শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৪:১৭

বেদনাবিধুর ১৫ আগস্ট

বেদনাবিধুর ১৫ আগস্ট

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়।
 
আনিস আহামেদ
শোকাবহ ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির শোকের দিন। ইতিহাসের কলঙ্কিত কালো দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সংঘটিত হয়েছিল এ কলঙ্কিত অধ্যায়। ৪৭ বছর আগে এ দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ক্ষমতালোভী নরপিশাচ কুচক্রী মহল। বাঙালির মুক্তির মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যখন ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা থেকে দেশটির পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তখনই ঘটানো হয় ইতিহাসের নির্মম এ ঘটনা।
সেদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। পৃথিবীর এ জঘন্যতম হত্যাকা- থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ ও মেয়ে বেবি, সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সংগ্রামী নেতা। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬-দফার প্রণেতা ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে এ দেশের গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ষাটের দশক থেকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র পাঠ করে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছিনিয়ে আনে দেশের স্বাধীনতা। জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হতে থাকে। তারা এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা পাঁয়তারা করে। শাসকদের রোষানলে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও যেন নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল মোশতাক সরকার। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ৩৫ বছরেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সেই কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তি ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর অনেক পরে খুনি ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদকে ২০২০-এ ফাঁসি দেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন দেশে পলাতক থাকায় আরও কয়েকজন খুনির সাজা এখনও কার্যকর করা যায়নি। প্রতিবছর দিনটি আসে বাঙালির হৃদয়ে শোক আর কষ্টের দীর্ঘশ্বাস হয়ে। পুরো জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করে। এ বছর জাতীয় শোক দিবসকে সামনে রেখে আগস্টের প্রথম দিন থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
 
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি
গত ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের যৌথসভায় জাতীয় শোকের মাস আগস্টের কর্মসূচি ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শোকের মাসের প্রথম প্রহরে ১২টা এক মিনিটে স্বেচ্ছাসেবক লীগ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর অভিমুখে আলোর মিছিল। ১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে রক্তদান ও প্লাজমা সংগ্রহ কর্মসূচি পালন করবে বাংলাদেশ কৃষক লীগ।
৫ আগস্ট শহিদ শেখ কামালের জন্মদিন। এদিন আওয়ামী লীগ, মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলো শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করবে। প্রথমে সকাল সাড়ে ৮টায় ধানমন্ডি আবাহনী ক্লাব এবং সোয়া ৯টায় বনানী কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আলোচনা সভার আয়োজন করবে। ঢাকা মহানগর উত্তর এতিম ও দুস্থদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করবে। ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করবে বন ও পরিবেশবিষয়ক উপ-কমিটি।
৮ আগস্ট বঙ্গমাতা শহিদ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। এদিন শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, মিলাদ, দোয়া, কোরআন খতম ও আলোচনা কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ, মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলো। বাদ জোহর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ এতিমদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করবে। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ৭টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। তবে, এটা মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করে করা হবে। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। সকাল সাড়ে ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। এই কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের একটা কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল এবং গোপালগঞ্জ ও টুঙ্গিপাড়া আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
১৫ আগস্ট কেন্দ্রীয়ভাবে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচির আয়োজন করা হবে। এদিন সারাদেশে অসচ্ছল ও দুস্থদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করা হবে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ যেন চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সে নির্দেশনা দেওয়া হবে। এছাড়া আওয়ামী লীগের উপ-কমিটি ও সহযোগী সংগঠনগুলো তাদের নিজেদের মতো করে কর্মসূচি পালন করবে।
এছাড়া ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা দিবস, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবসেও বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। ২৪ আগস্ট আইভি রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচি পালন করা হবে। ২৭ আগস্ট জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাবে আওয়ামী লীগ।
 
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK