শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ২২:২৪
ব্রেকিং নিউজ

স্মৃতিতে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট

স্মৃতিতে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট

সাইদ আহমেদ বাবু
 
পৃথিবীতে অনেক ক্ষণজন্মা এবং মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে; যেমন-মহাত্মা গান্ধী, জর্জ ওয়াশিংটন, মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকন, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, মোস্তফা কামাল পাশা সহ আরো অনেকে। এরা সবাই স্বপ্ন দেখেছেন স্বাধীন রাষ্ট্রের। আরও উন্নত দেশও স্বজাতির অধিকার আদায়ের জন্য। ঠিক তেমনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ।মহাকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাঁরা মানবের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদেরই একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় বিখ্যাত ব্যক্তিরা আততায়ীর হাতে গুপ্তহত্যা হয়েছেন। বর্তমান সময়ও এ থেকে মুক্ত নয়।রাজনৈতিক হত্যার বহু নিদর্শন রয়েছে। যেমন : ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, চিলির আলেন্দে, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি,মিয়ানমার জেনারেল অং সান ,আমেরিকার মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। সিংহলের প্রধানমন্ত্রী সলোমন বন্দর নায়েক।ব্রিটিশদের বিদায়ের পরপরই ‘ভারত ও বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতাদের হত্যা করা হলো। ১৯৪৮ সালে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে নিহত হন ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
 
১৫ই আগস্ট এমন প্রেমময় সূর্যোদয় কথাই ছিল বাংলার আকাশে আকাশে ,কিন্তু রক্তিম আভাময় ভোর জীবন্ত রক্তাক্ত রঙে রাঙানো আঁকানো হলো, কারণ রাতের আঁধার কেটে যে আলো আনন্দে র্শীষ বাজাবে তাঁতে পিতার তাজা রক্ত ছড়িয়ে ছিল ,জড়িয়ে ছিল,হাঁ আমি ১৯৭৫ সালের সেই ভয়াল সকালের কথাই বলছি, যে সকাল মুয়াজ্জিনের আযানের মধুর সুর ধ্বনিত হবার পূবেই রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। ১৯৭৫ এর সেই অভিশপ্ত সকালে গুলির শব্দে স্তব্ধ হয়ে যায় ঘড়ির কাঁটা, আজও সেই বাড়ির থেমে থাকা ঘড়িটি স্মৃতি হয়ে আছে, সেখানকার ধানমন্ডির ৩২নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরবেলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সামরিক বাহিনীর কতিপয় দেশবৈরী ঘাতকের হাতে স্বপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনাটি সৃষ্টি হয়।পচাঁত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকের র্নিমম বুলেট যেমন বাংলাদেশের প্রগতির ধারাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ঠিক তেমনি বিদেশে থাকা জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা'র পৃথিবী যেন উলট-পালট করে দিয়েছিল। মা-বাবা-ভাই সহ স্বজন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত অসহায় দু-বোনের জীবন হয়ে পড়ে কাণ্ডারী বিহীন নৌকার মত।
 
 
১৯৭৫ ১৫ আগস্ট খুব ভোরে আযানের আগে গোলা গুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। আম্মা, আব্বাকে ডেকে বললেন গোলাগুলির শব্দ মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিক থেকে আসছে। আব্বা বললেন, বঙ্গবন্ধুর বাসায় ঐখানে কে গোলাগুলি করবে, আজ বঙ্গবন্ধুকে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্বর্ধনা দিবে, ছেলেপেলেরা মনে হয় বাজ্জি ফুটাচ্ছে, যাইহোক আজান পরল আমি আব্বার সঙ্গে ফজর নামাজ পড়ার জন্য বেরহলাম, কলাবাগান ডলফিন গলিতে যাওয়ার পরই পুলিশের গাড়ি থেমে আছে, পুলিশ অফিসার হাতে ওয়ারলেস, দাঁড়ান কোথায় যাবেন, আব্বা বলল নামাজ পড়তে যাব সোবহানবাগ মসজিদে। যাওয়া যাবে না, আব্বা কেন? পুলিশ বললেন প্রেসিডেন্টের বাসায় ঝামেলা হয়েছে, সোজা বাসায় চলে যান। বাসায় ফিরে গেলাম, ভোরের রেডিওতে খবর মেজর ডালিমের কন্ঠে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। ঘটনাটি শুনে দৌড় দিয়ে ডলফিন গলিতে গেলাম কিছুক্ষণ পরে আর্মি এসে সবাই বাসায় চলে যান নাহলে গুলি করা হবে কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তা খালি হয়ে গেল।রাতে কারফু দিয়ে নেতাকর্মিদের ধরপাকর। 
 
আমাদের স্বাভাবিক জীবন সেদিন বিপন্ন হয়েছিল। মনে হাজার প্রশ্ন গুটিকয়েক মানুষ কি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে? কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হল,কারা হত্যায় জরিত ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানতে না পারা মানুষরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির সঙ্গে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর জেলে বন্দিদশায় চার আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলি ও কামরুজ্জুমান-এর হত্যা। কারণ ঘাতকেরা বুঝেছিল, এই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে হলে শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলতে হবে। এমনকি ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেলকেও। এর কারণ হচ্ছে, এরা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে। কারন বঙ্গবন্ধুর পরিবার রাজনৈতিক পরিবার, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর পরিবার সে সময় আন্দলোন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই পরিবার একটি রাজনৈতিক ইনস্টিটিউট,ছেলে,মেয়ে তার সহধর্মিণী, সকলেই রাজনীতির সাথে জরিত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও ছিল। যারা আমাদের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি, সেই একাত্তরের পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, দেশের রাজনীতিকে প্রগতিবিমুখ ও পাকিস্তানমুখী করতে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলো। যাদের চেষ্টায় ও তাদের সকলের হাতকে একসঙ্গে করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল।
 
 
বাংলাদেশে স্থিতি বজায় থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে পাকিস্তানের অঙ্গ রাজ্যগুলিতে স্বতন্ত্রতার আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠত। বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের বাইরে পাকিস্তানের মিত্ররা তা চাননি । বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় যাদের আপত্তি ছিল, মুজিব হত্যায় তাদেরই সম্মতি ছিল।
 
বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদে দেশে বিদেশে তারা বহু জায়গায় উৎসব করেছিল।তখন ছোট ছিলাম, মন বিশ্বাস করতে চায়নি।বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে সেদিন আমরা সবকিছুযেন হারালাম। আমরা অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে হারিয়ে গেলাম। 
 
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর  দেশে সামরিক শাসন জারি হয়।গণতন্ত্রকে হত্যা করে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। পুরো দেশ সেনাবাহিনির কব্জায় চলে যায়। জাতিয় বেঈমান খন্দকার মোশতাক পরদিন শপথবাক্য পাঠ করে ক্ষমতা নিজ হাতে নেন। পুরো দেশে তখন সেনা কারফিউ জারি করাহয়। কোনো বিক্ষোভ মিছিল হলেই আনকন্ডিশনাল ফায়ারিং এর নির্দেশ। সেনা ট্যাংক ও অস্ত্র নামানো হয়েছিল সারা দেশে। ঢাকা ও বঙ্গবন্ধুর দেশের বাড়ি ও আওয়ামী লীগের সকল ঘাঁটিতে সেনা মোতায়েন ছিল। বঙ্গবন্ধুর লাশ কড়া নজরদারিতে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে ১০ জন এর উপস্থিতিতে দাফন করা হয়। প্রতিবাদ হয়ই নাই এমনটা বলা অবাঞ্চনীয়। বিভিন্ন জায়গায় ১৫ই আগস্ট সকালে প্রতিবাদ হয়।
 
বঙ্গবন্ধু  হত্যার পর এর বিচার যাতে না হয় জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। তখন  বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাওয়ার কোনো পথ ছিল না। নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের পরবর্তীতে পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে । আত্মস্বীকৃত খুনীদের জন্য বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। ফ্রিডম পার্টি তৈরির মাধ্যমে সংসদেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা প্রতিনিধিত্ব করে। খুনীরা যে ক্ষমতাবিন্দু শাসকদের মদদে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল সেটি অত্যন্ত স্পষ্ট। 
রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখলের নজির তৃতীয়  বিশ্বে অনেক দেশেই আছে কিন্তু ক্ষমতায় না এসেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বাংলাদেশে ক্ষমতার দাপদ দেখিয়েছে তার নজির কোথাও নেই ? ফারুক-রশিদ গোষ্ঠীর এই অদৃশ্য মুরুব্বিটি কে ? খোন্দকার মোস্তাক, জিয়া, এরশাদ কারও আমলেই তো তাঁদের গায়ে আঁচড় লাগেনি। খোন্দকার না হয় কৃতজ্ঞতাবোধে কিছু করেননি, কিন্তু অন্যরা।
 
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও ছিল। জিয়াউর রহমান সরকার গঠনের পর স্বাধীনতা বিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানের দোসরদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। এতেই প্রমাণিত হয়, জিয়াউর রহমান আর যা–ই হোক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। জিয়াউর রহমান এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তের সময়ই তাঁর জড়িত থাকার তথ্যটি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান তখন বেঁচে না থাকায় আইনানুযায়ী তাঁকে অভিযোগপত্রে আসামি হিসেবে দেখানো যায়নি। একই কারণে খন্দকার মোশতাককেও বাদ দেওয়া হয়েছে। জিয়ার পথ ধরে আমরা দেখেছি জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়া হত্যাকারীদের জাতীয় সংসদে সদস্য করে তাদের পুরস্কৃত করে।
 
যুগেযুগে এমন দু’-একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করেন,যাঁরা দেশ-জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানব ঐক্যকে সবার উপরে জায়গা দেন।বাঙালী হিসেবে বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করলেন । স্বাধীনতার এ-স্বপ্ন ছুঁতেই লেগে গেল চব্বিশটা বছর। তাঁর বিশ্বাস, মহৎ অর্জনে জেল, জুলুম এই ভয়ই অতীত ও বর্তমানে বহু নেতাকে দিকভ্রষ্ট করেছে, ভুলিয়েছে তাঁদের লক্ষ্য। সত্য ও  ন্যায়, নীতি ও মানবতার একনিষ্ঠ অনুরাগী  বঙ্গবন্ধু  জীবনভর সংগ্রাম করেছেন,  স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, পাকিস্তানের শাসকদের অন্যায়, বঞ্চনার বিরুদ্ধে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে। আপোস করেননি তিনি কোনও দিন নীতি ও আদর্শের থেকে বিচ্যুত হননি কখনও জীবনের মৌল  মূল্যবোধ থেকে । তাই ভয় না পেয়ে, তাড়াহুড়া না করে, হিংসার আশ্রয় না নিয়ে মেনে নিয়েছেন, যৌবনের দীর্ঘ ১৩ বছর জেলখানায় বন্দিদশা। বন্দি অবস্থায় শারীরিক অত্যাচার না হলেও মানসিকভাবে তাঁকে পঙ্গু করে দেওয়ার কম চেষ্টা হয়নি। প্রাণে মারার চেষ্টাও করা হয় দু’-দু’বার। এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল তাঁর বন্দিজীবন। তবু হাল ছাড়েননি বঙ্গবন্ধু। জীবনে যৌবনে অনেক কিছুই হারিয়েছেন তিনি, আর তার বিনিময়ে অবশেষে তিনি বাঙালী জাতির জন্য বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। গীতিকার, মোহিনী চৌধুরী লেখা গান থেকে “মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণহল বলিদান/ লেখা আছে অশ্রুজলে/ কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা,বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা/ তাঁরা কি ফিরিবে আজ সু-প্রভাতে,…/ যাঁরা স্বর্গগত তাঁরা এখনো জানে/ স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি” স্বাধীনতা সংগ্রামী যাঁরা শহীদ হননি, বাংলাদেশ কে স্বাধীন করার জন্য তাঁরা ওই মন্ত্রেই কাজ করে গিয়েছে।
 
 
 ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মনে হয় নৈতিকতার অপমৃত্যু ঘটেছে। তখন শুরু হলো বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। পৃথিবীর সভ্যতার ধ্বজাধারীরা শান্তির ললিত বাণী পারাবত ওড়ানো প্রচার, নাকি সেদিন তাদের কৃতকর্মের জন্য সামান্যতম অনুতপ্ত হয় নাই। বরং হত্যার এই সফল অভিযানের সংবাদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভূট্টো, প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, রাজাকার প্রধান গোলাম আজম, জেনারেল জিয়াসহ দেশবিরোধীরা, সেদিন হত্যার সংবাদে আনন্দ উৎসব করেছে। সেদিন অভিনন্দন জানিয়েছিল পাকিস্তান, ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। প্রায় একই সময়ে পাকিস্তান, চীন, লিবিয়া নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। 
 
একটি বিষয়ে পৃথিবীর অন্যান্য ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপ্রধানের হত্যার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হত্যার একটি বড় পার্থক রয়েছে। সালভেদর আলেন্দেকে যখন হত্যা করা হয় চিলিতে তার বাস-ভবনে, তার স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করা হয়নি। ১৯৭৫ সালে শিশুপুত্র ১০ বছরের রাসেল সহ স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে যাতে রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উত্তরাধিকারের নাম নিশানা না থাকে। মুজিব দর্শন বলে দেশে আর কিছু যেন অবশিষ্ট না থাকে। যে অবিশ্বাস্য নৃশংসতায় হত্যা করা হয়েছিল, সেরকম আর উপমহাদেশে কাউকে হত্যা করা হয়নি। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ, বাঙালির চিরাচরিত মানসিক দীনতা দেখেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’। বিনাবিচারে নিরাপরাধ নারী ও শিশুসহ নির্মমভাবে যে হত্যা করা হয়েছিল, সে হত্যার কারণ, তারা পাকিস্তানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়েছিল।
 
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে শোকার্ত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব, সমগ্র জাতি ও দেশ শোক সাগরে মগ্ন হয়। সে সময় দেশে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যাপক নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল।বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়া বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করেন এভাবে-‘তিনি এমন এক বিশাল ব্যক্তিত্ব যার সামনে সহসা মাথা ন্যুয়ে আসে।’ সে সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ ফলাও করে প্রচার করা হয়। বিশ্ব নেতারা জানিয়েছিলেন তীব্র নিন্দা। তাদের মধ্যে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রো, ভিয়েতনামের কেনেথা কাউণ্ডা, ইয়াসির আরাফাত, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট, জেমসলামন্ড, ব্রিটিশ এমপি,   আকাশ বানী কলকাতা,ডেইলি টেলিগ্রাফ, বিবিসি-,সাংবাদিক ব্রায়ান ব্যারন,  ফিন্যান্সিয়ালটাইমস বলেছে,‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিতো না।’ একইদিন ১৬ই আগস্ট ১৯৭৫ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাম পত্রিকায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরনীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’ নিউজ উইক বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেয়া হয়,“পয়েট অফ পলিটিক্স বলে” প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক  দ্যা গার্ডিয়ানের মতে, ‘ শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।’ ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয় বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্যা ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা” সে-সময় সমগ্র বিশ্বে ওই ঘটনা প্রচন্ড হৃদয়াবেগের সঞ্চার করেছিল, আব্রাহাম লিঙ্কনের অনুরুপ শহীদের মৃত্যুবরণের পরবর্তী মানবেতিহাসে আর কোনও মৃত্যুর সঙ্গে যার তুলনা চলেনা। যেভাবে তাঁর জীবনাবসান হয়েছিল, তা তাঁর তিরোধানের বেদনাকে তীব্রতর করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা আগামী শতাব্দী গুলিতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
 
 
বিশ্বের অনেক জাতি বা রাষ্ট্রের স্রষ্ঠা অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে নিতে হয়েছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্রষ্টা আব্রাহাম লিংকন স্বাভাবিক মৃত্যুর সুযোগ পাননি।তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল।ভারত ও বাংলাদেশের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু দুজনই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ঘাতকের গুলিতে নিহত হয়। কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, চিলির সালভাদর আলেন্দে, ব্রাজিলের জোয়াও গোলার্ট, ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেক, গুয়াতেমালার জ্যাকাবো আরবেঞ্জ কিংবা ঘানার কোয়ামে নক্রুমার ও মিশরের আনোয়ার সাদাত তারা নিজ নিজ দেশে যখন সংস্কারের কর্মসূচি শুরু করেছেন, সি আইএ’র সাহায্য নিয়ে সেই দেশের সেনাবাহিনী তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
 
পৃথিবীর এই ক্ষমতাচ্যুত নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি বিষয়ে মিল ছিল। তিনিও তাদের মত জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি নিজ দেশের সম্পদ সুষম বন্টনের জন্য বিদেশ র্নিভরতা কমিয়ে সংস্কারের কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের সম্পদ, তেল গ্যাস বিদেশি কোম্পানির হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন শুরু করেছেন দ্বিতীয় বিপ্লব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের ঘোর সমর্থক ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল এবং এমনকি ৭ম নৌবহর পাঠানোর হুমকি দিয়েছিল। এই ঘটনাটি দেশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।
 
প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সরকারের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। বঙ্গবন্ধু বললেন, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়ায় ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এই বাস্তবতা নিক্সন প্রশাসন মেনে নিতে পারছেনা। তারা চেয়েছিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে মিলিতভাবে তারা ভারত মহাসাগরে নৌঘাঁটি স্থাপন ও ভারতে সোভিয়েত প্রভাব হ্রাসে ব্যবহার করবে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলিত ভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করায় তাদের এই পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর কথা থেকে বোঝা যায় উনি নিজেও জানতেন উনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে।
 
১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে ঘিরে মার্কিন কূটনীতির ব্যর্থতা প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের জন্য ছিল প্রবল পরাজয়। বাংলাদেশের অদ্ভুদোয় আমেরিকা মেনেনিতে পারেনি, কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহিন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছিল, প্রতিশোধ নিতে কিসিঞ্জারের সরাসরি হস্তক্ষেপে  ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ওই পরাজিত শত্রুদের দোসর নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করল যেন। পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সমাজতন্ত্রী ভাবাপন্ন নেতাদের বিভিন্ন সময় সিআইএ একে একে হত্যা করেছে। ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করানো হয়েছে শিখ বিছিন্নতাবাদীদের দ্বারা। 
 
“বাংলাদেশ, দি আনফিনিশড রেভলিউশান"-এর লেখক লরেন্স লিফশুলজ  লিখেছেন যে মুজিব হত্যার চক্রান্তকারীরা ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনাও হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এই যোগাযোগ রক্ষার ভার পড়েছিল ঢাকায় সি আই এ-র প্রধান ফিলিপ চেরির উপর, অথচ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি গোষ্ঠীর যে যোগাযোগ ছিল তা তো নিছক রটনা নয়। স্বয়ং কিসিঞ্জার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, এই যোগাযোগের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য তিন মাস ধরে এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়েছিল । শেষ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক বিনা কারণে অপসারিত হননি।  মেজরদের ষড়যন্ত্রের কথা খোন্দকার জানতেন মুজিবকে হত্যা করে তাঁকে ক্ষমতায় বসানোই যে মেজরদের ইচ্ছা তাও তাঁর অজানা ছিল না। কাজেই যে অসামরিক যোগাযোগকারীর কথা লিফশুলজ লিখেছেন তিনি যদি খোন্দকার হন তাতে আশ্চর্য কি! তিনি আমেরিকানদের পরিচিত, আমেরিকানরাও তাঁর পরিচিত। 
 
 
ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল সেটা একদিন বের হবে। ‘হত্যার বিচার হয়েছে। তবে এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল, একদিন সেটাও আবিষ্কার হবে।  তবে আগামী প্রজন্ম জানতে চায়, কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বে বহুবার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়েছে এবং অনেক রাজনীতিবিদকে হত্যা করেছে। এদের কোপানলে পড়ে অকালে জীবন দিয়েছেন কত বরেণ্য নেতা, ইতিহাস তার নিরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে।রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই কথাটি প্রযোজ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট সেই মৃত্যুহীন প্রাণ' তিনি জাতিকে দান করে গেছেন।  
 
এদেশে বঙ্গবন্ধুর জন্ম গ্রহণ আমাদের প্রতি বিধাতার অশেষ করুনার নিদর্শন। এই অন্ধকার, বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে তেমন মানুষের দীপ্তি এক মহান আলোকবর্তিকার মতো বিচ্ছুরিত হয়। যেসকল ভবিষ্যদ্বক্তার হৃদয়ে সাহস থাকে, মনে থাকে বিনয়, যাঁদের হাসিতে বোঝা যায় তাঁরা ভয়হীন-বঙ্গবন্ধু তাঁদের দলে। বাংলাদেশের নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার অধিনায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী।
 
লেখক: সভাপতি,আমরা ক’জন মুজিব সেনা ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK