বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ০৫:০৬

১৫ আগস্ট আমাদের সম্মিলিত পাপ

১৫ আগস্ট আমাদের সম্মিলিত পাপ

সিঁড়িতে পড়ে আছেন রক্তাপ্লুত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির নতুন ইতিহাসের নির্মাতা। লজ্জায় মুখ লুকোয় সকালের সূর্য। কালো গিলাপে ঢাকা পড়ে বাংলাদেশের বাঙালির ইতিহাস। ইতিহাসের মৃত্যু।
 
নূহ-উল-আলম লেনিন
স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে একটি মানুষ। নিথর নিস্পন্দ। পাশে একগুচ্ছ ফুলের শব। কোথাও কেউ নেই। অনুগ্রহভাজন, কৃপাপ্রার্থী, স্তাবক, ভক্ত, অনুরাগী, আদর্শের সৈনিক, পারিষদবর্গ, আমির ওমরাহ- কেউ নেই। চারদিকে কেবল নৈঃশব্দের তর্জনী।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। রাতের প্রায় শেষ অব্দ। পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রামগ্ন বাংলাদেশ। অকস্মাৎ বজ্রপাত। মুহুর্মুহু রিকয়েললেস রাইফেল আর কামানের গর্জন। খান খান ভেঙে পড়ে রাতের মৌন। তারপর আবার সব কিছু সুনসান। নিশ্ছিদ্র নীরবতা। কেবল বাতাস কেঁদে ফেরে শব্দহীন আর্তনাদ। নিত্যদিনের মতোই সূর্য উঁকি মারে নির্দিষ্ট নিয়মে। অদূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে সকরুণ আজানের ধ্বনি। ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির ওপর আলো পড়তেই শিউরে ওঠে নিখিল চরাচর। সিঁড়িতে পড়ে আছেন রক্তাপ্লুত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির নতুন ইতিহাসের নির্মাতা। লজ্জায় মুখ লুকোয় সকালের সূর্য। কালো গিলাপে ঢাকা পড়ে বাংলাদেশের বাঙালির ইতিহাস। ইতিহাসের মৃত্যু। End of History.
বদলে যায় দৃশ্যপট। বেতারে খুনি মেজর ডালিমের সদম্ভ ঘোষণা। ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে। অসম্ভব! অবিশ্বাস্য! রুদ্ধশ্বাস মানুষ অপেক্ষা করেন, হয়তো এক্ষুনি শোনা যাবে সেই বজ্রকণ্ঠের অভয় বাণী। অথবা নতুন যুদ্ধ শুরু করার আহ্বান। না, তার বদলে এ কার কণ্ঠস্বর! বেদখল বাংলাদেশে স্বঘোষিত শিখণ্ডী ‘প্রেসিডেন্ট’ খন্দকার মোশতাকের বেতার ভাষণ। এও কি সম্ভব? অবিশ্বাস কাটে না মানুষের। বেলা বাড়ে। ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দ। জল্লাদের কালো উর্দিপরা বেঙ্গল ল্যান্সাররা সঙ্গিন উঁচিয়ে বসে আছে ট্যাংকের ওপর। বেতারে, মাইকে কারফিউয়ের ঘন ঘন ঘোষণা। সারাদেশে সামরিক আইন জারি।
অপরূপ সাজে সজ্জিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসবেন। রাত জেগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত জাতীয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। কিন্তু দিনের আলো না ফুটতেই এলো সেই দুঃসহ মর্মচেরা অশ্রুসিক্ত বার্তা। কলাভবনে অবস্থানকালেই সবাই জানতে পারেন, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। একটা অকথিত অসাড়, অবসন্নতা গ্রাস করে সমস্ত দেহমনকে। কিন্তু সে কেবল কয়েক পলকের জন্য। আকস্মিক বেদনার ঘোর কাটিয়ে উঠে প্রতিজ্ঞায় টানটান হয়ে ওঠে উপস্থিত কেউ কেউ : ‘আমাদের একটা কিছু করতে হবে।’ এই প্রবল তাড়না তাদের করে তোলে সবশ, সংক্ষুব্ধ। কিন্তু না, কেউ দায়িত্ব নিয়ে সাহস নিয়ে এগিয়ে এলো না। ভীত, সন্ত্রস্ত শেখ শহীদুল ইসলাম। জাতীয় ছাত্রলীগের সদ্য-বিবাহিত নেতা। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে। অক্ষম আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিশাহারা। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অসহায়।
আমরা জাতীয় ছাত্রলীগের নেতারা, যে যেখানে ছিলাম, চেষ্টা করি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার। তাদের কেউ কেউ আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। তাৎক্ষণিক মোকাবিলার নির্দেশ দিতে, ভরসা দিতে, সাহস দিতে অক্ষম।
অথচ এই আমরাই ১৯৭১-এ কারও নির্দেশের অপেক্ষা করিনি। ১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা চলছিল। দুপুরে বেতারে ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করার ঘোষণা শুনে যে যে অবস্থায় ছিলাম, বেরিয়ে এসেছিলাম। সমুদ্র গর্জনের মতো আছড়ে পড়েছিল ছাত্র-সমাজ। লাখ লাখ মানুষ। কেউ শিখিয়ে দেয়নি সেøাগানের বাণী। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর’- লাখো কোটি মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। মনে পড়ে, ২৫ মার্চ আর্মির ক্র্যাক ডাউন হতে পারে এমন আশঙ্কা করে ঢাকা শহরের পাড়া-মহল্লায় আমরা ছড়িয়ে পড়েছিলাম। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক বা সামরিক যানবাহন যাতে শহরে ঢুকতে না পারে, তার জন্য ব্যারিকেড তৈরির কাজে পাড়ায় পাড়ায় সংগঠিত করেছি ছাত্র-যুবক ও সাধারণ মানুষকে। সদ্য-শেখা বোমা তৈরির বিদ্যা দিয়ে, পেট্রোল বোমা ও মলোটভ ককটেল তৈরি করেছি। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণেই তো বঙ্গবন্ধু বলে দিয়েছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।’ এরপর আর তো নির্দেশের প্রয়োজন ছিল না। এ-কথা সত্য, আমরা জনতাম না ২৫ মার্চই যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। সেদিনও মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। কিন্তু থমকে যায়নি। আমরাও না। বুকের ভেতর সে কী উত্তেজনা! কী দুর্মর সাহস। ভয় কি মরণে? সেই আমরা ১৫ আগস্টে হিমশীতল। নির্দেশের অপেক্ষায় থাকি। বুকের ভেতর অচিন পাখি ছটফট করে। আমাদের একজন ‘জোয়ান অব আর্ক’-এর দরকার। আমরা হতে পারি না! আলাদা করে কেউ একজন নই, সবাই মিলেও নই। এ-এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি।
সত্য বটে, সকাল ৬টার বেতার ঘোষণা শুনেও সাহস হারাইনি। আমরা ছোটাছুটি করেছি। একটা কিছু করার তাড়না অনুভব করেছি। চেয়েছি, কেউ আমাদের বলে দিক- এ তো আর একাত্তর নয়। তবুও ভড়কে যাইনি। মনে মনে তখনও আশা ছিল, হয়তো সব সত্য নয়। হয়তো এখনই রক্ষীবাহিনী বেরিয়ে পড়বে। তোফায়েল ভাই তো আছেন। হয়তো জেনারেল সফিউল্লাহ কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্রোহ দমনের ঘোষণা দেবেন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। এমন কী এমনটাও কেউ কেউ ভেবেছেন, হয়তো এখনই ভারতীয় বিমান বাহিনী ক্যান্টনমেন্টে বোমাবর্ষণ করবে। মৈত্রী চুক্তি রয়েছে না!
কিন্তু না। এসবের কিছু হয়নি সেদিন। বেলা ১টা বাজতেই শুরু হয় নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের। ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা। কিছুক্ষণ পর নেপথ্য থেকে সরাসরি বাস্তব দৃশ্যপটে আবির্ভূত স্বয়ং মোশতাক। জাতির উদ্দেশ্যে নতুন রাষ্ট্রপতির বেতার ভাষণ। কী ছিল সেই ভাষণে?
 
প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা,
এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সত্যিকার ও সঠিক আকাক্সক্ষাকে বাস্তব রূপদানের পূত দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ্তায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের পথ সুগম করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীরের মতো অকুতোভয় চিত্তে এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেছেন।
 
অতঃপর চমক। একের পর এক। সত্যি সত্যিই বেতারে নতুন ‘প্রেসিডেন্টের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা। সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীরউত্তম, বিমান বাহিনী প্রধান এ কে খোন্দকার বীরউত্তম, নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খান, বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, পুলিশের আইজি নুরুল ইসলাম এবং রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান লে. কর্নেল আবুল হাসান।
একের পর এক দৃশ্য। নিখুঁত পরিকল্পনা। মঞ্চজুড়ে কুশীলবদের পদপাতে ক্ষত-বিক্ষত স্বদেশের মানচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ফুস মন্তরে মন্ত্রী হলো রাজা। পারিষদরা রইল ঠিক। বদলে গেল বাংলাদেশের বেতার, হলো ‘রেডিও বাংলাদেশ’। বুকজুড়ে আমাদের সংক্রমিত হলো হিমশীতল ভয়Ñ এই না দেশটা পাকিস্তান হয়ে যায়।
নিরুদ্ধ বাংলাদেশ। নিস্তব্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বত্র শঙ্কা ও ঘোর অনিশ্চয়তার ছায়া। ট্যাংক এলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। হলের সামনে ট্যাঙ্কের ওপর দাঁড়িয়ে, কোথাওবা হলগেটে খুনি মেজরদের বক্তৃতা। ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি : সাবধান, মার্শাল ল’ ভাঙার চেষ্টা করলেই গুলি! কেউ ঘর থেকে বেরুবে না।
সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা চুপচাপ! অবরুদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়েছে অনেকেই। পাশাপাশি সর্বত্র চাপা আতঙ্ক। ভয়ের ইন্দ্রজাল। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছাত্রনেতা ও কর্মীরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। যে যার মতো করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। সাহসে বুক বেঁধে হলে থাকতে বাধ্য হয়েছে অনেকেই।
বেতার থেকে সামরিক আইনের ফরমান এবং বাহিনী প্রধানদের আনুগত্যের রেকর্ড-করা ঘোষণা প্রচারিত হচ্ছে। সামরিক যন্ত্রসংগীত ও পাকিস্তানি ধাঁচের দেশাত্মবোধক গানের ফাঁকে ফাঁকে ‘প্রেসিডেন্ট মোশতাকের’ বেতার ভাষণও পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে।
আগেই বলেছি, ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন ও বিশেষ সমাবর্তনে ভাষণ দেওয়ার কথা। এ উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বিশাল প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হয়েছে। আমরা নবগঠিত বাকশালের অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যবর্গ প্রস্তুতি কমিটির সদস্য। বস্তুত, রাষ্ট্রপতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্বর্ধনা জানানোর লক্ষ্যে বেশ ক’দিন আগে থেকেই আমরা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলাম। ১৪ আগস্ট রাতেও ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব জামান, জাতীয় ছাত্রলীগের নেতা ইসমাত কাদির গামা, ওবায়দুল কাদের, রবিউল মুকতাদির চৌধুরী, কাজী আকরাম হোসেন, অজয় দাশগুপ্ত ও আমিসহ ৫০-৬০ জন কর্মী কলাভবনের ডিন অফিস ও ডাকসু অফিসে সারারাত অবস্থান করি এবং প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন করি। রাত ১১টা পর্যন্ত সদ্য-বিবাহিত শেখ কামালও আমাদের সাথে ছিলেন। তাকে আমরা একরকম জোর করেই ধানমন্ডির বাসভবনে পাঠিয়ে দেই।
রাত চার-সাড়ে ৪টার দিকে আমি প্রাতঃকৃত্য ও গোসল সেরে আসার জন্য জহুরুল হক হলে আসি। অতি প্রত্যুষে, মিহি অন্ধকার থাকতে থাকতেই খুনি বাহিনী ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে ৩২ নম্বরের ভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন কৃষক নেতা ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীসহ এই দুই পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য। আমি গোসল করতে করতে উত্তর দিক থেকে প্রচ- গুলির শব্দ শুনেছি। কিন্তু অনুমানও করতে পারিনি কী নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। রেডিও থেকে অভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর আমাকে হলের ওয়েস্ট হাউস থেকে দৌড়ে এসে জানায় ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী মান্নান খান। আমিও দৌড়ে সম্ভবত ১৩৭নং কক্ষে ওদের রেডিও শুনতে গেলাম। শুনলাম হিমশীতল করা সেই খবর ও মেজর ডালিমের ঘোষণা।
মুহূর্তেই আমি স্থির করলাম কলাভবনে আমাদের সহকর্মীদের কাছে যাব। কলাভবনে এসে দেখি ছাত্রনেতারা কেউ নেই। পেলাম জাতীয় ছাত্রলীগের সদস্য চন্দন চৌধুরীকে। ওদের কাউলে না পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। পরে শুনেছি সেলিমসহ জাতীয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শোনার পর সেন্ট্রাল রোডে (ল্যাবএইডের কাছে) জাতীয় ছাত্রলীগের প্রধান নেতা (সাধারণ সম্পাদক) বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ শহীদের বাসায় যান ইতিকর্তব্য ঠিক করতে। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা ও ভয়াবহতায় ভীতসন্ত্রস্ত শেখ শহীদ ছাত্র নেতৃবৃন্দকে কোনো নির্দেশ বা পরামর্শ দিতে অপারগতা জানান। ওরা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ ও অন্যান্যের সাথে কথা বলে আপাতত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।
এদিকে আমি চন্দন চৌধুরীকে নিয়ে পুরনো ঢাকার কেবি রুদ্র রোডে জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা মোস্তফা জালাল মহীউদ্দিনের বাসায় যাই। জালাল তখন বাসা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে আমাকে পার্টি হাই কমান্ডোর কোনো খবর জানাতে পারল না। আমি প্রথমে বাকশাল নেতা আবদুর রাজ্জাকের বাসায় ও পরে তোফায়েল আহমেদের বাসায় ফোন করি। কিন্তু ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ ফরহাদকে ফোন করি। সৌভাগ্যক্রমে ফরহাদ ভাইকে পেয়ে যাই। করণীয় জিজ্ঞেস করতে তিনি আপাতত নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিলেন। আমরা তিনজন, অর্থাৎ জালাল, চন্দন ও আমি ঠিক করলাম হলে বা নিজের বাসায় না থেকে অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেওয়া। চন্দন চৌধুরীর ধারে-কাছে কোনো পরিচিতজনের বাসা ছিল না। ওর অসহায়ত্ত দেখে আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে বকশিবাজারে ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী নাজমুন আপাদের বাড়ির ভাড়াটে কমিউনিস্ট কর্মী মোস্তাহিদ ভাইয়ের বাসায় উঠি। ওই বাসায় গিয়ে দেখি আমাদের আগেই ন্যাপ নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও তার স্ত্রী শামসুন্নাহার হল ছাত্রী সংসদের ভিপি রাখী দাস পুরকায়স্থ উপস্থিত। আমি বিব্রতবোধ করায় মোস্তাহিদ ভাই আশ্বস্ত করে বললেন, বাইরে কারফিউ দিয়েছে। এখন বাইরে গিয়ে কাজ নেই। পরে সুযোগ বুঝে যেও। আমরা ওই বাসায় থেকেই টেলিভিশনের পর্দায় নাটকের অন্যান্য দৃশ্য দেখলাম।
 
১৫ আগস্টের দিনের আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আশা-ভরসা-বিশ্বাস, স্বপ্ন-কল্পনা এবং তারুণ্যের শক্তি ও সাহস কোথায় মিলিয়ে যায়, জানি না। আমাদের সেদিনকার কাপুরুষতা আজও আমাদের ধিক্কার দেয়। হঠাৎ এক ভূমিকম্প আমাদের অস্তিত্বের শেকড় সুদ্ধ উপড়ে ফেলে।
এদিকে জনশূন্য রাজপথে কেবল ট্যাংকের ঘর্ঘর ধ্বনি। সামরিক যানবাহনের দ্রুত আনাগোনা। সূর্য নেমে আসে পশ্চিম আকাশে। সন্ধ্যার আবছায়া নামার আগেই বঙ্গভবনে উন্মোচিত ১৫ আগস্ট প্রহসনের শেষ দৃশ্য। খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ। পরিচিত সব মুখ। পরিচিত দৃশ্য। এমন কী সেই পরিচিত পোশাক। মুজিব কোট। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সকল সদস্য- আবদুল মান্নান, আবদুল মোমেন, আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আসাদুজ্জামান খান, ড. এ আর মল্লিক, ড. মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, ফণীভূষণ মজুমদার, মনোরঞ্জন ধর ও সোহরাব হোসেন পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে আনুগত্যের শপথ নিলেন।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং কেএম ওবায়দুর রহমান।
আর উপ-রাষ্ট্রপতি হলেন বাকশাল-পূর্ব রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ। ছায়াচ্ছন্ন সন্ধ্যায় টেলিভিশনের পর্দায় দেশবাসী দেখতে পেল ঝাড়বাতি শোভিত বঙ্গভবনের দরবার হলে নতুন রাষ্ট্রপতি ও তার মন্ত্রিসভার অভিষেক ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দৃশ্য। ৩২ নম্বরের বাড়িতে তখনও বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে পড়ে আছে।
এসব দেখে-শুনে আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের সকল আশা ভেঙে পড়ে। ১৫ আগস্টের দিনের আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আশা-ভরসা-বিশ্বাস, স্বপ্ন-কল্পনা এবং তারুণ্যের শক্তি ও সাহস কোথায় মিলিয়ে যায়, জানি না। আমাদের সেদিনকার কাপুরুষতা আজও আমাদের ধিক্কার দেয়। হঠাৎ এক ভূমিকম্প আমাদের অস্তিত্বের শেকড় সুদ্ধ উপড়ে ফেলে। এক দিকচিহ্নহীন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ উত্তাল সাগরে পড়ে আমরা হাবুডুবু খেতে থাকি। চারদিক ব্যাপ্ত করে নেমে আসে নিঃসীম অন্ধকার। বাঙালি জাতি আবার অস্তিত্বের সংকটের অতল সাগরে নিমজ্জিত হয়। বাতাসে মর্মরিত হয় স্বদেশাত্মার হাহাকার।
এর মধ্যেই ২০ আগস্ট খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আরও পাঁচজন। তারা হলেনÑ মোসলেম উদ্দিন খান, ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন এবং মোমিন উদ্দিন আহমদ। সময় পেয়েও এই কাপুরুষরা এমন কী পালানোরও চেষ্টা করেননি।
আমরা ছাত্র-সমাজও কিছু করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এটি ছিল আমাদের সম্মিলিত পাপ। তবে প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে দ্রুতই আমরা জাতীয় ছাত্রলীগের মূল নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা ও কর্তব্য নির্ধারণ করতে সক্ষম হই। ১৫ আগস্টেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেয় মোশতাক সরকার। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগেই ঢাকা মহানগরীর পাড়ায় পাড়ায় যোগাযোগ করি। টার্গেট বিশ্ববিদ্যালয় খুললেই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-আন্দোলন শুরু করব।
সে-কাজটি আমরা করেছি। ভীরুতা ও কাপুরুষতা ছুড়ে ফেলে আমরা আমাদের পাপ মোচনের জন্য নতুন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি। তবে আজ আর সেই কাহিনি নয়। অন্যদিন সে-কথা হবে।
 
লেখক : সম্পাদক, উত্তরণ

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK