বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০১:২০

সহায়হীন মানুষের পাশে তরুণ শেখ মুজিব

সহায়হীন মানুষের পাশে তরুণ শেখ মুজিব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আজীবনের স্বপ্ন ছিল অসহায় ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। শৈশব-কৈশোর থেকেই অসহায়, দরিদ্র, বিপন্ন ও সহায়হীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন মানবতার মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান।
 
মুহাম্মদ সামাদ
 
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতি­র পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (২০১২), ‘কারাগারের রোজনামচা’ (২০১৭) এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ (২০২০) এই তিন খণ্ডে রচিত এক মহাকাব্যিক আত্মকথা। এসব আত্মকথা বা আত্মজীবনী সহজিয়া ভাষা, অনুপম বর্ণনা ও সাহিত্যে-বিচারে একেকটি অমর কাব্যের তুল্য। এ প্রসঙ্গে আমরা বিশ্বের মহৎ কিছু আত্মজৈবনিক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করতে পারি। রাজ­­­­­নীতিক ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইস্টন চার্চিল তার বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত ভাষণ-বক্তৃতা-বিবৃতি নিয়ে গ্রন্থিত আত্মজৈবনিক সংকলনের জন্য ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনকারী ও পথিকৃত সম্রাট জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবরের আত্মকথা ‘বাবুরনামা’র খ্যাতি বিশ্বজনীন। ব্রিটিশ ভারতের সিভিল সার্ভিস অফিসার ও ভারত বিশেষজ্ঞ হেনরি বেভারিজকে (১৮৩৭-১৯২৯) উদ্ধৃত করে ইংরেজ প্রাচ্যবিদ-প্রতœতাত্ত্বিক স্ট্যানলি লেইন-পুল (১৮৫৪-১৯৩১) ইউরোপের সেন্ট অগাস্টিন ও রুশোর কনফেশনস এবং ইতিহাসবেত্তা অ্যাডওয়ার্ড গিবন ও বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের আত্মজীবনীর সঙ্গে তুলনা করে ‘বাবুরনামা’কে এশিয়ার একমাত্র সুলিখিত ও প্রাণবন্তু আত্মজীবনী রূপে উল্লেখ করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী ‘দি স্টোরি অব মাই ইক্সপেরিয়েন্স উইথ ট্রুথ’ বর্ণবৈষম্য ও শোষণ-বঞ্চনার নিরিখে দক্ষিণ আফ্রিকায় আর ভারতবর্ষে মানবাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্যপট আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে অবস্থান করে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পটভূমি ও স্ব^প্নে ভরপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিন খ-ের আত্মজীবনী আমাদের সম্রাট বাবরের ‘বাবুরনামা’-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়!
বঙ্গবন্ধু রচিত তিনখানি আত্মকথার বিস্তৃত সৈকতে মণি-মুক্তার মতোন ছড়িয়ে থাকা নানান ঘটনা ও চিন্তা-দর্শনের মূল ভিত্তি পরার্থে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা ও গভীর মমত্ববোধের ওপর স্থাপিত। এই গ্রন্থ তিনটি নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অবারিত সুযোগ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মকথায় তার মহাজীবনে অসহায়, অত্যাচারিত ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কিছু ঘটনা বিশ্লেষণের চেষ্টা এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য।
 
অসমাপ্ত আত্মজীবনী
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে দেখা যায়, শেখ মুজিবের কৈশোরে তার পিতা শেখ লুৎফর রহমানের ওপর বিরাট যৌথ সংসারের গুরুভার ও কষ্ট-কঠিন দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। ১৪ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে এবং ১৬ বছর বয়সে চোখে গ্লুকোমা হলে চিকিৎসার জন্য তার পিতা তাকে দুবার কলকাতায় নিয়ে যান ও তাকে সুস্থ করে আনেন। চার বছর তার লেখাপড়ার বিরতি ঘটে। ইতোমধ্যে সমাজের বৈষম্য ও রাজনীতি সম্পর্কে তিনি সচেতন হয়ে ওঠেন। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর দলের অনুরাগী হয়ে পড়েন। ইংরেজের হাত থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করার শপথে শাণিত হন এবং প্রতিবাদী ও দরদি হৃদয় নিয়ে শেখ মুজিব সহায়হীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু তার শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি-র মুসলিম সেবা সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং গরিব ছাত্রদের সাহায্যে আত্মনিয়োগ করেন। (পৃ. ৭-৯)। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্ঠি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন।” (পৃ. ৯)
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় বাংলায় মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ হয়। ইংরেজ সরকার সৈন্যদের জন্য সমস্ত গুদামজাত খাদ্যদ্রব্য জব্দ করে। ব্যবসায়ীরা চাল-ডালসহ সকল খাদ্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। সেই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : “দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটেছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই। কাপড় নাই।… ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চাউল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন দিন নাই রাস্তায় লোকে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। (পৃ. ১৭)। … ইংরেজের কথা হল, বাংলার মানুষ যদি মরে মরুক যুদ্ধের সাহায্য আগে।… বাংলাদেশের এই দুরবস্থা চোখে দেখেছি যে, মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছুর খাবার জন্য কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তা ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতে রাজি হয় নাই। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, ‘মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও।’ এই কথা বলতে বলতে ঐ বাড়ির দুয়ারের কাছেই পড়ে মরে গেছে।” (পৃ. ১৭-১৮)
অসহায়-দুঃখী মানুষের কষ্টে ব্যথিত বঙ্গবন্ধুর এহেন হৃদয়বিদারক বর্ণনা আজও আমাদের মুহ্যমান করে তোলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার সিভিল মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং তার ওপর দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার দায়িত্ব পড়েছিল। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ইংরেজদের খাদ্য মজুদের নির্দয়তা, অন্যদিকে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আহাজারি। এই ভয়াবহ সময়ে মানবদরদি শেখ মুজিব পড়াশোনা বন্ধ রেখে দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষ বাঁচাতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় : “এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম।” (পৃ. ১৮)
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র বাস্তবায়নের দাবিতে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষিত ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালন করতে গেলে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। হত্যা, লুটতরাজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আক্রমণে কলকাতা নরকে পরিণত হয়। সেই সময় তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দাঙ্গায় আক্রান্ত উভয় ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষদের রক্ষায় এগিয়ে গেছেন। বর্ধমানের আসানসোলে ও বিহারের পাটনায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। বন্ধু মোয়াজ্জেম চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে রাত জেগে বন্ধুক হাতে কলকাতার মুসলমান বস্তি পাহারা দিয়েছেন। আবার হিন্দু-মুসলমানদের পরস্পরকে রক্ষার প্রয়াস দেখে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলো ফুটে উঠেছে তার হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : “একটা কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আবার অনেক মুসলমান পাড়াপড়শীকে রক্ষা করতে যেয়ে জীবন দিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ পেয়েছি। মুসলিম লীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত, তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে, শীঘ্রই এদের নিয়ে যেতে বলেছে, নতুবা এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে।” (পৃ. ৬৭)
বাংলাদেশের গরিব-দিনমজুররা ধান ওঠার মৌসুমে দল বেঁধে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ধান কাটার কাজ করতে যেত; তাদের ‘দাওয়াল’ বলা হতো। যেমনÑ ঢাকা ও ফরিদপুরের দাওয়ালরা খুলনা ও বরিশাল জেলায় এবং কুমিল্লা জেলার দাওয়ালরা সিলেট জেলায় ধান কাটতে যেত। এই গরিব-দিনমজুররা ধান কেটে গৃহস্থের ঘরে উঠিয়ে দিত এবং বিনিময়ে ধানের একটা অংশ পেত। একবার পূর্ব বাংলার কিছু জেলায় খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে সরকার কর্ডন প্রথা চালু করে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খাদ্য আনা-নেওয়া বন্ধ করে দেয়। পরিণতিতে, বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “এরা প্রায় সকলেই গরিব ও দিনমজুর। প্রায় দুই মাসের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে এদের যেত হত। যাবার বেলায় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসার খরচের জন্য দিয়ে যেত। ফিরে এসে ধার শোধ করত।… বহু বৎসর যাবৎ এই পদ্ধতি চলে আসছিল। ফরিদপুর, ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার হাজার হাজার লোক এই ধানের উপর নির্ভর করত। দাওয়ালরা যখন ধান কাটতে যায়, তখন সরকার কোন বাধা দিল না। যখন তারা দুই মাস পর্যন্ত ধান কেটে তাদের ভাগ নৌকায় তুলে রওয়ানা করল বাড়ির দিকে তাদের বুভুক্ষ মা-বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়াবার জন্য, যারা পথ চেয়ে আছে, আর কোন মতে ধার করে সংসার চালাচ্ছেÑ কখন তাদের, স্বামী, ভাই, বাবা ফিরে আসবে ধান নিয়ে, পেট ভরে কিছুদিন ভাত খাবে, এই আশায়Ñ তখন নৌকায় রওয়ানা করার সাথে সাথে তাদের পথ রোধ করা হল। ‘ধান নিতে পারবে না, সরকারের হুকুম’, ধান জমা দিয়ে যেতে হবে, নতুবা নৌকাসমেত আটক ও বাজেয়াপ্ত করা হবে। … এ খবর পেয়ে আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করলাম। সভা করলাম, সরকারি কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎও করলাম কিন্তু কোন ফল হল না।… এই লোকগুলি দিনমজুর। দুই মাস পর্যন্ত যে শ্রম দিল, তার মজুরি তাদের মিলল না। আর মহাজনদের কাছ থেকে যে টাকা ধার করে এনেছিল এই দুই মাসের খরচের জন্য, খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পরে দেনার দায়ে ভিটাবাড়িও ছাড়তে হল।” (পৃ. ১০৩-১০৪)
১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা দাবি-দাওয়া আদায়ের কোনো উপায়ান্তর না দেখে ধর্মঘট পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত করে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান ও আন্দোলনে সমর্থন দেন। কর্মচারীদের দাবির সমর্থনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ৫ মার্চ থেকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়। (পৃ. ৪৬)। এই কর্মচারীদের নিয়োগবিধি, সুযোগ-সুবিধা ও চাকুরির নিশ্চয়তা কিছুই ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ভাষায় : “… ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে যেয়ে শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেছে এবং ছাত্ররা তার সমর্থনে ধর্মঘট করছে।… তাদের সারা দিন ডিউটি করতে হয়।… চাউলের দাম ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। চাকরির কোনো নিশ্চয়তাও ছিল না। ইচ্ছামত তাড়িয়ে দিত, ইচ্ছামত চাকরি দিত।” (১১১-১১২) যা হোক, বঙ্গবন্ধু দাবি আদায়ের জন্য প্রথমে ছাত্রনেতাদের নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এতে কোনো ফল না-হওয়ায় তাদের ধর্মঘট ও শোভাযাত্রায় যোগ দেন। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ দাবি-দাওয়া তো মানলোই না, উল্টো ১২ মার্চ বিশ^বিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে ধর্মঘটে যোগদানকারী কর্মচারীদের বরখাস্ত করল। অন্যদিকে, ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল বঙ্গবন্ধুসহ আন্দোলনে অংশ নেওয়া ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে বহিষ্কার, জরিমানা, জরিমানাসহ মুচলেকা, ট্রান্সফার সার্টিফিকেট, ছাত্রবৃত্তি বাতিলসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করল। সে-সময় ছাত্র-ছাত্রীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে এবং সারাদেশে জেলায় জেলায় ধর্মঘট হয়; ছাত্ররা উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থান [ধর্মঘট] করে; এবং সব শেষে উপাচার্যের বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হয়। অন্যদিকে অধিকাংশ শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রী জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নেন। কর্মচারীদেরও মনোবল ভেঙে পড়ে এবং তারা কাজে যোগ দেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান মাথানত করেন নাই। তিনি জরিমানা ও মুচলেকা দেন নাই। ট্রান্সফার সার্টিফিকেটের জন্য কোনো আবেদনও করেননি। ফলে, ১৯৪৯ সালে ১৭ এপ্রিল তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়। সহজ কথায় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন।
 
কারাগারের রোজনামচা
বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড ‘কারাগারের রোজনামচা’য় অসহায়, অবহেলিত ও সমাজের নিচুতলার মানুষের দুঃখ-কষ্টে কীভাবে ব্যথিত হয়েছেন; বিনা অপরাধে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা দরিদ্র মানুষদের স্ত্রী-পরিজনদের দুঃশ্চিন্তায় ক্ষুব্ধ হয়েছেনÑ তা পড়লে তার সংবেদনশীল মনের পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে; দুচোখ জলে ভরে যায়। এখানে ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে কিছু ঘটনা উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
তিনি বইপত্র ও পত্রিকা পড়ার পাশাপাশি কারাগারে দিনের পর দিন কয়েদিদের বিচিত্র জীবন-কাহিনি শুনেছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : “আমি কয়েদিদের কাছে বসে তাদের জীবনের ইতিহাস ও সুখ-দুঃখের কথা শুনতে ভালবাসতাম।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২০)। এসব থেকে গোপালগঞ্জের দুর্ধর্ষ ডাকাত রহিম মিয়া, মুন্সিগঞ্জের ফেলু ময়াল, মানিকগঞ্জের কয়েদি ফয়েজ; এবং অন্যান্য কয়েদি যেমনÑ কেরামত, ফণী, ইউনুছ, নেছার খা, নুরু, বেলালসহ আরও অনেকের বন্দি-জীবনের গল্প ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’য় উঠে এসেছে। তাদের কাহিনিগুলোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সমাজ, সরকার, রাষ্ট্র সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ ধারণা গ্রহণ করতেন। বঙ্গবন্ধু লুৎফর রহমান ওরফে লুদু নামে এক পকেটমারের জীবন-কাহিনি বর্ণনা করেছেন আট পাতাজুড়ে। (হারুন-অর-রশিদ, পৃ. ৯)। বঙ্গবন্ধু দেখেছেনÑ ফরিদপুর কারাগারে কয়েদিদের দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল করা হতো। এই অমানবিকতা বঙ্গবন্ধুকে ব্যথিত ও বিচলিত করে তোলে। তিনি কারাগারে এহেন কষ্টকর কাজ বন্ধ করার জন্য জেলারকে বলেন এবং কিছুদিনের মধ্যে তা বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে এক ভুক্তভোগী কয়েদির কৃতজ্ঞতাবোধ উল্লেখ না করলেই নয়- সিংহহৃদয় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “হুজুর দিনভরে গরুর মতো ঘুরে রাতে যখন শুতে যাইতাম তখনও মনে হতো ঘুরছি, ঘুমাতে পারতাম না, দেখেন সেই যে শরীর নষ্ট হয়ে গেছে আর ভাল হয় নাই। খোদা আপনাকে বাঁচাইয়া রাখুক, আপনি জেলে না আসলে আর কতদিন যে গরুর মতো ঘুরতে হতো বলতে পারি না।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ৪২-৪৩)
আত্মজীবনীতে দেখা যায়, ১৯৫০ সালের শেষ দিকে ফরিদপুর কারাগারে গোপালগঞ্জের নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক ও মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী চন্দ্রঘোষ একবার বঙ্গবন্ধুকে ‘মানুষকে মানুষ হিসেবে’ দেখার উপদেশ দিয়েছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন : “চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৯১)। বঙ্গবন্ধুর সেই কথার প্রমাণ মেলে ‘কারাগারের রোজনামচা’য়। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর প্রকোষ্ঠের পাশের সেলে মানসিক প্রতিবন্ধীদের রাখা হয়েছিল। তার আত্মজীবনীতে এই বন্দি প্রতিবন্ধীদের বঙ্গবন্ধু সম্বোধন করেছেন ‘পাগল ভাই’ বলে। এই পাগলদের উৎপাতে অনেক রাত তাকে নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে। তবু কারাগার থেকে সরবরাহ করা মুরগির মাংস বঙ্গবন্ধু না খেয়ে জমিয়ে রেখে গভীর মায়ায় তাদের জন্য রান্না করে পাঠাতেন। বঙ্গবন্ধুর সংবেদনশীল লেখনীতে তার ‘পাগল ভাইদের’ কথা উঠে এসেছে এভাবে : “৪০ সেলের পাগলা গারদের পাগল ভাইদের জন্য নিজেই মুরগি পাক করে পাঠাইয়া দিলাম। আমি না খেয়ে জমাইয়া ছিলাম। আমার যাওয়ার হুকুম নাই ওদের কাছেÑ যদিও খুব কাছেই আমি থাকি… ওরা যে আমার বহুদিনের সাথী, ওদের কি আমি ভুলিতে পারি?” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২০৪)
বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফার পক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। তেজগাঁওয়ে শ্রমিক মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহিদ হন। প্রায় ৮০০ সাধারণ নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এই দরিদ্র-সাধারণ মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা আমাদের আবেগপ্রবণ করে তোলে : “যাদের ধরে নিয়ে এসেছে এরা গরিব, দিন মজুরি না করলে বাঁচতে পারবে না। অনেক রিকশাওয়ালাকে এনেছে, বোধ হয় বাড়িতে তাদের ছেলে-মেয়ে না খেয়েই আছে।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ৭৫-৭৬)
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু সব সময় একাধিক কয়েদিকে সঙ্গে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় : “আমি না খেয়ে থাকতে রাজি, কিন্তু ওদের না দিয়ে খেতে পারব না।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১১৬)। বঙ্গবন্ধু তার ‘কারাগারের রোজনামচা’র আরেক জায়গায় এই রাজবন্দিদের পরিবার-পরিজনদের সম্পর্কে মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন : “এমন অনেক লোক [কারাগারে] আছে যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে, এমনকি ইজ্জত দিয়েও সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দির স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে করুণ কাহিনী কল্পনা করতেও ভয় হয়।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ৯৪)
 
আমার দেখা নয়াচীন
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে ১৯৫২ সালে চীনের বেইজিংয়ে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। অতঃপর ১৯৫৪ সালে কারাবন্দি অবস্থায় তার এই তৃতীয় আত্মজীবনী ‘আমার দেখা নয়াচীন’ (২০২০) রচনা করেন। এক নাগাড়ে ২৫ দিনের চীন ভ্রমণের হৃদয় উৎসারিত অবলোকন ও পর্যবেক্ষণের অনুপুঙ্খ বর্ণনা এই গ্রন্থ। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’র মতোন নতুন রাষ্ট্র চীনের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির যাত্রারম্ভের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি চীনের জনমানুষের জীবনযাত্রার হালচাল প্রত্যক্ষ করেছেন। ছুটে গেছেন চীনের এক শহর থেকে আরেক শহরে। এভাবে পিকিং (বর্তমানে বেইজিং), তিয়ানজিং, নানকিং, ক্যান্টন, সাংহাই ও হ্যাংচো শহরে ঘুরেছেন। দোকান-পাট, শিল্প-কারখানা, কৃষি খামার, চাষা-আবাদ, স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও হাসপাতাল দেখেছেন। বিশেষত দরিদ্র-অসহায় মানুষের জীবনের আনন্দ-বেদনা দেখার প্রবল আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে তার দরদি কলমে। গ্রন্থটি থেকে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে লেখাটির আপাতত ইতি টানতে চাই।
নয়াচীনের শ্রমিক-কৃষকদের জীবনযাপন নিয়ে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের পর্যবেক্ষণ ও নিজের দেশ নিয়ে স্বপ্নের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। ঘটনাটি বেইজিং শহরের। নয়া সরকারের নতুন নীতি ও নতুন ব্যবস্থার প্রভাবে একজন রিকশাওয়ালার সততা পরীক্ষা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “রিকশায় ঘুরে বেড়াই।… উঠে বসে পড়লাম।… দেখি ঠিক হোটেলেই নিয়ে এসেছে। আমার মনে মনে একট কথা উঠলো, দেখি বিদেশি লোক পেলে, কেমন লুট করে। আমি হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে প্রায় ১০ টাকা পরিমাণ হাতে করে ওর সামনে ধরলাম। ভাবেসাবে বুঝাইয়া দিলাম, যাহা তোমরা নিয়ে থাকো তাই নেও। রিকশাওয়ালা আমার হাত থেকে ঠিক আটআনা পয়সা গুনে নিয়ে চলে গেল।” (পৃ. ৪৮)
পরে দোভাষীর সঙ্গে আলাপ করে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন- পূর্বে চিয়াং কাইশেকের আমলে মালিকরা রিকশাওয়ালাদের সামান্য কিছু পয়সা দিয়ে সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটনির সব টাকা জোর করে নিয়ে নিত। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তারা খুব দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করত। নয়াচীনের নতুন ব্যবস্থায় রিকশাওয়ালাদের চরিত্রের সততা, সুন্দর জীবন ও মহাজনদের মালিকানা দুটোই বঙ্গবন্ধুর মনঃপূত হয়েছিল। দোভাষীর মুখের কথা ও বঙ্গবন্ধুর ভাষায় : “দেখো এদের ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ আছে। এরা যা উপার্জন করে যতটুকু এদের দরকার তা রেখে যতটুকু সম্ভব ইউনিয়নে জমা দেয়। সেই টাকা দিয়ে ওদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, ওদের জন্য থাকার বাড়ি, রিকশা মেরামত, চিকিৎসার বন্দোবস্ত ও অন্যান্য কাজ করে দেয়া হয়। এখানে বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ : ‘… আপনারা মনে করবেন না, কম্যুনিস্ট দেশÑ তাই মহাজনদের রিকশা সব কেড়ে নিয়ে রিকশা চালকদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহাজনরা রীতিমতো ভাড়া পাচ্ছে।’” (পৃ. ৪৮-৪৯ )
‘আমার দেখা নয়াচীন’ পড়লে মানুষের বাক স্বাধীনতার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অকুণ্ঠ সমর্থন প্রশংসনীয়। গ্রন্থের সর্বশেষ প্যারায় সেই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট এবং জোরালো হয়েছে তার অসাধারণ সারল্য ও অনুপম ভাষা কুশলতায় : “আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।” (পৃ. ১১৯)। বঙ্গবন্ধু চিন্তায় সমাজে ধনী-গরিব মিলেমিশে বসবাসের একটা দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। নয়াচীনের সাংহাইয়ে তখনকার সময়ে ব্যক্তি মালিকানায়, চীনাদের মতে, এশিয়ার বৃহত্তম কাপড়ের মিল দেখতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই মিল পরিদর্শন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ তাৎপর্যপূর্ণ : “এই মিলটা একটা কোম্পানির, একজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর সমস্ত কিছু দেখাশোনা করেন। আমরা শুনেছিলাম যে, চীনে সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, এটা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। … মিলগুলি জাতীয়করণ না করেও এমন বন্দোবস্ত করা হয়েছে যে, ইচ্ছামতো লাভ করা চলে না। সরকারকে হিসাব দাখিল করতে হয়। যে টাকা আয় হবে তা শ্রমিকদের বেতন, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত, চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য ব্যয় করতে হবে। আর যা বাঁচবে তা দিয়ে মিলের উন্নতি করতে হবে। আর যারা মালিক তাদের লভ্যাংশের কিছু অংশ দেওয়া হয়।” (পৃ. ৬৯-৭১)
আশৈশব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। নয়াচীনের শ্রমিকদের উন্নত জীবনযাপনে কী যে খুশি হয়েছিলেন, তার ভাষাতেই আমাদের তা অনুভব করা বাঞ্ছনীয় : “আমরা দেখে আনন্দিত হলাম, মেয়ে শ্রমিকরা যখন কাজে যায় তখন তাদের ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করার জন্য মিলের সাথে নার্সিং হোম আছে। কাজে যাওয়ার সময় ছেলেমেয়েদের সেখানে দিয়ে যায়।… শ্রমিকদের জন আলাদা হাসপাতাল আছে। অসুস্থতার সময় বেতনসহ ছুটি দেওয়া হয়।… দুপুরে বেলা খেয়ে আবার বেড়িয়ে পড়ি, শ্রমিকদের জন্য যে কলোনী করা হয়েছে তা দেখার জন্য। দু’মাইল লম্বা বিরাট কলোনী করা হয়েছে, আরও অনেকগুলি হচ্ছে। তার মধ্যে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল করা হয়েছে। (পৃ. ৭০-৭১)
চীনের মানুষের সঙ্গে কথা বলে, ঘুরে ঘুরে, পিকিং থেকে হংকং পর্যন্ত ট্রেনযাত্রার সময় গ্রাম-গঞ্জ-শহর দেখে সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সেদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করেছেন। ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ চিয়াং কাইশেক-এর আমলের কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচারের কথা বিবৃত করেছেন বঙ্গবন্ধু। সে-প্রসঙ্গে নিজের দেশের জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনিও উল্লেখ করতে ভোলেননি। বাংলার দুঃখী মানুষের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আবার চীনের নতুন সরকারের কৃষি ব্যবস্থার কথা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছেন। তার লেখার ভাষ্য এ-রকম : “চিয়াং কাইশেকের আমলে জমির মালিক জমিদারই ছিল। চাষির জমির ওপর কোনো অধিকার ছিল না। চাষিরা ক্ষেতমজুরি করে কোনো মতে জীবনযাপন করতো।… চাষিরা জমির অধিকার চাইলে তাদের গুলি খেয়ে মরতে হতো।… ধরে এনে বেত মারতো। না খাওয়াইয়া আটকাইয়া রাখতো। আমাদের দেশেও পূর্বে এই ব্যবস্থা ছিল। যদি কোনো কৃষকের মেয়ে দেখতে ভালো হতো, তবে তো আর উপায় ছিল না। জমিদারের হুকুম তাকে জমিদারের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতে হবে, খাজনার পরিবর্তে। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তার ওপর জমিদার অথবা তার ছেলেরা পাশবিক অত্যাচার করবে এবং কামভাব চরিতার্থ করবে।… যদি কোনো মেয়ের বাবা মা আপত্তি করে, তবে তার সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হবে এবং অমানুষিক অত্যাচার করে দেশে থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।… [চীনে] জমিদাররা অনেক জমি ফেলে রাখতো,… এইভাবে কোটি কোটি বিঘা পড়ে থাকতো অনাবাদি হয়ে।… কোটি কোটি লোক কাজের অভাবে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতো। কেউ চুরি ডাকাতি করতো আর কেউ না খেয়ে শৃগাল কুকুরের মতো রাস্তাঘাটে পড়ে থাকতো। এমনও শোনা গেছে যে পেটের দায়ে বাবা মা মেয়েদের দিয়ে [দেহ] ব্যবসা করিয়ে কোনোমতে খাওয়ার বন্দোবস্ত করতো।” (পৃ. ৮৭-৮৮)
‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ বঙ্গবন্ধু চীনের সমাজের বৈষম্য, নিপীড়িন ও অভাবের কারণে সেদেশের মানুষের কমিউনিস্ট পার্টির পথ অনুসরণের কথা উল্লেখ করেছেন। এ যেন বাঙালির বাঁচার দাবি ৬-দফার পথ ধরে মুক্তির পথে এগিয়ে চলার কথা; ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২৮ অক্টোবর রেডিও-টেলিভিশনের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালির মুক্তির কথা; এবং নির্বাচনে বিশাল বিজয়ের পর ‘মানুষে মানুষে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চির-অবসান ঘটিয়ে শোষণমুক্ত এক সুখী সমাজের বুনিয়াদ গড়ার এবং অন্যায় অবিচার বিদূরিত করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার’ শপথের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য যখন বেআইনি কম্যিনিস্ট আবেদন জানালো, তখন মানুষ তার দিকে ছুটে চললো।… নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন, ‘লাঙল যার জমি তার’ এই প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে। বড় বড় জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করে গরিব ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বণ্টন করে দিলো।… হাজার হাজার বেকার কৃষক জমি পেলো।… তারা পুরা উদ্যমে চাষবাস শুরু করলো।… নয়াচীনে একখ- জমি দেখলাম না যা অনাবাদি অবস্থায় পড়ে আছে। রেল লাইনের পাশে যে গর্তগুলি পড়ে থাকে সেগুলিতেও ফসল করা হয়েছে।” (পৃ. ৮৯)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আজীবনের স্বপ্ন ছিল অসহায় ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। শৈশব-কৈশোর থেকেই অসহায়, দরিদ্র, বিপন্ন ও সহায়হীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন মানবতার মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে বর্ণিত সহায়হীন মানুষের পাশে দাঁড়ানো তরুণ শেখ মুজিবের মানবতার সেবা আমাদের শাণিত ও প্রাণিত করে। তাই হয় তো বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা ও রাষ্ট্রপিতা শেখ মুজিব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আদলে তার রাজনৈতিক দর্শনে, চিন্তায় ও শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে বাকশাল কায়েম করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন : “… আমরা চেয়েছি একটি শোষণমুক্ত সমাজ, আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, আমরা চেয়েছিলাম এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য।” এবং এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানবতার সেবায় উৎসর্গিত ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি। জীবনের পথে পথে, জেল-জুলুম-নির্যাতনে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে, আনন্দে-বেদনায় তার সংগ্রাম ও সাফল্যের পেছনে রয়েছে আন্তরিক সত্যতা, অসম সাহস, দুর্দমনীয় কর্মনিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীগুলি পড়তে পড়তে ইতিহাসবিদ, রাজনীতির গবেষক এমন কী সাধারণ পাঠকেরও বারবার মনে হবে রবীন্দ্র্রনাথের কবিতা : “চিনিলাম আপনারে/আঘাতে আঘাতে/বেদনায় বেদনায়;/সত্য যে কঠিন,/কঠিনেরে ভালোবসিলাম/সে কখনো করে না বঞ্চনা।” (সঞ্চয়িতা, পৃ. ৫৫৪)। তাই তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং বাঙালি জাতির পিতা।
 
লেখক : কবি, উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK