মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১১:৩৪
ব্রেকিং নিউজ

এক সচেতন আমলার চোখে শেখ মুজিব

এক সচেতন আমলার চোখে শেখ মুজিব

আবুল মাল আবদুল মুহিত : আউটার স্টেডিয়ামের কাঠের গ্যালারি। বেশির ভাগ ফুটবল খেলা ওখানে জমে। সময়টা ১৯৬২-৬৩ সাল। শেখ মুজিব প্রায়ই ফুটবল খেলা দেখতে আসতেন। প্রায় পাঁচ বছর পর খেলার মাঠে তার সঙ্গে দেখা হলো। আমার চাকরি-জীবনের শুরুতে ১৯৫৭ সালে তার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল কুমিল্লায়। তখন তিনি ছিলেন প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় শিল্প ও শ্রমমন্ত্রী আর আমি কুমিল্লায় শিক্ষানবিস হাকিম। এই মোলাকাতে তিনি বহু লোকের মাঝখানে ছিলেন, তাই কুশলাদি জিজ্ঞেস ছাড়া আর কোনো আলোচনা হয়নি। ১৯৬২-৬৩ সালে তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয় এবং আলাপ-আলোচনা হয়।
১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ ছিল আইয়ুব শাহির সূচনাকাল। নতুন আইন, নতুন প্রশাসনিক উদ্যম, নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান- নানা কিছু দ্রুতবেগে সমাধা করা হচ্ছে। পাকাপোক্ত ব্যবস্থায় সামরিক স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ তারপর শুরু হলো। ১৯৫৯-এর অক্টোবরে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে অপারগতা অধ্যাদেশ (ইবিডিও) জারি করে সব প্রতিপত্তিশালী বিরোধী নেতাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে অপসারণ করলেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। কিন্তু তাতেও নতুন শাসনতন্ত্র জারির ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন না, তাই ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলেন। অমনি শুরু হলো দেশব্যাপী সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন। শেখ মুজিবের কারাবাস তখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামরিক শাসন জারির প্রথম সপ্তাহে ১২ অক্টোবর তাকে কারাবন্দি করা হয় এবং ১৯৫৯ সালের ৫ অক্টোবর প্রায় এক বছর তাকে জেলের ভাত খেতে হয়। মুক্তি পেয়েও কিন্তু হয়রানির শেষ হলো না, অনবরত মামলা-মোকদ্দমা চলল আর যখন-তখন গ্রেফতার, ১৯৬২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আবার দীর্ঘকালের জন্য তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হলো। বিরোধী শক্তিকে নির্যাতন করে, বিরোধী নেতাদের ও কর্মীদের জেলে পুরে ১ মার্চ শাহি ফরমানের জোরে আইয়ুব খান দেশকে একটি শাসনতন্ত্র উপহার দিলেন। এই শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করল ‘আইয়ুবের শাসনতান্ত্রিক স্বৈরাচার’। এই উদাহরণই অনুসরণ করেন আমাদের জেনারেল জিয়াউর রহমান, যখন ১৯৭৮ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি ফরমানের জোরে শাসনতান্ত্রিক স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিবর্তন করেন। যা-ই হোক, শাসনতন্ত্র জারি করে ২৮ এপ্রিল হলো জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ও ৫ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। অবশ্যই নির্বাচন দুটি হলো পরোক্ষ পদ্ধতিতে। প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় মৌলিক গণতন্ত্রীরা নির্বাচিত হলেন জনগণের ভোটে আর তারা নির্বাচন করলেন সংসদ সদস্যদের। কেল্লা ফতে করে আইয়ুব খান তার শত্রুদের কারামুক্তি দিলেন। ইতোমধ্যে এই প্রদেশে লাট সাহেব নিয়ে একের পর এক সমস্যা দেখা দিল। মতবিরোধের কারণে আজম খান মার্চে এবং তার উত্তরাধিকারী গোলাম ফারুক অক্টোবরে পদত্যাগ করলেন। তারপর সমাসীন হলেন প্রভুর খাস বান্দা মোনায়েম খান আর তিনি বহাল থাকলেন দীর্ঘতম সময়ের জন্য, প্রায় আইয়ুবের পতনলগ্ন পর্যন্ত (মার্চ ১৯৬৯ পর্যন্ত)।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকাপোক্ত শাসনতান্ত্রিক স্বৈরাচার নিয়ে খুবই বিচলিত ছিলেন এবং তিনি আন্দোলন শুরু করেন শুধু এই লক্ষ্যেÑ এই স্বৈরাচারী শাসনতন্ত্র বাতিল করতে বা তার গণতন্ত্রায়ণ সাধন করতে। শেখ সাহেব মুক্তি পেলেন ১৮ জুন আর সোহরাওয়ার্দী সাহেব তার দুই মাস পর। মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব নেতার এজেন্ডা নিয়ে মেতে উঠলেন। একই সঙ্গে পূর্ব বাংলার বঞ্চনা নিয়ে হলো তার মাথাব্যথা।
মরহুম জহির উদ্দিন (একসময় পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ও পরে পাকিস্তানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) সাহেবের সঙ্গে ওই সময় আমার বেশ সখ্য ছিল। পাকিস্তানের অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ৯ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটিতে আমরা মাত্র দুজন বাঙালি সদস্য। প্রতিদিনই কয়েক ঘণ্টার জন্য আমি স্টেডিয়াম এলাকায় থাকি। পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া ফেডারেশনের আমি অবৈতনিক সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু তখন আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির একজন কর্মকর্তা। সে-ও এক কাহিনি। শেখ সাহেবের রুজি বন্ধ করার জন্য আইয়ুব খান কোম্পানিটিকে দুষ্টসূচির (ব্ল্যাক লিস্ট) অন্তর্ভুক্ত করতে চান। এই সংকীর্ণমনা উদ্যোগ কিন্তু পাকিস্তানের লাট সাহেবের (জেনারেল আজম) সমর্থন পেল না। তাই আজম খান নিজের উদ্যোগে এই প্রচেষ্টা রহিত করেন। শেখ সাহেব কিন্তু এ-ব্যাপারে কারোরই সাহায্যপ্রার্থী হননি। জেনারেল আজম যখন অবসর নিয়ে লাহোরে বসবাস করেন, তখন শেখ সাহেব তার সঙ্গে দেখা করে তাকে এ জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন, বোধহয় ঘটনার দুই বছর পর। শেখ সাহেবের সম্মানবোধ ছিল খুব শক্ত। মাথা নত করা বা নিজের জন্য কিছু চাওয়া তার ধাতে ছিল না।
জহির সাহেবের সঙ্গে আউটার স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গেছি একদিন, তখনই শেখ সাহেবের সঙ্গে মোলাকাত। ছাত্রবেলায় সামান্য পরিচয় ছিল, তবে আমি ছাত্রলীগের ছিলাম না, তাই ঘনিষ্ঠতা কম ছিল। প্রগতিশীল শক্তির তখন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের যুগ, যুক্তফ্রন্টের রাজনীতিতে আমরা ছিলাম এক গোত্রীয়। ১৯৫২ সালে সলিমুল্লাহ হল ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রথম গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে সম্মিলিত হয় সব প্রগতিশীল শক্তি, শুধু মুসলিম লীগের তাঁবেদারেরা ছিল বিপক্ষে। গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টের পুরো প্যানেল অনেক ভোটে জেতে এবং আমি সেই প্যানেলে ছিলাম যুগ্ম সম্পাদক। প্রায় দেড় বছর পর জাতীয় রাজনীতিতে যুক্তফ্রন্টের জন্ম হয় ১৯৫৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে। ১৯৫২ সালে পরোক্ষ এবং ১৯৫৩ সালে প্রত্যক্ষভাবে এই ঐকমত্যের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী অভিযানে আমি ছিলাম একজন কর্মী।
১৯৬২-৬৩-তে (’৬২-এর শেষার্ধ্ব আর ’৬৩-এর প্রথমার্র্ধ্ব) ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দুর্বার আন্দোলন। ২৪ জুন ৯ নেতার আহ্বান জাতীয় জীবনে দোলা দিয়ে গেল। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মুক্তির পর (আগস্ট) এনডিএফের আবির্ভাব হলো এক ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট হিসেবে। এই সময়ে শেখ সাহেবের সঙ্গে কয়েকবারই দেখা হয়েছে খেলার মাঠে। আমি সরকারি কর্মচারী, আমার সঙ্গে তাদের আন্দোলন নিয়ে কোনোদিনই কোনো আলাপ হয়নি। তিনি শুধু সব সময় একটি বিষয় খবর নিতেন, পূর্ব-পশ্চিমের অসমতার বিশদ বিবরণ। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে তখন অনেক লেখালেখি চলছে। আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্রের এই বিষয়ে বার্ষিক প্রতিবেদনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য তো শুধু একটি ক্ষেত্রেই ছিল না, বরং এ ছিল বিভিন্ন খাতের বৈষম্যের প্রতিফল। সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় ছিল পরিসংখ্যান নিয়ে ধোঁকাবাজি ও চতুর খেলা। এই বিষয়ে তখন সরকারি পর্যায়ে আমি কিছু সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলাম। আমাদের আলোচনার বিষয় প্রায়ই ছিল পরিসংখ্যানের হেরফের এবং তাকে স্বচ্ছ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। স্মরণে থাকতে পারে যে ওই সময়ে একটি জাতীয় আয় কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়, যাতে মূল্যবান অবদান রাখেন মরহুম হাফিজুর রহমান। মাস ৬ বা ৯ ধরে শেখ সাহেবের সঙ্গে খেলার মাঠে গল্পচ্ছলে কতগুলো ব্যাপারে আমি মুগ্ধ হই।
সে যুগে আমাদের অনেকের ধারণা ছিল যে শেখ সাহেব অসহিষ্ণু দলবাজ লোক এবং নিজের মতে অনড়। অথচ ব্যক্তিগত ব্যবহারে তার মাধুর্য ও অতিথিপরায়ণতা সর্বজনস্বীকৃত। এই সময়ে আমি তার যে পরিচয় পাই, তা ছিল মনোমুগ্ধকর। যে ব্যক্তি গভীরভাবে ফুটবল খেলা উপভোগ করতে পারেন, তিনি সচরাচর খোলামেলা মানুষ। তবে একই সঙ্গে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আর হামুদুর রহমান কমিশন নিয়ে ছাত্র আন্দোলন পরিধারণ করা নিতান্তই টেনশনের ব্যাপার। খেলার মাঠের সেই পীড়ন ও উদ্বেগকে সরিয়ে রাখা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা যেত খোলামেলাভাবে, ভিন্নমত পোষণ করা যেত, তাকে শেখানো-পড়ানোরও বাহাদুরি নেওয়া যেত। এই অবস্থার পরিবর্তন দেখি ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পর। তখন তার ধৈর্যের রশি ছিল বড় সীমিত। এই মতবিনিময় এবং দেওয়া-নেওয়ার কালচারটি কেমন করে যেন আমাদের দেশ থেকে এখন বিতাড়িত হয়ে গেছে, অথচ আমরা দাবি করি যে আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি।
কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি অভিভূত করে তা হলো, শেখ মুজিবের দেশপ্রেম ও জনহিতে নিজেকে নিবেদন। দেশকে তিনি যে কী গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং দেশের মঙ্গল ছাড়া যে অন্য কিছুই তার ধ্যান-ধারণায় স্থান পেত না, সেই উপলব্ধি আমার আসে ওই পরিচয়ের মাধ্যমে। তার সারা অস্তিত্বে প্রবলতম অনুভূতি ছিল বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গলাকাক্সক্ষা, তাদের বঞ্চনা ও দুর্দশা থেকে মুক্তি। অনেক বছর পর আরেকজনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জনহিতে নিবেদন নিয়ে আলোচনা হয় মার্কিন মুলুকে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে। লস অ্যাঞ্জেলেসের অ্যাম্বাসেডর হোটেল একটি অভিজাত সরাইখানা। স্মরণে থাকে যেন, এই হোটেলেই রবার্ট কেনেডি ১৯৬৮ সালে প্রাইমারি বিজয়ের আনন্দ উৎসবে আততায়ীর হাতে প্রাণ দেন। এই হোটেলের প্রধান হিসাবরক্ষক বরিশালনিবাসী মুজিবর রহমান সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় মুক্তিযুদ্ধকালে, ১৯৭১ সালে।
১৯৫৮ সালের এপ্রিলে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের উদ্যোগে শেখ মুজিব এক রাষ্ট্রীয় সফরে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে যান। সে-সময় তিনি আমেরিকাও সফর করেন। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ধারা অনুধাবন করা। তিনি এই সময়ে মার্কিন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও নেতারা, সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠান ও কর্ণধারেরা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে আসেন। এই উপলক্ষে আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এক ধরনের ঝটিকা সফর তিনি সম্পন্ন করেন। তার লস অ্যাঞ্জেলেস সফরকালে অ্যাম্বাসেডর হোটেলের মুজিব সাহেব নিজের উদ্যোগে হন তার সহচর। মুজিব সাহেবকে শেখ সাহেব ‘মিতা’ বলে সম্বোধন করেন এবং মুজিবর সাহেবের মতে, স্বল্প সময়ে তাদের ঘনিষ্ঠতা জমে ওঠে। দিনের শেষে শেখ সাহেবের প্রতিদিনকার প্রশ্ন থাকত, ‘মিতা, আমার দেশে মানুষ কবে সুখী হতে পারবে? অন্তত অভাব ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাবে?’ প্রাচুর্যের দেশে ঘোরাফেরা করে এই ছিল বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক ভাবনা। বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্য এই ভাবনা আর ভালোবাসা ছিল শেখ সাহেবের পরিচয়চিহ্ন। ১৯৭২ সালে স্যার ডেভিড ফ্রস্ট (তখনও তিনি নাইট হননি) এই ভাবনাকে বলতেন ‘মুজিবের বিশেষ ভালো বাসাবাসি’ (‘স্ট্রেঞ্জ লাভ অ্যাফেয়ার উইথ বাংলাদেশ অ্যান্ড বেঙ্গলিজ’)। এই ভালোবাসা এবং মাথা নত না করার জন্য পাকিস্তানের ২৩ বছরে তাকে জেলে থাকতে হয় প্রায় আট বছর আর মামলা ঠেকাতে হয় প্রায় ৭০টি।
১৯৬৩ সালের পর বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসার পরবর্তী সুযোগ আমার হয় ১৯৬৯ সালের শুরুতে। এই বছরগুলোতে পরিবর্তন হয়েছে অনেক। ১৯৬৩ সালের ১ আগস্ট মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের দলে ভিড়েছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ১৯৬৩-এর ৫ ডিসেম্বর পরলোকগত হয়েছেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারিতে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার জন্য কপ বা সম্মিলিত বিরোধী দল গঠিত হলেও পরোক্ষ নির্বাচনে আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালের ৭ জানুয়ারিতে বিজয় লাভ করলেন। ওই বছরই ৬ সেপ্টেম্বর বাধল পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। ১৯৬৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব লাহোরে এক সম্মেলনে ৬-দফা কার্যক্রম ঘোষণা করলেন। এই কার্যক্রম হলো বাঙালির বাঁচার অধিকার সনদ। ৬-দফা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আইয়ুব খান এই কার্যক্রমকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাস থেকেই নানা মামলা ঠুকে শেখ সাহেবকে ধরপাকড় করা শুরু হলো এবং ৮ মে জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য গ্রেফতার করা হলো। পৌনে দুই বছর পর ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আগরতলা মামলার প্রধান আসামি করে সামরিক জিম্মায় স্থানান্তর করা হয়। একটি মজার বিষয় ছিল, আইয়ুব খানের এককালীন প্রিয় পাত্র জুলফিকার আলী ভুট্টো মার্চ মাসেই ৬-দফা নিয়ে শেখ সাহেবের সঙ্গে বিতর্ক করার চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন। তবে শেখ সাহেব যতদিন মুক্ত ছিলেন, ততদিন ভুট্টো সাহেবের সময় হলো না আর শেখ সাহেবের গ্রেফতার হওয়ার কিছুদিন পর ভুট্টো নিজেই আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত হলেন। এই বিতর্কের সুযোগ আর কোনোদিনই হলো না, ভুট্টো সযতনে তা এড়িয়ে গিয়ে সামরিক শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় এই কার্যক্রমকে ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে ডেকে নিয়ে নিয়ে এলেন ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এই ছয় বছরের সর্বশেষ উপাখ্যান হলো, দেশব্যাপী আইয়ুববিরোধী আন্দোলন।
আইয়ুব শাহির উন্নয়নের ১০ বছর উৎসব যখন চলছে, তখনই ধস নামল। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন সারাদেশে সৃষ্টি করল এক ধরনের অরাজকতা। নিষ্পেষণে ব্যর্থ হয়ে আইয়ুব খান একটি সাহসী উদ্যোগ নিলেন। ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি একটি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করলেন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি আরও ঘোষণা দিলেন যে প্রথমত তিনি ক্ষমতায় আর থাকবেন না। দ্বিতীয়ত, তার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাঙালিরা যে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তা তিনি স্বীকার করলেন। তৃতীয়ত, তিনি বিরোধীদলীয় নেতাকে তাদের প্রতিনিধি নিয়োগ করে যে কোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য আবার আহ্বান জানালেন। সর্বশেষ তিনি এ-ও বললেন, সব মনোনীত প্রতিনিধিকে বৈঠকে যোগদানের ব্যবস্থা তিনি করবেন। পরদিনই আগরতলা মামলা খারিজ করে শেষ সাহেবকে ছেড়ে দিয়ে তাকে গোলটেবিল বৈঠকের নেতৃত্বের সুযোগ করে দেওয়া হলো। মামলা যেমন ঢাকঢোল পিটিয়ে সাজানো হয়েছিল, তার অবসান হলো তেমনি সাদামাটাভাবে। আইনের মারপ্যাঁচে মামলা খারিজ করা হলো। যেহেতু জরুরি অবস্থার আওতায় মামলা চলে ও ট্রাইব্যুনাল নিযুক্ত হয়, তাই জরুরি অবস্থার অবসানে মামলা আপনা-আপনি খারিজ হয়ে গেল।
১৯৬৪ সাল থেকেই আমি কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করি, প্রথমে পরিকল্পনা কমিশনে করাচিতে এবং পরে মন্ত্রিসভা বিভাগে পিন্ডিতে। মন্ত্রিসভা বিভাগে আমরা কজন মাত্র আছি, আমাদের সচিব এবং কয়েকজন বিভাগ প্রধানসহ আমরা দুজন উপ-সচিব। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আমাদের কর্তাব্যক্তি। তবে ১৯৬৮ সালে তার প্রধান উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত আমলা ফিদা হাসান মোটামুটিভাবে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। সেই যুগে জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন হতো সংসদীয় রাজধানী ঢাকায়। আমি ১৯৬৮ সালের শীতকালীন অধিবেশনে এসেছি পিন্ডিতে আমার তল্পিতল্পা গুটিয়ে। অধিবেশন শেষে ছুটির পর ওয়াশিংটন দূতাবাসে যাব নতুন পদে। ডিসেম্বরে ফিদা হাসান ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে আমাকে বললেন যে আমার প্রোগ্রাম বদলাতে হতে পারে। একটি গোলটেবিল বৈঠক অতিসত্বর হতে পারে এবং তাহলে আমাকে পিন্ডিতে গিয়ে আরও কিছুদিন উপ-সচিবের দায়িত্ব পালন করতে হবে। গোলটেবিল বৈঠকের ঘোষণার পর আমি পিন্ডি ফিরে গেলাম। আমার দায়িত্ব বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের দেখভাল করা, থাকা-খাওয়া, যানবাহন, মোলাকাত- এসবের ব্যবস্থা করা।
মুক্তি পেয়েই ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিরাট সংবর্ধনা সভায় শেখ সাহেব ৬-দফা ও ছাত্রদের ১১-দফার প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। বাঙালির বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। স্মরণে থাকে যেন, এই ঐতিহাসিক সভায় ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ শেখ সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট-বড় অর্ধমৃত ও জীবিত সব রাজনীতিবিদ তখন আদাজল খেয়ে লেগেছেন বাঙালির বাঁচার সনদের বিরুদ্ধে। তাদের বক্তব্য ছিল, ‘এক ব্যক্তি এক ভোটের’ দাবি সমতা নষ্ট করবে। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ছাড়া দেশ চলবে না। আঞ্চলিক মিলিশিয়া দেশে নিরাপত্তা ব্যাহত করবে। বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব আঞ্চলিক ভিত্তিতে চালু করা নজিরবিহীন।
আমরা দেখলাম, এই ব্যাপারে পশ্চিমের সবাই একমত এবং সব যুক্তিকে দাঁড় করানোর জন্য পুরো আমলাগোষ্ঠী অত্যন্ত উদ্যোগী ও কর্মব্যস্ত। আমরা কজন মিলে ঠিক করলাম, আমরা তত বয়োজ্যেষ্ঠ না হলেও আমাদের কিছু কর্তব্য রয়েছে। আমাদের প্রতিনিধিদের তথ্য ও রসদ সরবরাহের দায়িত্ব আমাদের। মফিজুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, হেদায়েত আহমদ এবং আবদুর রব চৌধুরী (আমলারা) এবং অধ্যাপক ওয়াহিদুল হক ও আনিসুর রহমানকে (ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা) নিয়ে হলো আমাদের দল এবং এতে সাময়িক সহায়তা করেন আরও অনেকে; যেমন আহমদ ফরিদ, আমিরুজ্জামান, তবারক হোসেন এবং কিছু সময়ের জন্য করাচি থেকে আসা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম (পাকিস্তান উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান)। সবার নাম হয়তো এখন মনে করতে পারছি না। আমাদের বিবেচনার বিষয় ছিল, অর্থনৈতিক স্বশাসনের ব্যবস্থা এবং সামরিক ব্যয়ের অর্থহীন বোঝা হ্রাস। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি হলো গোলটেবিল বৈঠকের প্রথম অধিবেশন, মাত্র ৪০ মিনিটের সম্মেলন। স্থির হলো, বিরোধী গোষ্ঠী নিজস্ব বৈঠকে বসে তাদের সম্মিলিত দাবি প্রণয়ন করবে। ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির (ড্যাক) নেতা ছিলেন শৌখিন হুক্কা সেবনকারী এককালীন আওয়ামী লীগ নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান। ড্যাক প্রতিষ্ঠিত হয় ৯ জানুয়ারি। এতে ছিল পিডিএম, আওয়ামী লীগ, ওয়ালী ন্যাপ এবং জামায়াতে ইসলামী। শুধু ভুট্টো আর ভাসানী ছিলেন এর বাইরে। তবে নসরুল্লাহকে পাঠানো আইয়ুবের চিঠিতে সবাইকে সম্বোধন করা হয়। ৭ থেকে ৯ মার্চ লাহোরে ড্যাকের আলোচনা অনুষ্ঠিত হলো এবং ১০ থেকে ১৪ মার্চ হলো পিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক। সামরিক বাহিনীর এজেন্টরা প্রথম থেকেই বৈঠক বানচালের উদ্যোগ নেয়। তারা চায় একটি নতুন সামরিক সরকার, ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে নয়া রাজত্ব। অ্যাডমিরাল এআর খান বৈঠকের মধ্যেই উসকানিমূলক আচরণ ও দুর্ব্যবহারে লিপ্ত হন। তাদের দোসর পশ্চিমে ভুট্টো আর পূর্বে ভাসানী বৈঠকে বয়কট করলেন। গোলটেবিল বৈঠকে দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হলো- একটি হলো এক ব্যক্তি এক ভোট আর অন্যটি ফেডারেল সংসদীয় গণতন্ত্র। ৬-দফার অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক ৫টি দফাতেই মতৈক্য হলো না। পশ্চিমের প্রতিনিধিরা এগুলোতে কিছুতেই রাজি নন আর পূর্বের গুটিকয় দলহীন নেতাও তাতে সায় দেন।
গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রথম যেদিন (২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলা) চাকলালা বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন, নিরাপত্তার কারণে তাকে পেছন দিয়ে বের করে দ্রুত পূর্ব পাকিস্তান হাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়। এদিকে বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য। তারা বিফল মনোরথ হয়ে বিরক্তিভরে বিদায় নিলেন। ওইদিনই মধ্যরাতে আমাদের দল তার সঙ্গে আলোচনায় বসে। লাহোরে তার সঙ্গে মোলাকাতের জন্য ওয়াহিদুল হক, আনিসুর রহমান এবং একেএ মোমেন (ছাত্র) গিয়েছিলেন আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে। পিন্ডিতে আমার মনে হয় মফিজুর রহমান আর আমি ছাড়া সবাই প্রথমবারের মতো তার মুখোমুখি হই। আমাদের বক্তব্য তিনি ধৈর্য ধরে শুনলেন। আমরা জানালাম যে কেন্দ্রীয় রাজস্ব ক্ষমতা ছাড়তে ঐকমত্য দুরূহ হবে। তখন বঙ্গবন্ধু একটি মন্তব্য করেন, যা আমার কানে এখনও বাজছে। “আমরা ৬-দফার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন চাই। কিন্তু বন্দুক একচ্ছত্রভাবে যাদের দখলে, তাদের দৌড় আমাদের অনুধাবন করতে হবে। সামরিক খরচের নিশ্চয়তা তারা বিধান করতে চাইবে, তাই কেন্দ্রীয় রাজস্ব ক্ষমতার ব্যাপারে আমাদের ভাবতে হবে।” তিনি পিন্ডির বাঙালি সমাজের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, তাদের মনোভাবের মোটামুটি খবরাখবর নিলেন। প্রায় ছয় বছর পর বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম এবং তার সঙ্গে আলাপের সুযোগ পেলাম। আমার মনে হলো, এই ক’বছরে তিনি আরও অনেক সহিষ্ণু ও চিন্তাশীল হয়েছেন। আমরা যেন একজন পরিপক্ব রাষ্ট্রনেতার সান্নিধ্যে এলাম। বাঙালির সুখ ও মঙ্গল এবং ন্যূনতম সংঘাতের মাধ্যমে তা আদায় হচ্ছে তার মুখ্য লক্ষ্য এবং একমাত্র ব্রত। আমার মনে হয়, আমার সহযোগী সবাই এ বিষয়ে একমত ছিলাম এবং আমরা আমাদের নেতাকে নিয়ে যথার্থই গর্ববোধ করি। আমার সহযোগী আমরা সাতজন- সবাই এখনও জীবিত এবং বিভিন্ন মতানুসারী; কিন্তু আমার এই অভিমত বোধহয় সবাই নির্দ্বিধায় মেনে নেবেন। এ-সময়ের আরও দু-একটি ঘটনায় তার চারিত্রিক দৃঢ়তার চমৎকার পরিচয় পাওয়া যায়।
একদিন নুরুল আমিন সাহেবের কাছ থেকে তলব এলো। হামিদুল হক চৌধুরী এবং আবদুস সালাম খান সমভিব্যহারে নুরুল আমিন সাহেব জানতে চাইলেন যে শেখ সাহেব কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মনোয়ন দিয়েছেন কি না? আমার জানামতে, তৎকালীন প্রধান এনএ ফারুকী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মোলাকাত করতে চেয়েছিলেন এবং তা ঠিক করা হয়েছিল। এছাড়া আমি এ-বিষয়ে কিছুই জানতাম না। নুরুল আমিন সাহেব বললেন, বিচারপতি আবদুস সাত্তার অচিরেই অবসর নিচ্ছেন এবং তাকে এই পদের জন্য বিবেচনা করা যায়। তবে শেখ সাহেবের মনোনয়ন ছাড়া কোনো নিযুক্ত হবে না। নুরুল আমিন সাহেব এ-ব্যাপারে শেখ সাহেবের সঙ্গে আলাপ করবেন বলে ব্যবস্থা করতে বললেন আমাকে। এক-আধদিন পর শেখ সাহেব আমাকে বললেন যে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার জি মুইনুদ্দিন সম্বন্ধে তিনি অনেক ভালো কথা শুনেছেন এবং মুইনুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে হবে। মুইনুদ্দিন তখন পিন্ডির অনতিদূরে মারির পথে থাকেন। তাকে টেলিফোন করলে তিনি বললেন যে, শেখ সাহেবের সঙ্গে অবশ্যই তিনি দেখা করতে আসবেন, তবে তিনি কোনো পদ গ্রহণ করতে পারবেন না। তিনি বস্তুতই অবসর নিয়েছেন। মুইনুদ্দিন সাহেবের মোলাকাতে শেখ সাহেব খুবই সন্তুষ্ট হন এবং দুঃখ করে বললেন যে একজন ভালো লোককে কাজে লাগানো গেল না। আমি শুধু জানলাম যে ফারুকী সাহেব আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকবেন না। তিনি না-কি বলেছেন যে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণে তিনি শেখ সাহেবের পরামর্শ মেনে চলবেন। পরবর্তীকালে (ততদিনে ইয়াহিয়ার রাজত্ব কায়েম হয়েছে এবং আমি ওয়াশিংটনে নিযুক্ত আছি) ফারুকী সাহেব ইস্তফা দেন এবং বিচারপতি সাত্তার শেখ সাহেবের আশীর্বাদে প্রথম এই পদে নিযুক্ত হন। শেখ সাহেবের বিচারে ফারুকী, সাত্তার ও মুইনুদ্দিনের মধ্যে শেষোক্ত ব্যক্তিকে পছন্দ আমাকে খুব খুশি করে। মেধার স্বীকৃতি এবং নৈপুণ্যকে অগ্রাধিকার প্রধান দেশনেতাকেই সাজে। সব সময় হয়তো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কিন্তু সদিচ্ছাটিই অত্যন্ত মূল্যবান এবং আইনের শাসনের রক্ষাকবচ।
সর্বজ্যেষ্ঠ মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন একদিন খবর দিলেন যে শেখ সাহেব সন্ধ্যাবেলা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নৈশভোজে যাবেন। ফিদা হাসান আবার মনে করিয়ে দিলেন। সন্ধ্যায় শেখ সাহেবকে রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠিয়ে আমি পূর্ব পাকিস্তান হাউসেই রয়ে গেলাম। ওই একটি দিনই শেখ সাহেবকে আমি স্যুট পরিহিত (ইউরোপীয় স্যুট) দেখেছি। শেখ সাহেব ফিরলেন খানিকটা গম্ভীর মুখে। অনেকটা যেন স্বগতোক্তির মতো বললেন যে এ-সময়ে জাতীয় সরকারের কোনো ভূমিকা নেই; বরং নির্বাচনেরই আশু ব্যবস্থা প্রয়োজন। আইয়ুব খান তাকে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু তিনি তাতে সাড়া দেননি। ইয়াহিয়ার রণনিনাদ তখন বাজছে, তবে তার আওয়াজ ছিল স্তিমিত। আইয়ুব হয়তো ভেবেছিলেন যে জাতীয় সরকার ইয়াহিয়াকে নিবৃত্ত করতে পারে। জাতীয় সরকারের ব্যাপারে সম্ভবত খাজা শাহাবুদ্দিন ও ইউসুফ হারুন জোর তদবির করেন। তারা ইয়াহিয়ার মতলব সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন না। আর তাদের দোষ কী, স্বয়ং আইয়ুব খান ইয়াহিয়ার মতলব সম্বন্ধে পুরোপুরি অবহিত ছিলেন না। শেখ মুজিব তার উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতিতে মোটেই অভ্যস্ত ছিলেন না আর ভয়ভীতি সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন।
আইয়ুবের দশোর্ধ্ব বছর শাসনকালে সব সময় শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে মামলা লেগে ছিল। যেমন ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে তার হাজিরা দিতে হয় ঢাকায়, সিলেটে ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন আদালতে। এই বছরের বেশি, ১৯৬২ সালে প্রায় পাঁচ মাস এবং ১৯৬৬-৬৯ সালে প্রায় তিন বছর। এছাড়া মামলার জন্য কারাবাস হয়েছে অনেকবার। এত জুলুম-অত্যাচারও মানুষটিকে ভাঙতে পারেনি। তাসখন্দ চুক্তির পর আইয়ুব খান সমর্থন খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। শেখ সাহেব তাসখন্দ চুক্তি সমর্থন করলে শাসনামলে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রথম একান্ত মোলাকাত হয় গোলটেবিল বৈঠকের একদিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে। শেখ মুজিব কখনও আইয়ুবের কাছে হাতজোড় করেননি বা মাথা নত করেননি। এই রেকর্ড সারা পাকিস্তানে কোনো দ্বিতীয় রাজনৈতিক নেতার ছিল না।
শেখ মুজিব আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বিংশ শতাব্দীর এক মুসলিম পরিবারের সন্তান শুধু তার দৃঢ়চিত্ততা, ত্যাগ, সাহস এবং কর্মক্ষমতার জোরে একটি জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা করেছেন, এমন কাহিনি ইতিহাসে নেই। তার সাফল্যের পেছনে চালিকাশক্তি ছিল মানুষের মঙ্গল, বাঙালির সুখ-দুঃখের সঙ্গে তার একাত্মতা। বাঙালির ভালোকে মুহূর্তের জন্যও তিনি ভুলতে পারতেন না। এই সামষ্টিক মঙ্গলের বিষয়ে কোনোরকমের কোনো দ্বিধা তার কখনও ছিল না বা এ-বিষয়ে আপস তিনি কখনও করেননি এবং এর জন্য কোনো কাজই তার কাছে অসম্ভব মনে হয়নি। এই একনিষ্ঠ দেশপ্রেম, এই ত্যাগ ও তিতিক্ষাই তাকে কোনো সময়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দেয়নি। এই দৃঢ়চিত্ততার সঙ্গে যুক্ত হয় তার সাবলীল কৌশল, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘কমনসেন্স, রেসপন্স অর হর্সসেন্স’। এই কৌশলের উৎস ছিল মানুষের সঙ্গে তার একাত্মতা। তিনি ছিলেন মানুষের নিতান্ত কাছের জন, আপনার লোক, তাদের নাড়িনক্ষত্রের খোঁজ ছিল তার অসাধারণ। অনেক কৌশল বা ধারণা তিনি আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করেননি; কিন্তু কোন কৌশল বা কোন বিষয় মানুষ খাবে, সে-বিষয়ে তার বিচার ছিল নির্ভুল। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কালচার তিনি হয়তো শুরু করেননি; কিন্তু তাকে জাতীয় দর্শনে পরিণত করেছেন শেখ মুজিব। স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা তিনি হয়তো প্রণয়ন করেননি, কিন্তু তাকে জাতীয় স্লোগান ও দাবিতে রূপান্তর করার কৃতিত্ব হলো বঙ্গবন্ধুর। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এবং পরিচালনা হলো বঙ্গবন্ধুর সফল কৌশলের সর্বোত্তম কীর্তি। সময় ও সুযোগের ব্যবহার ছিল অনবদ্য এবং ধাপে ধাপে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া ছিল অতুলনীয় বাহাদুরির পরিচায়ক। অসহযোগের অভিজ্ঞতা এবং এতে যে আত্মপ্রত্যয়ের উন্মেষ হয়, তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পরিবেশ গড়ে উঠতে পারত বলে মনে হয় না। বঙ্গবন্ধুর এই গুণাবলি এবং একনিষ্ঠভাবে বাঙালির স্বার্থ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা তাকে জাতির পিতা ও দেশের স্থপতির ভূমিকায় আসীন করে। তবে মানুষ মাত্রই দোষ-গুণে মণ্ডিত। মহামানুষের ভুলভ্রান্তি বড় আকারে ধরা পড়ে। নানা কারণে মানুষ কাছের জন কখনও দূরে সরে যায়, আর তখনই নামে মারাত্মক ধস।
সব বিবেচনায় সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি আর এতে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই।
 
লেখক : সাবেক অর্থমন্ত্রী ও সদস্য, উপদেষ্টামণ্ডলী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK