক্তি অবশ্যই সই করতে হবে। না করলে তাদের হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাবে এবং তথ্যগুলো ফেরত দেয়া হবে না। তুরস্কসহ প্রায় দেড়শ দেশে এই নতুন নীতি প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এবং আমেরিকা এ নীতির বাইরে থাকবে।  তুর্কি অ্যাপ বিপ (BiP) স্বভাবতই তুরস্কের জনগণ ও সরকার হোয়াটসঅ্যাপ এ নতুন নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার।  তুর্কি জনগণ হোয়াটসঅ্যাপ বয়কটের ডাক দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ও তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আনাদলু এজেন্সির চিফ রিপোর্টার সরোয়ার আলম বলেন, সরকার হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল তদন্ত শুরু করেছে। তুরস্কের বাজার প্রতিযোগিতা তদারকি বোর্ডও হোয়াটসঅ্যাপের নতুন নীতির খুঁটিনাটি বিষয় ঘেটে থেকে সরকারকে একটা গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট প্রদান করবে।  হয়ত তুরস্কে হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ হয়েও যেতে পারে।  সেক্ষেত্রে বিকল্পও প্রস্তুত রেখেছে সরকার। রাষ্ট্রীয় টেলিকম সংস্থা তুর্কসেলের অ্যাপ বিআইপি (BIP)  উচ্চারণ "বিপ"। তুরস্কের সবচেয়ে বড় টেলিকম সংস্থা তুর্কসেল ২০১৩ সালে চালু করে এই অ্যাপটি।  ইতিমধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। বিপের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত কয়েকদিনে তুর্কসেলের এই অ্যাপটি নতুন করে ৪০-৫০ লাখ ব্যবহারকারী ডাউনলোড করেছে।  এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ডাউনলোড করেছে ৬ কোটিরও বেশি গ্রাহক।
তুরস্কের প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম ডেইলি সাবাহ বুধবার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন প্রায় দুই মিলিয়ন করে নতুন গ্রাহক তৈরি হচ্ছে বিপ অ্যাপের।

হঠাৎ জনপ্রিয়তায় বিপ
২০১৩ সালের নভেম্বরে প্রথম চালু হওয়ার পরে গত ৭ বছরে সাড়ে চার কোটি গ্রাহক ডাউনলোড করেছে অ্যাপটি।  আর গত কয়েক সপ্তাহে ডাউনলোড হয়েছে প্রায় এক কোটি।  ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১৬৬ দেশ থেকে এই অ্যাপটি ডাউনলোড করেছে মত ২৬ লাখ লোক।  ২০১৭ সালে মোট ব্যবহারকারী হয় ১ কোটি ৮০ লাখ।
২০১৮ সালের নভেম্বরে এই সংখ্যা পৌঁছে ৩ কোটি ৪০ লাখে।২০১৯ সালে তুরস্কের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত আপগুলোর মধ্যে এক নম্বরে ছিল হোয়াটসঅ্যাপ আর ২০ নম্বরে ছিল বিপ । সে বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তুরস্কে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতো ৪ কোটি ৩৫ লাখ লোক। ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সারা বিশ্বে বিপ ব্যবহারকারী সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৫০লাখ। আর ২০২১ এর জানুয়ারিতে এসে বিশ্বের ১৯৬ দেশে বিপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ছাড়িয়েছে।

এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী Bip অ্যাপ ডাউনলোড করেছে ৬ কোটিরও বেশি গ্রাহক।
এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী Bip অ্যাপ ডাউনলোড করেছে ৬ কোটিরও বেশি গ্রাহক।
তুরস্কের ইন্টারনেট এবং মোবাইল ব্যবহার পরিসংখ্যান
সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৮ কোটি।  এদের শতকরা ৯৯.৯ ভাগ অর্থাৎ ৮ কোটি ২০ লাখ লোক মোবাইল ব্যবহার করে।  এদের মধ্যে ৭ কোটি ৬৫ লাখ গ্রাহক ৪.৫জি এবং ৪৪ লাখ ৩জি টেকনোলজি ব্যবহার করে।২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী জনসংখ্যার শতকরা ৭৪ ভাগ অর্থাৎ ৬ কোটি ২০ লাখ লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। (বর্তমানে আরও বেশি) আর জনসংখ্যার শতকরা ৬৪ ভাগ লোক অর্থাৎ ৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ইউটিউব, পরে ক্রমানুসারে ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেইসবুক, টুইটার, ফেইসবুক মেসেঞ্জার, পিন্ট্রেস্ট, লিঙ্কডইন, স্নাপচ্যাট, টিকটক, স্কাইপ, টুইচ, টাম্বলার, রেডিট, উইচ্যাট, লাইন। উপরের তালিকা থেকে স্পষ্ট যে তুরস্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় মোবাইল অ্যাপগুলোর তালিকায় একটিও দেশীয় অ্যাপ নেই।

বিপ কি হোয়াটসঅ্যাপের জায়গা দখল করতে পারবে?
এ প্রশ্নের জবাবে তুর্কি সাংবাদিক সরোয়ার আলম বলেন, সরকার যদি জনগণকে বিপ ব্যবহার করতে বাধ্য না করে তাহলে সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ সরকার যদি হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ করে না দেয়, তাহলে বিপুল সংখ্যক জনগণ স্বেচ্ছায় হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ করে বিপে যাবে এমনটা ধারণা করা ভুল।  কারণ এখানে আরও অনেক পপুলার অ্যাপ আছে যেমন, টেলিগ্রাম, লাইন।  তবে বিপের আছে উন্নত কল কোয়ালিটি, ব্যবহারে সহজ, ডাটা নিরাপত্তা, তৃতীয় কোন পক্ষের বিজ্ঞাপন ছাড়াই নির্বিঘ্নে ব্যবহার করার মত বিভিন্ন সুবিধা। আর এতে একত্রে ছয়জনের সাথে ভিডিও কনফারেন্স করা সম্ভব।    

হোয়াটসঅ্যাপের বিরুদ্ধে তুরস্ক কি পদক্ষেপ নেবে?
তুরস্কের সরকার চাইবে হোয়াটসঅ্যাপ যেন তুরস্কে তাদের অফিস খুলে ব্যাবহারকারীদের সব তথ্য তুরস্কেই রাখে এবং তুরস্কের আইন মেনে সব কাজ করে।  ইতিমধ্যে গুগল, ইউটিউব এবং ফেইসবুকের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে সরকার এবং তাদেরকে তুরস্কে অফিস খুলতে বাধ্য করেছে।
প্রথমে ধাপে ধাপে বিশাল অংকের জরিমানা এবং পরে তুরস্কে তাদের এক্সেস বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গুগল, ফেইসবুক, ইউটিউবকে এগুলো করাতে বাধ্য করছে।  এখন হোয়াটসঅ্যাপের সঙ্গে কী চুক্তি হয় দেখার বিষয়।

বিপ কি মুসলিম অ্যাপ?
কাগজে কলমে তুরস্কের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ মুসলমান। আর বিপ পুরোপুরি তুর্কি প্রকৌশলীদের মাধ্যমে তৈরি একটি অ্যাপ।  সে হিসেবে মুসলমানদের অ্যাপ বলাই যায়।  কিন্তু যদি ইসলামী মূল্যবোধ, বা ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসারীদের বুঝানো হয়, তাহলে এই বিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি এবং ব্যক্তিবর্গ সে হিসেবে কতটুকু ইসলামিক তা বলা কঠিন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত তুর্কি সাংবাদিক সরোয়ার আলম বলেন, তুর্কসেল তুরস্কের একটি ইন কর্পোরেটেড কোম্পানি। তুরস্কের সবচেয়ে বড় মোবাইল সেবাদানকারী কোম্পানি। তুরস্ক ছাড়ও আরও ৮টি দেশে মোবাইল সেবাদান করে। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানিটির মালিক মেহমেত এমিন কারামেহমেত। তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধনী ব্যাক্তি। তুরস্কের হুররিয়াত পত্রিকার ২০০৪ সালে প্রকাশিত এক খবর অনুযায়ী এই কারামেহমেত আমেরিকার ইহুদি লবি সংগঠন দি জিউশ ইন্সিটিউট ফর ন্যাশনাল সেক্যুরিটি অফ আমেরিকা (JINSA) নামে একটি সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করে। এমনকি তার সাথে জার্মান ভিত্তিক প্রভাবশালী ইহুদি পরিবার রথচাইল্ড ফ্যামিলির ঘনিষ্ঠতা এবং একত্রে ব্যবসার ইতিহাস আছে।

আনাদলু এজেন্সির চিফ রিপোর্টার সরোয়ার আলম বলেন, তুর্কসেলের আরেক প্রতিষ্ঠাতা মুরাত ভারগি এখন ফ্রান্সে বসবাস করছেন।  তাদের হয় তো এখন এই ইহুদি গ্রুপগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই।  যদিও তা অসম্ভব।  কারণ বর্তমান এই বিশ্বায়নের যুগে আপনি সকলের সঙ্গে ব্যবসা করতে বাধ্য। আর তুরস্ক এমন এক ভৌগোলিক অবস্থানে আছে যেখানে ইহুদি, খ্রিস্টানদের সঙ্গে ব্যবসা ছাড়া আপনি রাতারাতি বড় হতে পারবেন না।

তিনি বলেন, বর্তমানে তুরস্কের সরকার কোম্পানিটির শতকরা ২৬.২ ভাগ সম্পত্তির মালিক। কারামেহমেতের কোম্পানি চুকুরোভা হোল্ডিং ১৩.৮১ শতাংশের মালিক। রাশিয়ার প্রাইভেট কোম্পানি আলফা গ্রুপের মালিকানায় আছে ১৩.২২ শতাংশ। আর বাকি ৪৮.৯৫ শতাংশ শেয়ার আছে তুরস্কের পুঁজিবাজারে।  অর্থাৎ জনগণের মালিকানায়।

আনাদলু এজেন্সির চিফ রিপোর্টার সরোয়ার আলমের মতে, যে কোনো কিছু ব্যবহারের আগে যেন মুসলিম, খ্রিস্টান বা ইহুদি ট্যাগ লাগানো না হয়। মুক্তবাণিজ্যের এই বিশ্বে ব্যবসার ক্ষেত্রে লাভকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে নয়।
উত্তরণ বার্তা/এআর


 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK
আরও সংবাদ
আরও সংবাদ