শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৬:২৬
ব্রেকিং নিউজ

গিরিরাজ হিমালয়-শেখ মুজিব

গিরিরাজ হিমালয়-শেখ মুজিব

ইনাম আহমদ চৌধুরী: বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন মহাত্মা গান্ধীর তিরোধানে বলেছিলেন, “আগামী প্রজন্মের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে যে তাঁর মতো রক্তমাংসের গড়া একজন মানুষ কোনোকালে পৃথিবীর বুকে পদচারণা করেছিলেন।” সত্য, সাম্য ও ন্যায়ের ধ্বজাধারী কালজয়ী বিপ্লবী কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, “হিমালয় (পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত) তিনি কখনও দেখেন নি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেই তাঁর হিমালয় সন্দর্শন হয়েছিল।” বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এ ছিল একটি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। বাস্তবিকই পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানবিক উচ্চতার আরেকজন জননায়কের দেখা মেলে না যিনি সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির প্রতিবাদী হয়ে, মাতৃভাষার ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ধ্বজাধারী হয়ে একটি জাতিসত্তার সৃষ্টি করেন। সকলের প্রতি ভালোবাসা ও অহিংসার বাণী নিয়ে চরম রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার অসাধ্য সাধন করেছিলেন। ভাবলে গৌরব মিশ্রিত একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয় যে এমন একটি মহামানবের ব্যক্তিগত সান্নিধ্য লাভের বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
সন, ১৯৫৩। আমি তখন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি। একুশে ফেব্রুয়ারি কলেজ প্রাঙ্গণে আমাদের উদ্যোগে স্থানীয় মালমশলা দিয়েই কর্তৃপক্ষের তুমুল বাধা সত্ত্বেও একটি শহিদ মিনার নির্মিত হলো। পুষ্পস্তবক অর্পণ করে উদ্বোধন করলাম। কলেজ কর্তৃপক্ষ রুষ্ট হয়ে ‘শৃঙ্খলাবিরোধী’ কাজের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। ২ এপ্রিল কলেজ ছাত্র-সংসদের উদ্যোগে তদানীন্তন ব্রীটানিয়া হলে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী চেতনা-বিধৃত একটি গীতি-নকশা এবং কবি-সাহিত্যিক বন্ধুবর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর কালজয়ী গান- ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’, আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে জনসমক্ষে প্রথম পরিবেশিত হলো। গীত হলো ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’, আব্দুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়্যা নিতে চায়’ এবং ঐ জাতীয় বিপ্লব ও বিদ্রোহভিত্তিক গান। পুলিশ রিপোর্ট হলো অনুষ্ঠানে হয়েছে সরকার-হটানো এবং জেল-ব্রেকিংয়ের আহ্বান। গভর্নিং বডির জরুরি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রনেতা ইকবাল আনসারী খান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ভিপি মশির হোসেন এবং জিএস-কে (অর্থাৎ আমাকে) কলেজ থেকে বহিষ্কৃত করা হলো। প্রত্যাহার দাবিতে শুরু হলো ক্লাস বয়কট ও আন্দোলন। এক পর্যায়ে আমরা দেশের প্রধান বিরোধী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তদানীন্তন রমনা রেস্ট হাউসে দেখা করলাম। তা ছিল তখন বিরাট উত্তেজনা ও শ্লাঘার ব্যাপার। সব শুনে তিনি বললেন, ‘সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে পিটিশন দাও। সুরাহা না হলে কোর্টে যাওয়া যাবে। প্রদর্শিত অভিযোগে এই বহিষ্কারাদেশ ধোপে টিকবে না।’ সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখা হলো এক দীর্ঘদেহী সুদর্শন নেতৃসুলভ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। আমি চিনতাম না, কিন্তু সহসঙ্গী দু-একজন বলে উঠলেন- এই তো শেখ মুজিবুর রহমান (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু অভিহিত নন) বিশ^বিদ্যালয়ে নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের দাবি আদায়ের সফল আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা হতে সুখ্যাত। তাকে ঘটনাটি বলা যায়। তিনি আগ্রহসহকারে আমাদের বৃত্তান্ত শুনলেন। বললেন (এই মর্মে) ‘তোমাদের কথা অবশ্য আমি আগেই শুনেছি। কর্তৃপক্ষ মাত্রাধিরিক্ত অন্যায় কাজ করেছেন। তোমাদের জোর আন্দোলন করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে। অন্য কলেজের ছাত্রদেরও সহযোগিতা চাও। আমরা সমর্থন দেব।’
আমরা বিপুলভাবে উৎসাহিত ও উদ্দীপিত বোধ করলাম। আরও জোরালোভাবে শুরু হলো আন্দোলন। বিস্তৃতিতর পরিবেশে। বস্তুতপক্ষে শেখ মুজিবের ঐ বলিষ্ঠ উৎসাহব্যঞ্জক কথাগুলো ছিল এক অর্থে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা। কিছুকালের মধ্যেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহৃত হলো। জীবনের প্রারম্ভেই এই মহান নেতার (পরবর্তীতে জাতির পিতার) এমন একটি উদ্দীপক সাক্ষাৎ হয়ে দাঁড়াল আমার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ অর্জন।
পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। ১৯৫৪-৫৫ সালের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ভিপি এএমএ মুহিত (পরবর্তীতে সচিব এবং অর্থমন্ত্রী) জিএস মাহবুব আনাম এবং জয়েন্ট সেক্রেটারি হয়েছিলাম আমি। ঐ এবং পরবর্তী দশকের সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শেখ মুজিবের ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ বা নেতৃসুলভ ভূমিকা। গবেষক লেখক সৈয়দ আবুল মকসূদ তার কাগমারী সম্মেলন বিষয়ক গ্রন্থে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বন্ধুবর জহির রায়হান ও আমার নাম উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি হয়েছিলাম আমি এবং জিএস জহির রায়হান। মনে পড়ে, তখন শেখ মুজিবের মধ্যস্থতায় কাগমারী সম্মেলনের জন্য প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ২ লাখ টাকা প্রদান এবং বহুবিধ সহায়তা করেছিলেন। ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে যখন চৌ এন লাই ঢাকা এলেন তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসীন। ঢাকার ছাত্ররা চাইল তাকে অভ্যর্থনা দিতে। সময়াভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মধ্যস্থতায় ঠিক হলো যে অতিথির মোটর শোভাযাত্রা যখন বর্তমান টিএসসি’র পাশ দিয়ে যাবে ঐ সময় তিনি সামান্য ক্ষণ যাত্রাবিরতি করবেন। তখন ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমি তাকে একটি স্বাগত অভিনন্দন সূচক মানপত্র দিয়েছিলাম এবং চৌ এন লাই সংক্ষিপ্ত উৎসাহব্যঞ্জক প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন। তখন দেশে বিদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রভূত সম্মান ও স্বীকৃতি। এ জন্যই সম্ভবত ১৯৫৭ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির কিছুটা নতুন মোড়ের ব্যাখ্যা দেবেন বলে স্থির হলো। জানুয়ারি ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘ নির্দেশিত কাশ্মীরের ‘disputed status’ এবং গণভোটের সিদ্ধান্তের বরখেলাফে ভারতভুক্তির একটি ঘোষণা ভারত সরকার দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হতো যে সরকার স্থির করলেন এ-প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যামূলক ভাষণ দেওয়ার জন্য হেলিকপ্টারে এমএস হল টেনিস কোর্টে অবতরণ করবেন এবং তার সঙ্গে থাকবেন মাত্র একজন ছাত্রদের জন্য সর্বগ্রহণযোগ্য নেতা। আর তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বস্তুতপক্ষে তার উপস্থিতির জন্যই পূর্ণ শান্তিশৃঙ্খলার মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি ও কাশ্মীরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্রদের ঐ বিরাট সমাবেশ করা সম্ভবপর হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তার বিখ্যাত ০ + ০ + ০ = ০ থিয়োরি বিশ্লেষণ করে বুঝালেন শুধুমাত্র দুর্বল বা অকার্যকর রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সখ্যতা করলে কর্মক্ষেত্রে প্রাপ্তিতে শূন্যই থেকে যায়। তাই বিশ্বমঞ্চে আত্ম-প্রতিষ্ঠা ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন শক্তিধরদের সঙ্গেও সখ্যতা ও জোট স্থাপন। [পৃ. ৩১, Sheikh Mujib, Liberation War and Bangladesh by Abdul Khaleque, বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্র সচিব এবং আইজিপি]
১৯৬০ সালে সিভিল সার্ভিস পাকিস্তানে যোগদানের পরে আমার প্রথম পোস্টিং হলো সিরাজগঞ্জের এসডিও (বর্তমানে জিলা) মহকুমা হাকিম। খুবই রাজনীতি সচেতন ও কর্মচঞ্চল জায়গা। যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই প্রদেশের জনপ্রিয় গভর্নর আজম খান (যিনি ১৯৬৫ সালে বিডিভিত্তিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু এবং অন্যদের সঙ্গে থেকে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের সমর্থিত প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দিয়েছিলেন)-এর পরিবর্তে এলেন গভর্নর মোনেম খান। কিছুদিনের মধ্যেই সম্ভবত সলঙ্গাতে একটি ডাকাতির কেসে সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (অস্থায়ী সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ)-কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জামিনের আবেদন হলে আমি নিজেই শুনানি নিয়ে যুক্তি-সমন্বিত স্বলিখিত একটি দীর্ঘ আদেশে তাকে জামিন দিলাম। গভর্নর মোনেম খান তাতে খুব রুষ্ট হয়ে আমাকে ফোন করে তার তীব্র উষ্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আমি তাকে জানাই আইন অনুসারে আমি যথাযথ কাজ করেছি বলেই আমার বিশ্বাস। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের আড়িপাতার কল্যাণে খবরটি তড়িৎ গতিতে রাষ্ট্র হয়ে গেল এবং গুজব হলো এসডিও-কে অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তা হয়নি; বরং আমার লাভ হলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে গেলাম। মনে আছে, তখন শহরের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এসে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। আওয়ামী লীগের নেতা ড. জসিম উদ্দিন সাহেব, ড. নিয়োগী প্রমুখ বললেন নেতা শেখ মুজিব এই ন্যায়োচিত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিচারকের প্রশংসা করেছেন। উৎসাহিত বোধ করলাম। ন্যায়ের প্রতি দৃঢ় সমর্থন প্রদান বঙ্গবন্ধুর একটি মহৎ চারিত্রিক গুণ ছিল। আমার জীবনেও একাধিকবার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। তিনি অন্যায়ের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করেছেন সবখানে, আর ন্যায়বিচার, সুকর্ম এবং জনকল্যাণমূলক কাজ যারা যখন করেছেন, তাদের সমর্থনে ও প্রশংসায় সব সময়ই ছিলেন সোচ্চার। আবদুল খালেক [প্রথম স্বরাষ্ট্র সচিব এবং আইজিপি, প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৩৭] উল্লেখ করেছেন “Public officials who were just and honest enjoyed his respectful address and words.” তার এই বলিষ্ঠ নীতিনিষ্ঠা এবং মানবিক ঔদার্য্যরে জন্য এলাকা-পেশা-জাতি-ধর্ম-দল-নির্বিশেষে সকলেরই তিনি ছিলেন আন্তরিকভাবে পরম শ্রদ্ধাভাজন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন (পৃ. ১৯৩), গরিব সরকারী কর্মচারীরা কখনও চায়না আমার কোনো অসুবিধা হোক। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য জনাব মতিয়ূল ইসলাম (তাঁর সরকারে বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব) ‘Recollections of a civil servant’ গ্রন্থে (পৃ. ১৯৮) উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালে কি করে তদানীন্তন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার উর্দুভাষী জনাব আলাউদ্দিন বহু প্রলোভন নিপীড়ন সত্ত্বেও ‘দেশদ্রোহিতার’ অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য লায়ালপুর সেন্ট্রাল জেলে চলমান ট্রাইব্যুনালে দেননি। এর জন্য জনাব আলাউদ্দিনকে বহু নিগ্রহ, তখন এবং পরবর্তীকালেও ভোগ করতে হয়েছিল। তিনি প্রকাশ্যেই বঙ্গবন্ধুর অন্যায়-বিরোধিতা ও নীতিনিষ্ঠার সপ্রশংস সমর্থন করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বহু বাঙালি পুলিশ এবং ডিসি ঢাকা শামসুল হক, ডিসি টাঙ্গাইল জালাল আহমদ, এসপি টাঙ্গাইল বদিউজ্জামানসহ আরও অনেকের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন (প্রাগুক্ত. পৃ. ১৯৮)। ১৯৫৯ ব্যাচের সিএসপি পশ্চিম পাকিস্তানের তারেক খান বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন এই মর্মে যে তিনিই গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী। নির্বাচনের পরে ফেব্রুয়ারি ’৭১-এ তিনি ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। পরবর্তীতে তিনি এক সময় পেশোয়ারে স্বাধীন বাংলাদেশের অনারারি কন্সাল নিযুক্ত হন। ফরিদপুরের এককালীন ডিসি, সিএসপি সিদ্দিকীর নিরপেক্ষ প্রশাসন এবং জামিন দেবার ব্যাপারে সাহসিকতা ও আইন-নিষ্ঠার প্রশংসা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-উত্তরকালেও একাধিকবার করেছেন। মনে পড়ে, ব্যাংককের জাতিসংঘ এসকাপে এসএএমএস কিবরিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে পাকিস্তান থেকে অংশগ্রহণকারী সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম নেতা বলে উল্লেখ করে বলেছিলেন, “তাঁর ও তাঁর পরিবারের বর্বরোচিত হত্যাকা- ইতিহাসের পরমতম শোকাবহ ট্র্যাজেডি। ঢাকায় ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রদূত এবং পরবর্তীতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জেএন দীক্ষিতকে একাধিকবার বলতে শুনেছি মানুষ হিসেবে ও নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তুলনাহীন।
১৯৭১ সালের ১১ বা ১২ মার্চ। সিএসপি এসোসিয়েশনের পূর্বাঞ্চল শাখার সভাপতি ছিলেন পাঞ্জাবের এসএম হাসান (আইসিএস-সিএসপি)। মাননীয় মেম্বর, বোর্ড অব রেভিনিউ। জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন মাদ্রাজের করীম ইকবাল, সিএসপি, যিনি একজন বাঙালি মহিলার (সিএসপি শামীম আহসানের বোন) পানি গ্রহণ করেছিলেন। এসোসিয়েশনের আহূত জরুরি সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে “সিএসপি অফিসারদের দায়িত্ব হচ্ছে সরকার পরিচালনায় নিয়মতান্ত্রিক সহযোগিতা প্রদান ও কর্তব্য পালন। বর্তমানে দেশে একটি সর্বগ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন হয়েছে এবং গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পার্লামেন্টে নির্বাচিত সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক দলের নেতাই অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানই সরকার গঠন করবেন। এই পরিবর্তনকালীন সময়ে সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদান এবং রাষ্ট্রীয় কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন অফিসারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ব্যাপারে তারা সচেতন এবং কর্তব্য পালনে সদা প্রস্তুত রয়েছেন।” সিদ্ধান্তের কপি প্রেসিডেন্ট, মার্শাল ল’ কার্যালয়, গভর্নর এবং পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে পাঠানো হলো। বঙ্গবন্ধুর কাছে এক কপি রুহুল কুদ্দুস সাহেব নিয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল। সঙ্গে আমিও ছিলাম। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত দেখে খুবই প্রীত ও সন্তুষ্ট বোধ করেন। এটা ছিল নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হিসেবে তার প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ। তিনি বললেন, আমি তো তোমাদের ওপর নির্ভর করব। তাকে বলা হলো “স্যার, আপনার মৌখিক নির্দেশই তো এখন সারাদেশ চলছে।” এবং সত্যিকারভাবেই তখন তাই-ই ছিল। সব অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, ব্যাংক, সংস্থা, কল-কারখানা, রেল-বাস, দোকান-পাট সবই বন্ধ হতো, খুলতো তারই নির্দেশে। প্রশাসনের সব স্তর এবং সমাজের সর্বাঙ্গের সঙ্গে একটি আশ্চর্য সুন্দর আস্থা, সম্মান ও অনুগত্যের সম্পর্ক তিনি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তার ব্যতিক্রমী সর্বত্যাগী অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের জন্যে।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান থেকে লন্ডন পিআই-এর বিশেষ বিমানে এবং লন্ডন থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্লেনে দিল্লি হয়ে ঢাকা এলেন। এর আগে ৩ জানুয়ারি করাচির এক বিরাট জনসভায় ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সম্পর্কে সর্বসম্মত ইতিবাচক মতামত যাচাই করে ৭ তারিখ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানালেন। দুদিন লন্ডন থেকে ১০ তারিখ দিল্লি এলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারি প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য হিসেবে দিল্লিতে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক আগমন ও অভ্যর্থনা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। দিল্লিতে সেই স্বল্পকালীন বিরতির সময়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ এবং দেশপ্রেমের প্রত্যক্ষদর্শীর নজির দিচ্ছি। ব্রিটিশ প্লেনে দিল্লি পৌঁছার পর তিনি খবর পেলেন তার ও সহ-সঙ্গীদের ব্যাগেজ ঐ প্লেন থেকে নামিয়ে একটি ভারতীয় প্লেনে উঠানো হচ্ছে এবং সেই প্লেনে তিনি ঢাকা যাবেন। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, তা কেন? ব্রিটিশরা তো আমাকে ঢাকাতেই যাবার জন্যে প্লেনের ব্যবস্থা করেছে। মাঝপথে তা পাল্টাবো কেন? ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানালেন যে ঢাকার বিমানবন্দর ঐ ব্রিটিশ প্লেনের অবতরনের জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে। বঙ্গবন্ধু তখন উপস্থিত বাংলাদেশের চিফ অব প্রটোকল ফারুক চৌধুরীকে বললেন, ওসব না জেনেশুনে কি তারা আমাকে পাঠাবে? খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা করো। দেখা গেল, ব্রিটিশ প্লেন অবশ্যই ঢাকা অবতরণ করতে পারবে। ব্যাগেজগুলো ব্রিটিশ প্লেনেই স্থানান্তরিত হলো। আয়োজন করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু দিল্লির পরে কলকাতায় একটি জনসভায় ভাষণ দিয়ে ঢাকা যাবেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, তা নয়। আমি প্রথমেই ঢাকা যেতে চাই। কলকাতা শিগগিরই আসব, পরে। তিনি সোজা ঢাকাই চলে এসেছিলেন তারই প্রতিষ্ঠিত নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে অপেক্ষমাণ কোটি কোটি মানুষের কাছে। দিল্লিতে স্বল্পকালীন বিরতির সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার জন্য দীর্ঘ সময় ছিল না। কিন্তু এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিলেন, তিনি আশা করছেন অদূর ভবিষ্যতেই ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করবে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘যখনই বলা হবে, ভারতীয় বাহিনী তখনই ফেরত যাবে’ এবং সেটাই ঘটেছিল ইন্দিরা গান্ধীর ১৭ মার্চ ঢাকা সফরের আগেই।
এ-প্রসঙ্গে আরও দুটো ঘটনা উল্লেখ করছি, যা জনাব মতিউল ইসলাম প্রাগুক্ত, (পৃ. ১০০, ১১৪, ১১৭) তার বইটিতেও উল্লেখ করেছেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতের কলকাতা যান। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। আলোচনাকালে ১৯৬৫ সালের তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের Vested Properties  প্রত্যর্পণের জটিল প্রশ্নটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল, ঐ সময়কার আইন ও রুলস রেগুলেশন দিয়ে যা করা হয়েছিল তা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের জন্যে পুনর্বিবেচনা বাস্তবসম্মত নয়। মিসেস গান্ধী এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করেননি। ঐ সভা চলাকালীনই তখনকার একজন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ উপদেষ্টা ডিপি ধর বঙ্গবন্ধুকে বললেন যে ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের বিধ্বস্ত রেলওয়ের পুনর্বাসনের জন্যে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তা দেখিয়ে তার অনুমোদন নেবার জন্যে পার্শ্ববর্তী কক্ষে তারা অবস্থান করছেন। মি. ধর বঙ্গবন্ধুকে ঐ কক্ষে যেতে আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু তখনই বললেন, আমার অর্থ সচিব মতিউল ইসলাম আমার পক্ষ থেকে ঐ পরিকল্পনা পরীক্ষা করে আমাকে বলবেন। মি. ধর বঙ্গবন্ধুকে যেতে আবারও অনুরোধ জানালে বঙ্গবন্ধু বললেন, “অর্থ সচিবই আমাকে রিপোর্ট করবেন।” কী কারণে বঙ্গবন্ধু তখন যাননি তা পরিষ্কার নয়, তবে এটা ঠিক যে বিষয়টি সম্পর্কে অবশ্যই পূর্বে জ্ঞাত করাবার প্রয়োজনীয়তা ছিল এবং পার্শ্ববর্তী কক্ষে যাবার আমন্ত্রণ মি. ধরের কাছ থেকে না এসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই আসা সংগত ও রীতিসম্মত হতো। এত তাৎক্ষণিক এবং যথাযথ ছিল বঙ্গবন্ধু বিচারবুদ্ধি ও আত্মসম্মানবোধ। (চলমান...... ) ১ম পর্ব

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK