শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ২১:২৬
ব্রেকিং নিউজ

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও সংগত উপলব্ধি

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও সংগত উপলব্ধি

ইতিহাসের নিজস্ব শক্তি আছে তার সত্যকে রক্ষা করার, অতএব সে তার আপন শক্তিতেই বিকশিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ আবারও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 
হারুন হাবীব
 
এক
১৫ আগস্ট ১৯৭৫, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় আমরা হারিয়েছি বাংলা ও বাঙালির আরাধ্য পুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অভিশপ্ত এই দিনটিতে জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরানো হয়েছিল, তার আনুষ্ঠানিক দায়মুক্তি ঘটেছে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি, দীর্ঘ ৩৪ বছর পর। বিশ্বের ইতিহাসে এ-রকম বিলম্বিত সুবিচার প্রায় বিরল; এদিক থেকে নিশ্চিতভাবে আমরা গর্ব করতে পারি। এই বিচারের মধ্য দিয়ে তমসাচ্ছন্ন একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এরপরও কি আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি বাংলাদেশের জাতীয় জীবন থেকে ষড়যন্ত্রের ইতি টানা গেছে? একদিকে জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে জাতির পিতাকে, লাখো মানুষের ভিড় নামে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে, সেই সঙ্গে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, যেখানে ঘাতকেরা এই মহাপুরুষকে অশ্রদ্ধায় শুইয়ে রেখেছিল; অন্যদিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুরনো ও নতুন ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের গোপন ও প্রকাশ্য তৎপরতা ঝালিয়ে নেয়। তারা শেখ মুজিবকে অস্বীকার করার কূটকৌশল রপ্ত করে। কারণ তিনি ধর্মতান্ত্রিক ও সামরিক আধিপত্যবাদী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছিলেন। মুসলিমপ্রধান বিশ্ব জনপদে তিনিই প্রথম একটি আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল সংকট বুঝতে হলে, আমার বিশ্বাস, এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে।
স্বীকার করতে দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড টি ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফসল। সেদিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর বেশির ভাগই পাকিস্তানের বিভক্তি সমর্থন করেনি। সমর্থন করেনি গণচীনও। তারা প্রায় সকলেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের হাতে নির্বিচার গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন সমর্থন করেছে, তথাকথিত রাষ্ট্রকৌশলের নামে! অতএব দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ফসল হিসেবে, বিশ্বাসঘাতক কিছু স্বপক্ষীয় রাজনীতিকের যোগসাজসে, সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের নির্মম বুলেটে নিহত হতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। প্রাণ হারাতে হয়েছে তার পরিবারের নিকটতম সদস্য ও আত্মীয়দের।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সংকট জানতে আরও বুঝতে হবে কেন সেই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আত্মস্বীকৃত খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি; কেন দীর্ঘ সময় ধরে তাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে? খুনিদের প্রতি এই সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা ছিল প্রায় প্রকাশ্যেই, প্রায় দুই যুগ। অতএব ঘাতকদের রাজনৈতিক অনুসারী কে বা কারা- তাকে চিহ্নিত করতে হবে, অন্যথায় বাংলাদেশের রাজনীতির সংকট স্বরূপ আবিষ্কৃত হবে না।
হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় সব দেশেই; এই বিচার ঘটে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, সুবিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, সভ্যতার স্বার্থে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচার ঠেকাতে আইন করা হয়েছিল। দীর্ঘ ২১টি বছর এই হত্যাকা-ের বিচারের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই কালো আইন। ওখানেই শেষ নয়। বিচার প্রক্রিয়া শুরু ও বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণা করা হলেও, উচ্চ আদালতের অনুমোদন বাধাগ্রস্ত করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ বছরেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের আপিল শুনানি করা যায়নি! ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পরই কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি উচ্চ আদালতে ওঠে। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের বিপুল নির্বাচনী বিজয়ের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নতুন করে ক্ষমতাসীন হলে চূড়ান্ত বিচারের কাজ শুরু হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি কারাগারে আটক পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বিভিন্ন দেশে আজও পালিয়ে আছে আরও ছয় খুনি।
আরও অনুধাবনযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ২১ বছর তার হত্যার বিচার হয়নি তাই নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতির মৃত্যুবার্ষিকীও পালিত হয়নি এই রাষ্ট্রে! বছরের পর বছর ১৫ আগস্ট অতিবাহিত হয়েছে অবহেলায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই কেবল দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হতে থাকে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস বাতিল করে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় শোক দিবস এবং সরকারি ছুটি পুনর্বহাল করে।
বঙ্গবন্ধু সব সময়েই বলতেন, বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ তাকে ধ্বংস করতে পারবে না। নিশ্চয়ই পারবে না। কারণ ৩০ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। লক্ষ নারীর সম্ভ্রম বৃথা যেতে পারে না। লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। এরপরও কথা থাকে। বঙ্গবন্ধু কখনও কি ভেবেছিলেন কেউ তাকে হত্যা করতে পারে তারই সৃষ্ট বাংলাদেশে? তিনি কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন তার মৃত্যুর পর এই বাংলাদেশে আবারও পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরিয়ে আনার সচেতন প্রয়াস দানা বাঁধবে?
বাংলাদেশের পাঁচ দশকের রাজনীতির বাস্তবতা হচ্ছে, এই স্বাধীনতা-বিরোধীরা বসে নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতির অনুসারীরা বিভেদে জর্জরিত। সে-সুযোগে বিরুদ্ধবাদীরা সংগঠিত; তারা বাংলাদেশকে হারিয়ে দেওয়ার যুদ্ধে লিপ্ত, যারা বাংলাদেশ চায়নি, তারা বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে তৎপর, দেশে এবং বিদেশে। এই মূল্যায়নকে সামনে রেখে ১৫ আগস্ট পালন করা হলে স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ, বাংলাদেশের জনকের প্রতি উপযুক্ত সম্মান দেখানো হবে বলে আমি মনে করি।
 
দুই
যারা মনে করেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার বিপদের মাত্রা কমতে শুরু করেছে, আমি তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিপদের সত্যিকার স্বরূপ বুঝতে হলে একদিকে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের কাছে, একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের কাছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম পুরুষকে নিয়ে, যার অতুলনীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরাধীন জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল, যার অসীম প্রেরণা বাঙালির জাতীয় শক্তি ও সাহসের উৎস হয়েছিল, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তার মৃত্যুর এতকাল পরেও, কেন ভয় করা হয়?
বঙ্গবন্ধুকে ভয় করার প্রধান কারণ তিনি পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-কাঠামো ও সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক ও সফল জনবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেনÑ যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। সেই গণবিদ্রোহ এতটাই তীব্র ছিল যে, একদিকে তা শোষণ-বঞ্চনা ও স্বৈরতন্ত্রী পাকিস্তান ভেঙেছে, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক আধুনিক একটি রাষ্ট্রকে সাংবিধানিকভাবে ভিত্তিদান করেছে। ভুললে চলবে না যে, ১৯৭২-এর রাষ্ট্রীয় সংবিধান অনুযায়ী বিশ্বের গোটা মুসলিমপ্রধান জনপদের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত।
বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন ধর্ম ব্যক্তিজীবনের বড় অবলম্বন; কিন্তু রাষ্ট্র হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ, ছোট-বড় নির্বিশেষ সকলের সমান অধিকারের ক্ষেত্র। রাষ্ট্রপিতা এটিও উপলব্ধি করেছিলেন যে, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি ধর্মের ঔদার্যকেই কেবল খর্ব করে না, সব মানুষের রাষ্ট্রকেও সীমিত করে, জনজীবন বিভাজিত করে। তাই একজন খাঁটি ধর্মানুসারী হয়েও ধর্মের রাজনীতিকে সমর্থনের কারণ খুঁজে পাননি তিনি। সে-কারণেই পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে স্বদেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, “আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।”
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনকের এ ঘোষণাটি ছিল তার কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণের স্বপ্ন। এর বাস্তবায়নের পথে তিনি যখন মনোনিবেশ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যখন তিনি নতুন করে গড়ে তুলতে আরেক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, ঠিক তখনই তাকে হত্যা করা হয়।
আরও একটি কথা অনুধাবন করা সংগত হবে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের অনুসারীরা কখনও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্ত্বা গ্রহণ করেনি। বাঙালি যখনই অসাম্প্রদায়িক জাতীয় গৌরব নিয়ে সামনে এগিয়েছে, তার বিরোধীরা তখনই ‘ধর্ম গেল, ধর্ম গেল’ বলে চেঁচিয়েছে। এসব সোরগোলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী কম-বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে। অথচ কয়েক যুগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাঙালি কখনও ধর্মচ্যুত হয়নি; হোক সে ধর্মগতভাবে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান কিংবা বৌদ্ধ। তবে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে অস্থিরতা ঘটানোর প্রয়াস কম হয়েছে- এটিও বলা যাবে না।
ব্রিটিশ-ভারতের বিভক্তি ও উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক হানাহানির আলোকে বেড়ে ওঠা মুজিব যথার্থই বুঝেছিলেন, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং সামরিক বাহিনীকেন্দ্রিক রাজনীতি পূর্ব ও পশ্চিমÑ দুই পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করবে। কাজেই এর বিরুদ্ধে লড়াই করা ছিল তার যোগ্যতম রাজনীতি। এই উপলব্ধিতে তিনি যখন বাংলাদেশ সৃষ্টির নেতৃত্ব দিলেন, তখন ধর্ম ও বর্মবাদী রাজনীতির কুশীলবরা ভীত হলো; রাজনীতির মঞ্চে ব্যর্থ হয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কৌশল আঁটল এবং সফলও হলো।
কিন্তু হত্যাকারীদের দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫-এর রক্তপাতের পর থেকে তাদের মুখোশ উন্মোচন হতে থাকল। কারণ তারা সদ্য-স্বাধীন দেশে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে স্বচেষ্ট হলো, যা ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। জেনারেল জিয়ার শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাসিক্ত রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে ইচ্ছেমতো কাটছাঁট করা হলো, রাষ্ট্রকে নতুন করে সাম্প্রদায়িক বানানো হলো। সেই থেকে শুরু হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পেছন যাত্রা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক অগ্রসরতা শুরু হয়েছিল, পঁচাত্তরের রক্তপাতের পর থেকে তা পেছন যাত্রা শুরু করল! ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশকে একটি নতুন পাকিস্তানে পরিণত করার চেষ্টা নেওয়া হলো!
কেবল বঙ্গবন্ধু নন, হত্যাকারীরা মুক্তিযুদ্ধের গোটা নেতৃত্বকে শেষ করতে উদ্ধত হয়েছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধের চার নেতাÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে বন্দী অবস্থায় কারাগারে হত্যা করেছিল; উৎখাত করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকারকে।
বাংলাদেশ, পূর্বেকার পূর্ব বাংলা এমন এক জনপদ, যেখানে জাতি-ধর্মের সম্মিলিত প্রয়াশেই সকল মৌল জাতীয় অর্জন সাধিত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি আসন গেঁড়েছে তখনই বিপন্নতা গ্রাস করেছে। আজ যখন মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বাতাস বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে শুভবুদ্ধি ও স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চাকে ধ্বংস করতে উদ্যত, তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি বক্তব্য মনে পড়ে। এই মনীষী বহুকাল আগে বাংলার মাটিতে বাংলাভাষীদের যৌথজীবনের অনস্বীকার্যতা উপলব্ধি করেছিলেন মর্মে মর্মে। তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, সেই ১৯৪৮ সালে : “এই অঞ্চল যেমন বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমানের স্মারকলিপি হয়ে আছে, প্রার্থনা করি তেমনই এ যেন নতুন রাষ্ট্রে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিকের মিলনভূমি হয়। আমীন। আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করেছিলেন; প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতিসত্তাকে রাষ্ট্র পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের বাঙালি মানসে যে অভূতপূর্ব দেশপ্রেম, তা ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে অভাবিত উজ্জীবিত করার; আগের ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলোতে যা সম্ভব হয়নি, তাই সম্ভব করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আরও একটি বিষয় লক্ষ করার মতো। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিপদের স্বরূপ বুঝতে হলে বাংলাদেশ-বিরোধী আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এই মহল পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ করেছিল, এমন কী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ে নীরব ভূমিকা পালন করেছিল। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনকের হত্যাকারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিল; যে সামরিক ও আধা-সামরিক শাসকরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল, এই আন্তর্জাতিক মহল তাদেরও সমর্থন দিয়েছিল! মোট কথা, ১৯৭৫-এর হত্যাকা-ের পর বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানের আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে স্বচেষ্ট হয়েছিল তারা। অতএব, একের পর এক আঘাত চলেছিল রাষ্ট্রের মূল ভিত্তির ওপর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের এই আঘাত চলতে থাকে প্রায় দুই যুগ। ভুললে চলবে না যে, ধারাবাহিক এবং পরিকল্পিত এই আগ্রাসনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনেকটাই পথভ্রষ্ট হয়েছে, বিভাজিত হয়েছে, নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ প্রতারিত হয়েছে, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরব পর্যন্ত খ-িত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং তাদের দোসররা বাঙালি জাতিসত্তার চৈতন্যের ব্যাপ্তি ও শক্তি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। কাজেই তাদের ষড়যন্ত্রের সাফল্য স্থায়ী হয়নি। ইতিহাসের নিজস্ব শক্তি আছে তার সত্যকে রক্ষা করার, অতএব সে তার আপন শক্তিতেই বিকশিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ আবারও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বা তাদের সমর্থক-অনুসারীদের আলাদা করে দেখার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। যে নামেই আবির্ভূত হোক না কেন, এরা যে কোনো উপায়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে উৎখাত বা আঘাত করতে বদ্ধপরিকর। সে-কারণেই ১৫ আগস্টের শোক পালনের তাৎপর্য উপলব্ধি করার প্রয়োজন আছে; এই উপলব্ধিকে সামনে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় শক্তির সম্মিলন, একাত্তরের চেতনার লড়াই। এ লড়াই বাংলাদেশকে বাংলাদেশ রাখার, এ লড়াই বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের একার নয়, এ লড়াই বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থি সকলের।
 
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK