মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৮:৫০
ব্রেকিং নিউজ

স্টপ জেনোসাইড মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল

স্টপ জেনোসাইড মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল

মাসুদ পথিক
 
বন্ধ কর গণহত্যা- ‘স্টপ জেনোসাইড’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারি। অভূতপূর্ব ওয়ার ভিজুয়াল, ডকুমেন্টেশন। জহির রায়হান। কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক। বরেণ্য এই চলচ্চিত্রকারের প্রথম তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। ২০ মিনিট ব্যাপ্তির এই ডকুমেন্টারি মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের গোপন দলিল। ১৯৭১ সালে ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে এই কিংবদন্তি নির্মাতার তথ্যচিত্র নির্মাণে অভিষেক ঘটে।
এই তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে পাকসেনাদের নির্মম অত্যাচার, নির্বিচারে গণহত্যা, নির্যাতন এবং ফলাফল হিসেবে পূর্ব বাংলার মানুষের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি।
জহির রায়হান ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসের দিকে এই ডকুমেন্টারির জন্য পূর্ব পরিকল্পনা শুরু করেন। এক মাসেরও কম সময়ে জুন মাসে তিনি এর কাজ সম্পন্ন করেন। ডকুমেন্টারির দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে ৩৫ মিমি ফিল্ম ক্যামেরায়। এটির নির্মাণশৈলীর সঙ্গে কিউবান চলচ্চিত্রকার সান্তিয়াগো আলভার্জের কাজের সঙ্গে অনেক মিল পাওয়া যায়। বলা যায়, জহির রায়হান তার এ ডকুমেন্টারি নির্মাণে আলভার্জকেই অনুসরণ করেছেন এক প্রকার।
টেকনিক্যালি আলোচনা করলে দেখা যায় ‘স্টপ জেনোসাইডে’ এক্স­­পোজিটোরি মোড, কিছুটা রিফ্লেক্সিভ মোডের সমন্বয় করা হয়েছে।
এই মোডের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘ভয়েস অব গড’-এর ব্যবহার। ‘ভয়েস অব গড’-এ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কী বলা হচ্ছে এবং বাচনভঙ্গি কেমন তা। স্টপ জেনোসাইডে যে ভয়েস ব্যবহার করা হয়েছে, তা এতটাই শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী যে তা দর্শকের কান দিয়ে গভীরে আঘাত করে; যা বাঙালির দুর্দশার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তীক্ষèভাবে আঘাত করে।
ডকুমেন্টারিতে মূলত দর্শকদের উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়েছে, কারণ এর উদ্দেশ্যই ছিল বিশ্বের মানুষকে যুদ্ধকালীন অবস্থার কথা জানানো।
মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, পাকিস্তানি সেনাদের নিরীহ বাঙালির ওপর নির্যাতন, পূর্ব পাকিস্তানের করুণ অবস্থা, এসব বিষয় সমগ্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘স্টপ জেনোসাইড’।
‘যারা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে আলাদা হওয়ার অধিকার দাবি করে, তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিযুক্ত করা, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারকে পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংসের নামান্তর বলে অভিযোগ করার মতোই নির্বুদ্ধিতা এবং অসততা।’ শুরুতেই আমরা ভøাদিমির ইলিচ লেনিনের বিখ্যাত এই উক্তি শুনতে পাই, এই প্রতিবাদী এবং একই সাথে মানুষের অধিকার বিষয়ক মর্মস্পর্শী ও যুক্তিসংগত উক্তি থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা সম্পূর্ণই জোরপূর্বক এবং কোনো যথাযথ যুক্তি ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে হামলা করেছিল। কারণ পূর্ব পাকিস্তানিরা তখন স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনই করে আসছিল। আর তাই তাদের ওপর বিনা নোটিসে এই অকথ্য অত্যাচার কেবলমাত্র নির্বুদ্ধিতা আর আস্থার পরিচয় ছিল। পরিচালক শুরুতেই এমন উক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দর্শকদের এই ডকুমেন্টারির বিষয়বস্তু কতটা গভীর আর মর্মস্পর্শী তার ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করেছেন।
শুরুর দিকে ক্রেডিট লাইনের মাঝামাঝি অংশে দেখানো হয় গ্রাম্য মহিলার ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার দৃশ্য। এর দ্বারা যুদ্ধের আগে বাংলার অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক অবস্থা আর সাধারণ মানুষের জীবনযাপনেরই ইঙ্গিত করা হয়েছে, আর এর পরই পর্দায় ক্রেডিট লাইন দেখার পেছনে আমরা শুনতে পাই অনেকগুলো বুটের শব্দ, এরপর বোমা এবং গুলির শব্দ সাথে কুকুরে আর্তচিৎকার। পরমুহূর্তেই আমরা বেশ কয়েকটি স্টিল পিকচার দেখতে পাই যেখানে ভাঙা ঘরবাড়ি, নানা বয়সের মানুষের সাথে পশুপাখির ছিন্নভিন্ন লাশ। ভিআই লেনিনের উক্তির পর এ-রকম বিধ্বস্ততার চিত্র বিশ্বের কাছে বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের অযৌক্তিক নির্যাতনের কথাই তুলে ধরে।
পরবর্তীতে আমরা একটি শরণার্থী সারি দেখতে পাই। ক্ষুধা, চিন্তাক্লিষ্টতা, জীবনের কঠোরতা, নিজের বাড়িঘর ছেড়ে অন্য এক দেশে যাওয়ার অনিশ্চয়তা, জীবন সংশয়ের ভীতি সবকিছু যাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এই জনগোষ্ঠীর জীবনের এক দুর্বিষহ অধ্যায় এখানে তুলে ধরেছেন পরিচালক। তাদের চরম কষ্টকে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে ভয়েস ওভারের মাধ্যমে, ‘দিনের পর দিন শরণার্থীর মিছিল এগিয়ে চলে। আহার নেই, ঘুম নেই, দুঃসহ ক্লান্তি; তবু থেমে বিশ্রাম নেবার উপায় নেই।’
দীর্ঘ লাইনের যাত্রায় একটা সময় দেখা যায় যে কাদার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষের পা ডুবে যাচ্ছে সে কাদা পানিতে আর আবার পা তুলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। যুদ্ধের ভয়াবহতায় জীবন চলার পথে মানুষ যেমন আটকে গেছে তেমনি কাদায় পা আটকে যাওয়া যেন সেই কঠিন বাস্তবতার দিকেই ইঙ্গিত দেয়। এমনটা বাংলাদেশের তৎকালীন মানুষের বাস্তব রূপ।
’৭১-পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে জহির রায়হান জানান, পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকাণ্ডের মধ্যে তিনি এটা দেখে সবচেয়ে অবাক হয়েছেন যে, তারা গণহত্যা, লুটপাট চালানোর পর সবকিছু ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে শুট করত। এবং পরবর্তীতে দৃশ্য সম্পাদনার কাজ করে বিশ্ববাসীর নিকট প্রচার করত যে বাঙালিরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের মাধ্যমে গণহত্যা চালাচ্ছে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। তখন জহির রায়হান বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের মানুষের আসল অবস্থা জানানোর উদ্দেশে ডকুমেন্টারিটি নির্মাণ করেন।
ডকুমেন্টারির সব ফুটেজই যুদ্ধের সময় সংগ্রহ করা। কোনো ধরনের স্টেজিং এখানে করা হয়নি। বস্তুত যুদ্ধকালীন ফুটেজগুলো এমনভাবে নেওয়া, যা সে-সময়কার পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম ছিল। এছাড়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। সেক্ষেত্রে রিস্টেজিং করার কোনো প্রয়োজন হয়নি সে-সময়। ‘স্টপ জেনোসাইড’-এ তৎকালীন বাংলার বাস্তব চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। শরণার্থী শিবির থেকে শুরু করে সমগ্র বাংলার তখনকার অবস্থা বাস্তবতা নিরিখে তুলে ধরা হয়েছে।
তবে একটি দৃশ্যে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত এক কিশোরীকে দেখানো হয়। যদিও বাস্তব অবস্থা বোঝানোর জন্য তাকে দেখানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নারীকে সবার সামনে এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
জহির রায়হান নিজেও পরবর্তীতে একজন শহিদ বুদ্ধিজীবী। তার বানানো ডকুমেন্টারিটি ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধের তথা বাংলাদেশের একটি অনন্য দলিল, যা নির্মাণ করা হয়েছে ইংরেজিতে। যাতে পৃথিবীর সব মানুষের কাছে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যায়। ডকুমেন্টারির ভাষান্তর করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির। তখন আলমগীর কবির জহির রায়হানের সহকারী ছিলেন।
 
লেখক : সহ-সম্পাদক, উত্তরণ

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK