শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৯:২৭
ব্রেকিং নিউজ

দেশে দেশে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য সড়ক উদ্যান ও স্থাপনা

দেশে দেশে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য সড়ক উদ্যান ও স্থাপনা

স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার এ স্থপতির অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের বহু দেশেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর স্মরণে অনেক স্থাপনা।

 
সাইদ আহমেদ বাবু
বাংলা, বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অপর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিব জাতির পিতা ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত, শোষিত-বঞ্চিত মুক্তির ঠিকানা। যার জন্ম না হলে হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি জাতি কোনোদিনও স্বাধীনতার স্বাদ পেত না।
গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি এই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এ জন্য তাকে বহুবার কারাবরণসহ অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে এদেশের জনগণকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এই মহান নেতা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এ জন্য তাকে কারাবরণ করতে হয়, যেতে হয় ফাঁসির মঞ্চে। তবুও তিনি শত্রুর সঙ্গে আপস করেননি। দেশ ও জনগণের স্বার্থকে সারাজীবন সমুন্নত রেখেছেন। তার নেতৃত্বে পেয়েছি আমরা বাংলাদেশ, লাল সবুজ পতাকা। তার স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা বিনির্মাণ। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাত তার স্বপ্নকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই নৃশংস কাহিনি। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনার পিছনে রয়েছে এক জঘন্য রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু এখন আর কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি হয়ে উঠেছেন একটি প্রতিষ্ঠান, একটি দেশ, একটি পরিচয়। সারাবিশ্বে আজ বাংলাদেশের বিকল্প কেবল বঙ্গবন্ধু। তাই ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তার আদর্শ ও নীতিকে ধ্বংস করতে পারেনি। তিনি এক আদর্শের নাম। যে আদর্শের মৃত্যু নেই। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন, চলার পথ ও স্বপ্নই হবে বাংলাদেশের চালিকাশক্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অপরাজনীতিকে ঠেকাতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাঠ করতে হবে বঙ্গবন্ধুকে। ধারণ করতে হবে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও ভাবনাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যেমন আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই দেশের প্রান্তর থেকে প্রান্তরে, ঠিক তেমনি ছড়িয়ে দিতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকেও। বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই; কিন্তু বাঁচিয়ে রাখতে হবে তার চিন্তা ও স্বপ্নগুলোকে।
তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও যুগের পর যুগ বিশ্ববাসী স্মরণ করে যাচ্ছে ইতিহাসের এই মহানায়ককে। যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দিকে তাকালেই তার অবিনশ্বর কীর্তির স্মৃতিচিহ্ন চোখে পড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার এ স্থপতির অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের বহু দেশেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর স্মরণে অনেক স্থাপনা।
কোনো দেশের মহানায়কদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলোর সম্মান জানানোর জন্য রাস্তার নামকরণ, ভাস্কর্য স্থাপন, জাদুঘর প্রতিষ্ঠার রীতি দেখা যায় বর্তমান বিশ্বে। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণীয় করে রাখতে দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও নির্মিত হয়েছে তার ভাস্কর্য। তার আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন নিঃসন্দেহে আমাদের গর্বিত করে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে বিভিন্ন স্থাপনা, জাদুঘর, ভাস্কর্য, রাস্তা দেখতে পাওয়া যায়। এটা প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার স্বরূপ। বঙ্গবন্ধু জীবিত অবস্থায় দেশের সীমা-পরিসীমা ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে নিজের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী ভাবমূর্তি গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কীর্তি চির ভাস্বর বিধায় তার মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরেও অনেক দেশ তাকে স্মরণ করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা অনেকেই জানি না বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে সম্মান জানাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র। আসুন দেখে নিই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর স্মরণে বিভিন্ন উদ্যোগ, যা জেনে আপনিও গর্বিত হতে পারেন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের নাগরিক ভেবে। মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মাধ্যমে। কীর্তিমান মানুষের কীর্তির স্বীকৃতি শুধু নিজ দেশে সীমাবদ্ধ থাকে না, তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কৌতূহলের বিষয়। সে-জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য স্থাপন করা হচ্ছে, জাদুঘর হচ্ছে, রাস্তার নামকরণ হচ্ছে। দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির উদ্দেশে এ ধরনের উদ্যোগ প্রতীকী গুরুত্ব বহন করলেও, এই স্থাপনাগুলো দেখে বিদেশিরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে উৎসাহী হবে। আর বঙ্গবন্ধুকে জানলে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে। বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তিগাঁথা ছড়িয়ে পড়বে সারাবিশ্বের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
ভাস্কর্য
১. কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য : বঙ্গবন্ধু কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষে থাকতেন। সেখানেই কলকাতার স্থানীয় সরকার বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ১৯৯৮ সালে রুমটিকে জাদুঘরে পরিণত করে। পরবর্তীতে, ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ৮ নম্বর স্মিথ রোডে আবাসিক হল বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য উন্মোচন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণি এমপি। ভাস্কর্যটি বঙ্গবন্ধুর চেহারার সাথে পুরোপুরি মিল না থাকায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ভাস্কর্যটি প্রতিস্থাপিত করা হয়।
২. অস্ট্রেলিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য : অস্ট্রেলিয়ায় স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিডনিতে বাংলাদেশ সরকার ও ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আইন অনুষদের আন্তর্জাতিক সমুদ্রশাসন কেন্দ্রের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য উন্মোচন করা হয়। বঙ্গবন্ধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম সমুদ্র আইন প্রতিষ্ঠা করেন, তারই স্বীকৃতি স্বরূপ ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায়। ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক জামাল আহমেদের তত্ত্বাবধানে তরুণ ভাস্কর চঞ্চল কর্মকার ও লিটন পাল এই ভাস্কর্য তৈরি করেন। ২.৫ মিটার উচ্চতার এই ভাস্কর্য তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে ব্রোঞ্জ।
৩. ফ্রান্সে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার ও ভাস্কর্য : ফ্রান্সের পর্যটননগরী পারেলুমনিয়াল সিটিতে তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার। সেখানে পাথরে খোদাই করা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। বিদেশের মাটিতে এই প্রথম বঙ্গবন্ধুর নামে স্কয়ার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পারেলুমনিয়াল মিউনিসিপালিটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এই স্কয়ারের উদ্বোধন করেন।
৪. যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেটে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য : যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেটে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম স্থায়ী প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। পাথরের তৈরি ৯ ফুট উচ্চতা ও ৫ ফুট প্রশস্তের এই প্রতিকৃতি ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট স্থাপন করে মিশিগান স্টেট আওয়ামী যুবলীগ। হ্যামট্রাম্যাক শহরের বাংলাদেশ এভিনিউতে (কনান্ট) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মিশিগান ১৪ ডিস্ট্রিকের কনগ্রেসওমেন ব্রেন্ডা লরেন্স। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ৯ ডিস্ট্রিকের মিশিগান স্টেট সিনেট সদস্য পল ওজনো ও ২৮ ডিস্ট্রিকের হাউস অব রিপ্রেসেনটেটিভ লরি স্টোন। প্রতিকৃতি উদ্বোধন করেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক একেএম তারিকুল হায়দার চৌধুরী। ব্রেন্ডা লরেন্স তার বক্তব্যে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন বিশ্বমানের রাজনৈতিক নেতার প্রতিকৃতি স্থাপন অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। তার আদর্শ এখনও বিশ্বের মানুষের কাছে অনুসরণীয়।
৫. লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য : লন্ডন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আফসার খান সাদেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও নিজস্ব অর্থায়নে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটসের সিডনি স্ট্রিটে আফসার খান সাদেকের বাড়ির সামনে স্থাপন করা হয় এই ভাস্কর্য। ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটি উন্মোচন করেন তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ব্রিটেনের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর এটিই একমাত্র ভাস্কর্য। ২০০৯ সালে আফসার খান সৈয়দ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের অনুমতি চাইলে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালে ভাস্কর্য নির্মাণের অনুমতি দেয়। সম্প্রতি জনসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
 
বঙ্গবন্ধু সড়ক
১. মরিশাসে বঙ্গবন্ধুর নামে সড়ক : মরিশাস সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হসনু এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এমপি যৌথভাবে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর পোর্ট লুইস, মরিশাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে নামকরণকৃত রাস্তা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্ট্রিট’-এর উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ দূতাবাস, মরিশাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়। এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও বার্তায় বলেন, বঙ্গবন্ধুর নামে পোর্ট লুইসে এই রাস্তার নামকরণ মরিশাস এবং বাংলাদেশের মধ্যে বহুমাত্রিক সম্পর্কের নিদর্শন তৈরি করেছে। তিনি মরিশাসের স্থানীয় ভাষায় বলেন, ‘হাতে হাত রেখে (লামে দা লামে)’ সম্পর্কের নতুন দিগন্তে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মরিশাস সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হসনু তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, রাস্তার নামকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরে মরিশাস সরকার ও জনগণ গর্বিত।
২. কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর নামে সড়ক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪২ সালে তৎকালীন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মৌলানা আজাদ কলেজ) ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলে স্মিথ স্ট্রিটের বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র হন। হোস্টেলটি কলকাতার নিউ মার্কেটের কাছে ৮ স্মিথ লেনে অবস্থিত। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানোর জন্য ১৯৯৭ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কলকাতায় পার্ক সার্কাস রাস্তার নামকরণ করে বঙ্গবন্ধুর নামে। সরণিটি ১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনের কাছাকাছি অবস্থিত।
৩. দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর নামে সড়ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল ভারতের দিল্লি সফরের প্রাক্কালে রাজধানী দিল্লির পার্ক স্ট্রিটের নাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির প্রাণকেন্দ্রের পুরনো নাম ‘পার্ক স্ট্রিট’ পরিবর্তন করে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর নামে নামকরণ করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ এপ্রিল ২০১৭ যৌথভাবে এই সড়কের নামফলক উন্মোচন করেন। বঙ্গবন্ধুর নামে ভারতের রাজধানীর একটি সড়কের নামকরণ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান। রাজধানী নয়াদিল্লির প্রাণকেন্দ্রের শঙ্কর রোড-মন্দির মর্গ ট্রাফিক চত্বর থেকে রাষ্ট্রীয় রাম মনোহর লোহিয়া হসপিটালের সামনে মাদার টেরিজা ক্রিসেন্ট পর্যন্ত সড়কটি এতদিন পার্ক স্ট্রিট নামে পরিচিত ছিল।
৪. ফিলিস্তিনে বঙ্গবন্ধুর নামে সড়ক : ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফিলিস্তিন সরকার প্রাচীন ঐতিহ্যের শহর হেবরনের একটি রাস্তার নামকরণ করেছে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয় বীরের সম্মানার্থেই একটি সড়কের নামকরণ করে সে-দেশের সরকার।
৫. কম্বোডিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নামে সড়ক : ১৯৭৩ সালে ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কম্বোডিয়ার জাতির পিতা নরোদম সিহানুকের সাক্ষাতের মাধ্যমে দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সূচনা ঘটে। ২০১৭ সালে কম্বোডিয়ার সরকার বন্ধুত্বের প্রতি সম্মান জানাতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মানসূচক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনের একটি প্রধান সড়কের নামকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। গণহত্যার শিকার হওয়া দুই দেশ বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়া একে অপরের জাতির পিতার নামে গুরুত্বপূর্ণ শহরের প্রধান সড়কের নামকরণ করে। ২০২২ সালের ১৬ জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এমপি কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে ‘বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’ নামের সড়কটি উদ্বোধন করেন।
৬. শিকাগোতে বঙ্গবন্ধুর নামে সড়ক : আমেরিকার শিকাগোতে ডেভন এভিনিউয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ‘শেখ মুজিব ওয়ে’ নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। শিকাগো সিটি কাউন্সিলের উদ্যোগে ২০১৮ সালে এ নামকরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে যুক্তরাষ্ট্রে এটি সর্বপ্রথম উদ্যোগ। যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু সাবওয়ের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেস হাইওয়েতে এক্সজিটে ইন মেমোরি অব শেখ মুজিব এবং ওয়াশিংটনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য।
৭. লন্ডনে বঙ্গবন্ধু নামে প্রাইমারি স্কুল : লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি প্রাইমারি স্কুল আছে। ১৯৮৯ সালে বঙ্গবন্ধু প্রাইমারি স্কুলটি স্থাপিত হয়। পরে ১৯৯১ সালে তা স্থানান্তরিত করা হয় Wessex St, Bethnal Green, London E2 0LB, UK–এ ঠিকানায়।
৮. ভারতের নয়াদিল্লিতে প্রেস ক্লাব : ভারতের নয়াদিল্লিতে ‘প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া’য় বঙ্গবন্ধু মিডিয়া সেন্টার চালু হয়েছে। ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে নয়াদিল্লির রাইসানা রোডের প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার দ্বিতীয় তলায় এই সেন্টার উদ্বোধনকালে ভারত সফররত তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দেশের সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই সুসম্পর্ককে এগিয়ে নিতে দুদেশের জনগণের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের জন্য আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ায় বঙ্গবন্ধু মিডিয়া সেন্টার নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সভাপতি উমাকান্ত লাখেরার সভাপতিত্বে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুহাম্মদ ইমরান, প্রেস মিনিস্টার শাবান মাহমুদ, বাংলাদেশের জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সাবেক সভাপতি গৌতম লাহিড়ী এবং সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বিনয় কুমার অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জীবনীর ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
৯. ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের দুটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপন : ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের দুটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় দুটি হলোÑ চ-ীগড় ও লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটি। এই কাজে সার্বিক সহযোগিতায় করেছে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন। বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে বাংলাদেশের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও সংগ্রামের ওপর ডিজিটাল সুবিধা, বই ও নথিপত্রে সজ্জিত ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপন করা হয়েছে। ২০২২ সালের ১ এপ্রিল লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটি ও ৩১ মার্চ চণ্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্নার উদ্বোধন করেন হাইকমিশনার মুহাম্মদ ইমরান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বছর উপলক্ষে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন এই উদ্যোগ নেয়।
১০. তুরস্কে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, সড়ক ও পার্ক : তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই নেতার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশ-তুরস্ক অনড়। স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাস ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রচেষ্টায় ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর একই দিনে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য ও পার্ক উদ্বোধন করা হয়। উল্লেখ্য, ঢাকার বনানীতে তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের নামে একটি সড়ক রয়েছে। এর আগে ১৯৯৭ সালের ১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর নামে বুলভার্ডের একটি সড়কের নাম দেয় আংকারা সিটি কর্পোরেশন। এই আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করেছে আংকারা সিটি কর্পোরেশন। বঙ্গবন্ধু সড়কে ওই মোড়ে একটি বড় কংক্রিটের কাঠামোর ওপর পিতলের তৈরি বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্যটি বসানো হয়েছে। এর নিচের অংশে শ্বেতপাথরে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনী লেখা। এটি তৈরি করেছেন তুরস্কের বিখ্যাত ভাস্কর মের্ট কিলিন। উদ্বোধন করা আবক্ষ ভাস্কর্যটি সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতির পিতা (১৭ মার্চ ১৯২০-১৫ আগস্ট ১৯৭৫)। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। তার অবিসংবাদিত ও বিপ্লবী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এখন তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এভাবে নানা উপমা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবন ও অর্জন তুলে ধরা হয়েছে শ্বেতপাথরে। এছাড়া ভাস্কর্যের নিচে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ। চারপাশে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বসার জায়গা। তুর্কির নাগরিকরা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চায়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নিচে খোঁদাই করা যে পরিচিতি রয়েছে, তা থেকে অনেক তথ্য জেনে নিচ্ছে তারা। একই শহরের আরেক প্রান্তে কাচোয়ায় গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে বিশাল একটি পার্ক। দূরদেশে ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল পার্ক’ নামের ওই পার্কটি স্বাধীন বাংলাদেশ এবং দেশটির জনককে পরিচিত করছে সে-দেশের নাগরিকদের কাছে। কাচোয়ায় বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল পার্কের মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিযুক্ত নামফলক। সেখানেও বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন ইংরেজি ও তুর্কি ভাষায় লেখা রয়েছে।
উল্লেখ্য, তুরস্কের রাজধানী আংকারা ও তাদের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইজমিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে রয়েছে দুটি সড়ক। তুরস্কের রাজধানী আংকারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি পার্ক উদ্বোধন করা হয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল পার্ক’ নামের উদ্যানটি দেশটির সর্ববৃহৎ এবং এটি রাজধানীর কাচোরায় অবস্থিত। এর আয়তন ৩৩ হাজার স্কয়ার মিটার। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এই পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৫টায় এই পার্ক উদ্বোধন করা হয়। এ উপলক্ষে পার্ক এলাকায় একটি সভার আয়োজন করা হয়। এতে অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এমপি, আংকারার গভর্নর ওয়াসিপ শাহীন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, আংকারার মেয়র মনসুর ইয়াভাস, আংকারার ডেপুটি মেয়র সেলিম সিরপান লৌ, তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ মান্নান প্রমুখ। পার্কটিতে দেখা গেছে, কয়েকটি পৃথক মাঠ নিয়ে পুরো প্রাঙ্গণটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি মাঠকে তার দিয়ে বিশেষ বেড়া দেওয়া হয়েছে। তাতে ফুটবল মাঠ, বাস্কেট বল মাঠ, ব্যাডমিন্টন মাঠ, ব্যায়ামাগার, শিশু কর্নার ও ওয়াকওয়েসহ সব ধরনের খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। রাতে খেলার জন্য পার্কে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পার্কটিকে সবুজায়ন করতে নতুন করে গাছ লাগানো হয়েছে।
 
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK