শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
ঢাকা সময়: ২০:০১

জেনে নিন গাজরের অসংখ্য না জানা গুণাবলী

জেনে নিন গাজরের অসংখ্য না জানা গুণাবলী

সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ
 
আমরা সবাই জানি গাজর খাওয়া চোখের জন্য ভাল। কিন্তু গাজরের অসংখ্য অন্যান্য গুণাবলী সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই ভাল ধারনা নেই। তাহলে, আসুন জেনে নিই গাজরের গুণাগুণ।
 
সংক্ষেপে গাজরের কিছু স্বাস্থ্যকর গুণাবলী
শুধুমাত্র ৮ আউন্স গাজরের জুসে আছে একজন মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজনের ৮০০% ভাইটামিন এ
 
গাজরে আছে প্রচুর পরিমাণে বেটা ক্যারোটিন যা একটি শক্তিশালী এন্টি অক্সিডেন্ট (antioxidant) এবং একটি প্রাকৃতিক পিগমেন্ট যেটা চক্ষু-স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
 
গাজর ভাইটামিন এ-এর একটি ভাল সূত্র। এতে আছে একজন মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজনের ২১০% ভাইটামিন এ। গাজর আরো দেয় ৬% ভাইটামিন সি, ২% ক্যালসিয়াম এবং ২% আয়রন। 
গাজর মুখের ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংস করে এবং দাঁতকে রক্ষা করে বিভিন্ন দন্ত রোগ থেকে।
প্রতিদিন গাজর খেলে গ্যাস্ট্রিক আলসার হওয়ার সম্ভাবনা এবং হজমের সমস্যা দূর হয়।
 
গাজরের ক্যারটিনয়েড (Carotenoid) উপাদান রক্তের সুগার blood sugar নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। 
প্রতিনিয়ত গাজর খেলে চামড়া, নখ এবং চুল সুন্দর থাকে। গাজরের এন্টিসেপ্টিক গুণাবলী লিভারের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। গাজর বয়োঃবৃদ্ধি রোধে এবং ইমিউন সিস্টেম সুরক্ষায় সাহায্য করে।
 
ইতিহাস 
ইতিহাসবিদদের মতে হাজার হাজার বছর আগে ইরান এবং আফগানিস্তানে প্রথম গাজরের চাষ শুরু হয়। ঐ সময়ের গাজরগুলিতে এক রকম তেতো স্বাদ এবং মাটির গন্ধ থাকত। পঞ্চ শতাব্দীর আগে গাজরের রঙ ছিল কালো, বেগুনী, লাল, হলুদ এবং সাদা। আজকের দিনে যে কমলা রঙের গাজর আমরা দেখি সেটা প্রথম চাষ শুরু করে ডাচ কৃষিবিদরা এবং তারাই এটাকে মিষ্টি, সুগন্ধময় এবং মচমচে ভাব দেন। 
 
গাজরের জুস 
জুসের জগতে গাজর একটি জনপ্রিয় সবজি। গাজরের ফ্লেভার যে কোন ফল বা সব্জির সাথে খুব সুন্দরভাবে মিশে যেতে পারে।  চমৎকার স্বাদ ছাড়াও গাজরের রয়েছে অসংখ্য স্বাস্থ্যকর গুণাবলী।   

গাজরের জুসের পুষ্টিগুণ

১ কাপ গাজরের জুসে (ক্যানের জুস) আছেঃ
  • ৯৪ কিলোক্যালরি 
  • ২.২৪ গ্রাম প্রোটিন 
  • ০.৩৫ গ্রাম ফ্যাট
  • ২১.৯০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট
  • ১.৯০ গ্রাম ফাইবার
  • ৬৮৯ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম
  • ২০.১ মিলিগ্রাম ভাইটামিন সি
  • ০.২১৭ মিলিগ্রাম থায়ামিন
  • ০.৫১২ মিলিগ্রাম ভাইটামিন বি-৬
  • ২.২৫৬ মাইক্রোগ্রাম ভাইটামিন এ
  • ৩৬.৬ মাইক্রোগ্রাম ভাইটামিন কে

গাজরের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা

প্রস্টেট ক্যান্সার 
ইউরোপিয়ান জার্নাল নিউট্রিশন এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব পুরুষ সপ্তাহে অন্ততঃ তিন দিন গাজর খান তাদের প্রস্টেট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ১৮% কম থাকে। হারভার্ড স্কুল অফ পাবলিক হেলথ- এর মতে প্রতিনিয়ত বেটা ক্যারটিন যুক্ত খাবার খেলে তা পুরুষদের প্রস্টেট ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে। 
 
ডায়াবেটিস
গাজরের ক্যারটিনয়েড উপাদান রক্তের সুগার blood sugar নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। একজন ডায়াবেটিস রোগীর ইন্সুলিন রেসিস্টেন্স এর উপর গাজর প্রভাব ফেলে এবং রক্তের সুগার  কমিয়ে আনতে সহায়তা করে। আমাদের শরীর যে পরিমাণ ইন্সুলিন এবং গ্লুকোজ ব্যবহার এবং মেটাবলাইজ করে, ক্যারটিনয়েড সেটাও নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে।
 
ব্লাড প্রেসার  
গাজরে আছে প্রচুর পরিমাণে পাটাশিয়াম, যা ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। গাজরের কুমারিন উপাদান উচ্চ রক্ত চাপ কমাতে এবং হার্ট কে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
 
স্ট্রোক
গবেষণায় দেখা গেছে যারা প্রতিদিন গাজর খান তাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা ৬৮% কম। গবেষণায় দেখা যায়, যে সব স্ট্রোক রোগীর শরীরে সবচেয়ে বেশী পরিমাণে বেটা ক্যারটিন (beta-carotene) রয়েছে, তাদের বাঁচার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। অসংখ্য গবেষণা এই ক্যারট এফেক্ট ‘carrot effect’ কে সমর্থন করে।
 
কোলন ক্যান্সার 
একটি জাপানিজ গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন খাবারের সাথে গাজর খেলে পায়ু ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
 
পাকস্থলীর ক্যান্সার
গাজরে আছে এন্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সার রোধে সাহায্য করতে পারে। একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা গাজর খাওয়া এবং পাকেস্থলী ক্যান্সারের ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ করেন। 
 
তাঁরা দেখতে পান যে নিয়মিত গাজর খেলে পাকস্থলী ক্যান্সারের ঝুঁকি শতকরা ২৬ ভাগ কমতে পারে। ঠিক কি পরিমাণ গাজর খেলে পাকস্থলী ক্যান্সারের ঝুঁকি কমতে পারে তা তারা বলেননি, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এ ব্যাপারে সঠিক তথ্যের জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে।  
 
লিউকিমিয়া
যদিও আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে ভবিষ্যতে লিউকিমিয়া চিকিতসায় গাজর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকে রাখতে পারে। 
 
একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা লিউকিমিয়া সেলে গাজর জুসের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁরা দেখতে পান যে গাজর জুসের উপাদানের সংস্পর্শে এলে লিউকিমিয়া সেলগুলি আত্মহনন করে এবং সেলের জীবনচক্র বন্ধ হয়ে যায়।
 
স্তন ক্যান্সার
স্তন ক্যান্সার উত্তরজীবীদের একটি সমিক্ষায় বিশ্লষেকরা ক্যারটিনয়েড লেভেল, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস নির্দেশক এবং প্রদাহ নির্দেশকের উপর গাজর জুসের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেন। গবেষকরা তাদের প্রতিবেদনে বলেন যে, রক্তে উচ্চ মাত্রার ক্যারটিনয়েড থাকলে স্তন ক্যান্সার প্রত্যাবর্তনের ঝুঁকি কম থাকতে পারে। গবেষণায় অংশগ্রহনকারীদের ৩ সপ্তাহের জন্য প্রতিদিন ৮ আউন্স করে গাজর জুস পান করতে দেয়া হয়। গবেষণা শেষে দেখা যায় যে, মহিলাদের রক্তে রয়েছে উচ্চ মাত্রার ক্যারটিনয়েড এবং নিম্ন মাত্রার অক্সিডেটিভ স্ট্রেস নির্দেশক Markers of Oxidative stress।
 
ফুসফুস রোগ 
গাজরের জুসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভাইটিমিন সি। বিশ্লেষকরা ভাইটামিন সি-যুক্ত খাদ্যগ্রহণ এবং ফুসফুসের রোগ (সিওপিডি) এর মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করেন। গবেষণায় অংশগ্রহনকারীরা সবাই ছিলেন কোরিয়ার নাগরিক, যাদের বয়স ছিল ৪০ বছর বা তার বেশী।
 
গবেষকরা দেখতে পান যে, সুস্থ্য মানুষের তুলনায় সিওপিডি এর রোগীদের শরীরে রয়েছে খুব কম পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান, যেগুলো গাজর জুসে পাওয়া যায়, যেমন, ক্যারটিন, পটাশিয়াম, ভাইটামিন এ এবং ভাইটামিন সি। 
 
যারা খুব বেশী পরিমাণে ধুমপান করেন তাদের মধ্যে যারা প্রচুর পরিমাণে ভাইটামিন সি গ্রহন করেন তাদের সিওপিডি হওয়ার ঝুঁকি কম ভাইটামিন সি গ্রহনকারীদের তুলনায় অনেক কম।
 
বেশী গাজর খেলে কি ক্ষতি হতে পারে?
এক কাপ গাজরে আছে ৯ গ্র্যামের বেশী চিনি। আমরা জানি বেশী চিনি খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার এবং ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ে। তাই হারভার্ড স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এর মতে প্রতিদিন এক গ্লাসের বেশী গাজর রস পান করা উচিত নয়। 
 
গর্ভবতী মহিলা, বয়স্ক মানুষ যাদের বিশেষ ধরনের অসুখ আছে এবং ছোটদের জন্য গাজর জুস পান করাটা ঠিক নাও হতে পারে।
 
গাজর জুসের ঝুঁকি ও কিছু বিবেচনা
যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল, যেমন ক্যান্সার চিকিতসা গ্রহনেকারী, গর্ভবতী মহিলা, ছোট বাচ্চারা, এবং বয়স্ক মানুষ, তারা কিছু কিছু খাদ্য গ্রহন থেকে বিরত থাকতে পারেন যেসব খাদ্য গ্রহনে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
 
ফল এবং সব্জির জুস, যেগুলো ফ্রেশ বানানো হয়, সেগুলোতে জার্ম থাকার ঝুঁকি বেশী থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের The Memorial Sloan Kettering Cancer Center এর মতে কিছু কিছু রোগীদের উচিত পাস্তুরাইজ ছাড়া ফল বা সবজি জুস খাওয়া থেকে বিরত থাকা। যদি সেটা বাসায় বানানো জুস হয় তাহলে সেটা ঠিক আছে। এর মতে গর্ভবতী মহিলাদের উচিত সেইসব জুস পান করা যেগুলো পাস্তুরাইজ করা হয়েছে বেশীদিন ভাল থাকার জন্য। গর্ভবতী মহিলাদের উচিত জুস বারে বানানো ফ্রেশ জুস পরিহার করা।
 
গাজরে আছে বেটা ক্যারটিন নামে এক ধরনের ক্যারটিনয়েড, যা আমাদের শরীর ভাইটামিন এ তে রূপান্তরিত করে।
 
খাদ্য থেকে প্রচুর পরিমাণে ক্যারটিনয়েড খেলে তা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু, প্রচুর পরিমাণে বেটা-কেরোটিন খেলে স্কিন কমলা-হলুদ রঙ ধারণ করতে পারে। এটাকে বলে হয় ক্যারটিনোডার্মা (carotenoderma)।
 
আরও কিছু তথ্য এবং রেসিপি
১ কাপ গাজর জুসের ভাইটামিন ও মিনারেল ৫ কাপ ক্যারট কুচির সমান।
 
যদিও ফ্রেশ ফল এবং সবজি জুসে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিকর পদার্থ থাকে, তাদের মধ্যে ফ্রেশ ফল ও সব্জির সমপরিমাণ ফাইবার থাকে না। এবং ফ্রেশ ফল ও সবজি জুসে ফ্রেশ ফল ও সব্জির চেয়ে বেশী মাত্রায় চিনি থাকে।
 
উদাহরণস্বরূপ, ১ কাপ গাজর জুসে ২ গ্র্যাম ফাইবার এবং ৯ গ্র্যাম চিনি আছে, কিন্তু ১ কাপ কুচি করে কাটা গাজরে ৩.৫ গ্র্যাম ফাইবার এবং ৬ গ্র্যাম চিনি আছে।
 
বাসায় গাজর জুস বানানোর জন্য প্রয়োজন জুস এক্সট্রাক্টর (juice extractor)। জুস এক্সট্রাক্টর যে কোন সুপার শপ বা অনলাইন শপে পাওয়া যেতে পারে। 
 
গাজরের জুস অন্য কোন ফল বা সবজির জুসের সাথে মিশিয়ে পান করা যেতে পারে, যেমন – গাজর ও আপেল জুস, গাজর ও কমলা জুস, গাজর জুস ও সামান্য পরিমাণে আদা ও দারুচিনি।
গাজর জুসে আছে অসংখ্য স্বাস্থ্যগত উপকারিতা, কারণ এতে আছে ঘণীভূত পুষ্টিকর পদার্থ।
 
কিন্তু, ফ্রেশ গাজরের তুলনায় গাজর জুসে আছে কম ফাইবার এবং বেশী চিনি। ওজন এবং কোলেস্টেরল লেভেল কমানোর জন্য ফাইবারের প্রয়োজনীয়তা আছে।
 
লেখক: খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক গবেষক

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK