মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ২১:২৫
বাংলা নববর্ষ বিশেষ প্রবন্ধ

লোকচিত্র: দেয়ালচিত্র

লোকচিত্র: দেয়ালচিত্র

আমিনুর রহমান সুলতান
 
ভৌগোলিক অবস্থান, লোকচিত্র ও শিল্পী
অতীতকাল থেকে বাংলাদেশে যে গ্রামনির্ভর সমাজ গড়ে উঠেছিল, তা লোকসংস্কৃতির গুরুত্ব বহন করে। আর এই লোকসংস্কৃতিতে লোকশিল্প বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে সম্ভাবনার পথকে সুগম করে। লোক-পরম্পরায় বিভিন্ন গোষ্ঠী বা বৃত্তির মানুষের এই লোকশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে কখনও তাদের জীবিকার জন্য আবার কখনও তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা কৃত্যাচারকে বজায় রাখার প্রয়োজনে। আর এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে শুরু করে বাঙালির যে নিজস্ব সংস্কৃতি তা নানাভাবে ফুটে উঠেছে লোকশিল্পে। লোকশিল্প হচ্ছে পরম্পরাগতভাবে সাধারণ মানুষের সৃষ্টি বস্তু, যা জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কিত ধর্মীয় বা কৃত্যাচার হয়েও নান্দনিকতার প্রকাশ। আর সেটা বস্তুর মধ্য দিয়েও হতে পারে। আবার গার্হস্থ্য জীবনের বাইরে ব্যবহারিক বস্তুর বাইরে অবস্তুর মধ্য দিয়েও প্রকাশিত হতে পারে। লোকশিল্পের মধ্যে পড়ে বয়নশিল্প, সূচিশিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতি এসবের পাশাপাশি লোকচিত্রও লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত। লোকচিত্র আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীতে নানাভাবে নান্দনিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। অবশ্য এছাড়াও যে আমাদের ধর্মচারে, কৃত্যাচারসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে লোকচিত্র বিশেষ ধারার ঐতিহ্য সৃষ্টি করে আজও তা অব্যাহত, সে বিবেচনাতেই লোকচিত্র নিয়ে মাঠ পর্যায়ের গবেষণার আলোকপাত।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে আমাদের গ্রাম-বাংলায় সমতল ও অসমতলে রয়েছে একাধিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ বাঙালি। যদিও রাজনৈতিক কারণে এই জাতি কখনও বিভ্রান্ত হয়ে ধর্মীয় উন্মাদনায় এবং বিরোধ বেধেছে, রক্তাক্ত হয়েছে বাংলাদেশের মাটি, তারপরও লোকসংস্কৃতির প্রশ্নে কখনও দ্বিধাবিভক্ত নয়। ঐতিহ্যকেই লালন করেছে। আর তা থেকে সৃষ্টি হয়েছে লোকচিত্র-শিল্পের। আঁকিয়ে ও গাইয়ে দু-ধরনের লোকশিল্পীর। আবার লোকাচারকে বা কৃত্যাচারকে কেন্দ্র করে যে লোকচিত্রের ব্যবহার তা থেকে পেশাগত শিল্পীর উদ্ভব না হলেও যুক্ত হয়েছে লোকশিল্পীর ধারায়। আলপনা বা লোকচিত্রের ধারাটির উৎস বলা যায় গুহাচিত্র এবং অন্যান্য সংকেতধর্মী চিত্রকলা। তবে কৃষির জীবনব্যবস্থা গড়ে ওঠার পর কৃষি জীবনের পরিম-লে তা ব্যপ্ত হয়।
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান নানা সময়ে পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীন। আবার ১৯৪৭ সালের আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত ছিল ব্রিটিশদের অধীন। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার আগে বাংলার সাথে যুক্ত হয়েছে উড়িষ্যা, বিহার প্রভৃতি রাজ্য। আর আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ তো বাংলা হিসেবেই পরিচিত ছিল। উড়িষ্যা, বিহার প্রভৃতি রাজ্য বাংলার সাথে যুক্ত হওয়ায় ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে পরিবর্তন আসার সাথে সাথে লোকসংস্কৃতির এবং লোকশিল্পের ধারায় লোকচিত্রে প্রভাব পড়েছে সে-সব দেশের চিত্রকলাও। যা একসময় লোকচিত্রকলার সাথে মিলে গিয়ে বাঙালির লোকসংস্কৃতির নিজস্ব বিষয় হয়ে ওঠে। এ-সম্পর্কে বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের মন্তব্য উল্লেখ করছি, “বাংলার লোকচিত্রের ঐতিহ্যে প্রভাব এসেছে বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতের অপরাপর দেশের সঙ্গে বাংলার রাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্ক এবং বাংলার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং লোক চলাচলের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। বাংলার লোকচিত্র দুই রীতির ফল : অজন্তা রীতি দাক্ষিণাত্য, গুজরাট ও উড়িষ্যা হয়ে বাংলাদেশকে স্পর্শ করেছে, তিব্বতী রীতি নেপাল, নালন্দা, উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে মিশে গেছে। অজন্তা রীতি দরবারী; তিব্বতী রীতি বনজ অথচ দুই রীতি পরম্পরের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে বাংলাদেশে। অজন্তার মতন চিত্ররীতি একজন শিল্পীর কাজ নয়, বহু শিল্পীর মিলিত কাজ; এসব শিল্পীরা এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। শেষ করার পর শিল্পীরা ফিরে গেছেন স্বস্থানে, অজন্তার অধিগত বিদ্যাকে স্থানীয় কাজে লাগিয়েছেন। এভাবে অজন্তা রীতি চতুর্দিকে ছড়িয়েছে। বাঘ, ইলোরা, তাঙ্গোর, তিরুপতি, আনেগুন্তির প্রাচীনচিত্রে অজন্তার প্রভাব সোচ্চার। ঢেউয়ের মতোন অজন্তার দরবারী রীতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে স্থানীয় রীতির মধ্যে মিশে গেছে। লোকজ ঐতিহ্যে এসে গেছে। তিরুপতি তিরুমাল মন্দিরের ছাদের চিত্র এবং বাংলার জড়ানো পটের মধ্যে স্পষ্ট। তার একটা কারণে দাক্ষিণাত্যের এবং পশ্চিম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগে ঐতিহাসিকভাবেই ঘনিষ্ঠ। আবার উড়িষ্যার সঙ্গে দক্ষিণাত্যের যোগাযোগ নিবিড়। উড়িষ্যা ছিল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। আর গুজরাটের সঙ্গে বিজয়নগরের ছিল বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ঐ সম্পর্কের পথ ধরে গুজরাট চিত্ররীতি বিজয়নগর সাম্রাজ্যে এসেছে এবং উড়িষ্যার পুথিচিত্র রীতি প্রভাবিত করেছে। ওইসব পুথিচিত্র তাল পাতায় আঁকা, নরুনের মতন কলম দিয়ে রচনা করা।
গুজরাটি চিত্ররীতির গুণ ক্যালিগ্রাফির, ঐ গুণ উড়িয়া চিত্ররীতিতে এসেছে, এভাবে চিত্রের মালমশলা এবং যন্ত্রপাতি চিত্ররীতিতে ঐক্য তৈরী করেছে। ষোড়শ শতকে উড়িষ্যা বাংলার অন্তর্গত হয়। ষোড়শ শতক উড়িয়া চিত্ররীতিতে এক বিভাজনকারী সীমারেখা দাক্ষিণাত্যের সঙ্গে সম্পর্ক ও প্রভাবের অবনতি ঘটে ঐ শতক থেকে এবং বাংলার সঙ্গে সম্পর্ক ও প্রভাব বেড়ে ওঠে ঔ শতক থেকে।”
 
ঘরের দেয়ালচিত্র
নব্যপ্রস্তর যুগে দ্রব্যের ওপর লাল রঙের ফুল, লতাপাতার মোটিভের নকশা এঁকে সৌন্দর্য সৃষ্টি করা হতো। আর এ নান্দনিক কাজটি করত কৃষি কাজের সাথে যুক্ত গ্রাম্য সাধারণ মানুষ। মৃৎপাত্রের বাঁকা গায়ে জ্যামিতিক ও ফুল-লতাপাতার মূল ছন্দকে কেন্দ্র করে নকশা আঁকার কথাই মানুষের মনে সহজে আসে। নব্য প্রস্তর যুগের শিল্পধারার বিশেষভাবে ব্যবহারিক। প্রাত্যহিক ব্যবহার্য দ্রব্যে সৌন্দর্য আরোপের প্রত্যক্ষ কথা। যদিও ধর্মীয় ধারণা শিল্পকলার পেছনে কাজ করেছে নানাভাবে। লোকশিল্পের ক্ষেত্রেও এ-কথাগুলো বিশেষভাবে খাটে।
সামান্য শিল্প উপকরণ নিয়ে লোকশিল্পের কারবার। কয়েকটি সাধারণ রং, কতগুলো মূল আকৃতি ও ছন্দকে কেন্দ্র করে চলে প্রধানত এই শিল্প-প্রয়াস। যেসব জিনিস এসব শিল্পবস্তু নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হয়, তাও খুব সাধারণ, সহজেই পাওয়া যায়। সব দেশে লোকশিল্প সাধারণ সহজলভ্য জিনিসকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে।
তবে এ-কথা স্বীকার করতেই হবে যে, সহজলভ্য উপাদানে সৌন্দর্য বর্ধনকারী দ্রব্যগুলো অবশ্যই ব্যবহারিক ছিল। আর লোকচিত্রগুলো সৌন্দর্যময় করে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রকৃতিরই দেখা এবং প্রকৃতি থেকে কল্পনায় উঠিয়ে আনা নানা মোটিভে নানা রং ব্যবহার করেছে। আর সেই ধারাও পরম্পরা এখনও চলে আসছে। রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেখানে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হতো নিজেদের বানানো, সেখানে কেমিক্যাল রংও ব্যবহার হচ্ছে।
বস্তুর ওপর সৌন্দর্য আরোপ করার জন্য গ্রাম্য সাধারণ মানুষ শিল্পী মনের পরিচয় দিয়ে যে লোকচিত্রের ধারাকে ধরে রেখেছেন তারই আরেক পর্যায় বাড়ির মাটির ঘরের দেয়ালকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলার জন্য দেয়ালচিত্রের সূচনা করেছিলেন লোকশিল্পীরা। আর এই কাজের ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন গ্রাম্য বধূরা। দেয়ালে চিত্র আঁকা বা আলপনা আঁকার মধ্য দিয়ে দেয়াল যে সৌন্দর্যময় করে তোলা যায় এই ধারণার উদ্ভব দেয়াল লেপা থেকেও ঘটতে পারে। আমি তরুণ চিত্রশিল্পী দেওয়ান মিজানের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি জানান, দেয়াল লেপার ব্যাপারে দেখবেন কোনো কোনো দেয়াল লেপার সময় হাতে যে ন্যাকড়া বা তেনা বা পাটের তৈরি চটর পরিত্যক্ত চটে পানিতে গোলা এঁটেল মাটিতে ভিজিয়ে নিয়ে লেপামোছা করেন সেখানে কয়েক ধরনের রেখার ছাপ পাওয়া যাবে। এক. মনে করুন গৃহিণীর হাতে যথেষ্ট সময় আছে, বাড়ির কাজকর্ম শেষ করে ঘরের দেয়ালটি লেপতে বসলেন। তখন আয়েশি ভাব আসবে। দেয়ালে লেপার ছাপটি পড়বে হালকা আর এক্ষেত্রে এক ধরনের সৌন্দর্য ফুটে উঠবে। দুই. ধরুন আরেকটি দেয়ালে লেপার কাজে ব্যস্ত একজন নারী। তিনি জানেন, লেপার কাজ সেরেই তার স্বামীর খাবার দিতে হবে। স্বামী জমিতে চাষাবাদ বা কাজ শেষে বাড়ি ফিরেই তার গিন্নিকে ডাকছেন। তখন অর্ধেক দেয়াল লেপার বাকি আছে। তখন লেপার কাজে নারীটি আরও দ্রুত হাত চালাবেন। দ্রুত হাত চালানোর ফলে লেপার মধ্য দিয়ে যে আলপনার রেখা তা খুব ঘন হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে আরেক ধরনের সৌন্দর্য ফুটে উঠবে।
যা বলছিলাম, ঘরের দেয়াল লেপার পর্যায় এখনও আছে। আর এই ধারা মুসলিম পরিবারগুলোতে অব্যাহত আছে। হিন্দু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঘরবাড়িতে লেপার পাশাপাশি দেয়ালচিত্রের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। তবে দেয়ালচিত্র বা দেয়ালে আলপনা আঁকার ঐহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল ব্রত পার্বণ বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে। বর্তমানে মাঙ্গলিক অনুষঙ্গ ছাড়াও সুন্দরের বহিঃপ্রকাশ, অর্থাৎ নান্দনিক ভাবনার প্রকাশ থেকেও দেয়ালচিত্র করা হচ্ছে আলপনার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যেসব অঞ্চল রয়েছে সেসব অঞ্চলে মাটির দেয়ালগুলোতে মাঙ্গলিক উপকরণ ছাড়াও সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য প্রকৃতির নানা উপকরণ ও দৃশ্য শোভা পায়। তবে ব্যতিক্রম চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের টিকইল গ্রাম।
 
দেয়ালচিত্রের বাড়ি ও গ্রাম
টিকইল গ্রামটি নাচোল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। এ গ্রামটির আকৃতিগত দিক থেকে উত্তর ও দক্ষিণে লম্বা। উত্তরপাড়ায় মুসলমানদের বসবাস। আর দক্ষিণপাড়ায় ৮০ থেকে ৮৫ ঘর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বর্মণদের বাস। শেরপুর জেলায়ও কয়েক ঘর বর্মণ রয়েছে, যারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। বর্মণরা হিন্দুয়ানি রীতির পূজা ও কীর্তন করে থাকে। দুর্গাপূজা তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। টিকইল গ্রামে বর্মণপাড়ায় প্রায় প্রতিটি বাড়ির দেয়াল লোকচিত্রে শোভিত। একটি বাড়ি বিশেষ করে দাসু বর্মণের বাড়িটি দেয়ালচিত্রের আলপনার বাড়ি হিসেবে খ্যাত। আর পাড়ার প্রায় প্রতিটি দেয়াল আলপনায় চিত্রিত বলে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে গ্রামটি আলপনার গ্রাম হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের একটিই আলপনার গ্রাম হিসেবে পরিচিত টিকইল।
এ গ্রামটিতে কবে এবং কখন থেকে দেয়ালে আলপনা আঁকা হতো তার উৎস জানা যায়নি। তবে পূজা-পার্বণ, বিয়ে এবং মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেয় দেয়ালগুলোতে আলপনা আঁকা হতো সীমিত পরিসরে।
 
দেয়ালচিত্রের শিল্পী পরিচিতি
টিকইল গ্রামে দেয়ালচিত্র যারা আঁকতেন তারা কেউ পেশাদার শিল্পী নন। শুধু তাই নয়, শিক্ষার অভাব থাকায় আধুনিক শিল্পরীতি বা লোকশিল্প কী এসব ব্যাপারেও ধারণা নেই। দেয়ালচিত্রের শিল্পী মূলত নারীরা। নারীরাই কাজের অবসরে বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি বৈশাখী উৎসবে বা পহেলা বৈশাখে এবং পূজা উপলক্ষে বাড়ির কোনো কোনো দেয়াল আলপনায় রাঙিয়ে দেওয়া হতো উৎসবের বৈশিষ্ট্য অনুসারে। একপর্যায় দাসু বর্মণের স্ত্রীর মনের ভিতর যে শিল্পীসত্তা সুপ্ত ছিল তা জাগিয়ে তোলেন তার বাড়ির প্রতিটি দেয়াল আলপনায় রাঙিয়ে দিয়ে। তার শিল্পে যেসব চিত্র ও প্রাকৃতিক উপকরণসহ গাছ, লতাপাতা, ফুল-পাখি বানানো হয়, তা দেখতে খুবই আকর্ষণীয় এবং রঙের ব্যবহারও জুঁতসই। ফলে একপর্যায়ে দাস বর্মণের বাড়িটি আলপনা শৈলীর কারণে আলপনার বাড়ি হিসেবে খ্যাত হয়ে ওঠে। পাড়ার অন্যান্য বাড়ির প্রায় প্রতিটি ঘরের দেয়াল আলপনায় রাঙানো। এজন্য গ্রামটিকে আলপনার গ্রাম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। দেশের ও দেশের বাইরের পর্যটকরা আসেন, তাদের অভিব্যক্তির কথা ব্যক্ত করেন। এজন্য দাসু বর্মণের বাড়িতে একটি মন্তব্য খাতা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে দাসু বর্মণের কন্যা জয়া বর্মণের তথ্য থেকে জানা যায়।
 
রঙের ব্যবহার
আলপনা আঁকার জন্য একসময় প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হতো। দেখন বর্মণ জানান, একসময় তিনি প্রাকৃতিক রং তৈরি করে দেয়ালচিত্র এঁকেছেন। সেক্ষেত্রে বর্তমানে কেমিক্যাল রং ব্যবহার করছেন। চালের গুঁড়া ঘন করে পানিতে গুলে ব্যবহার করা হতো কালো রং।
 
দেয়ালচিত্র শিল্পী দেখন বর্মণ
দেখন বর্মণের বাবার বাড়ি মিজামপুর। বিয়ে হওয়ার পর থেকে টিকইল গ্রামের দাসু বর্মণের ঘর-সংসারে যাপিত জীবনে অবসর পেলেই মাটির দেয়ালে আলপনা আঁকায় মনোযোগী হতেন। পড়াশোনা বলতে তার কিছুই নেই। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করা তার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু শিল্পীর মন নিয়ে বেড়ে ওঠা দেখন বর্মণ বিভিন্ন মোটিফকে আলপনায় যে দৃশ্যমান রূপ দিয়ে আসছেন তা খুবই নান্দনিক। তাকে তার দেয়ালচিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, দেয়ালচিত্র তৈরির ক্ষেত্রে তিনি কোন কোন মোটিভকে, অর্থাৎ বস্তুর বা প্রকৃতির কোন কোন উপকরণ ব্যবহার করবেন তার পূর্ব প্রস্তুতি থাকে না। আলপনা আঁকতে গিয়ে তার মন থেকে যা আসে তা নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন।
দেয়ালচিত্র করতে গিয়ে প্রথমে তিনি চালের গুঁড়া দিয়ে সাদা রং তৈরি করতেন। প্রাকৃতিক সাদা রং সাদা মাটি ও লাল মাটি ব্যবহার করতেন আলপনা করার জন্য। বর্তমানে সাদা, লাল, হলুদ ও সবুজ এই কৃত্রিম রংগুলো দিয়ে নিজের মতো রং তৈরি করে নিয়ে দেয়ালচিত্র অঁাঁকেন। তিনি বলেন, ‘সখের জিনিস এইটি। আমি লেখাপড়া জানি না। মনের ভিতর থেকে, মাথার ভিতর থেকে যা আসে তাই নকশা করি। আমাদের বাড়িটার সব ঘরের দেয়াল খুব আকর্ষণীয় করে এঁকেছি। এজন্য আমাদের বাড়িটা দেখে সবাই বলতো আলপনা বাড়ি। এখন এই আলপনার কাজ হালকা-পাতলা করে হলেও সারা গ্রামে হয়ে থাকে, আর এজন্য আলপনা বাড়ি থেকে গ্রামটা আলপনা গ্রামে পরিণত হয়েছে।’ বর্তমানে তার উত্তরসূরি মেয়ে ও মেয়ের দিকে নাতনি আলপনার কাজে সহযোগিতা করে এবং তারা নিজেরাই আলপনা আঁকতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে।
 
দেখন বর্মণের আলপনার বৈচিত্র্য
লোকশিল্প তৈরির ক্ষেত্রে লোকশিল্পীদের নিজস্ব রুচির অবশ্যই প্রয়োজন আছে। আর নিজস্ব রুচি, চিন্তা-চেতনা ও খুব কাছের অভিজ্ঞতার দৃশ্যাবলি, পশু-পাখি শিল্পের উপকরণ হয়ে ওঠে। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে তা খুব মানানসই হয়ে ওঠে। কোনো নাগরিক রুচিবোধ তাড়িত করে নয়। তাড়িত লোকজ জগতের উপকরণ দিয়ে শিল্প তৈরিতে। লোকশিল্পের গ্রামীণ অবস্থাটা পুরোপুরি আলপনার মধ্য দিয়ে চিত্রিত হয়।
তার দেয়ালচিত্রে আঁকা হয়েছে বৃক্ষ, ফুল, পাতা, লতা, ময়ূর, কবুতর, ঘুঘু, হৃদয় আকৃতি, গ্রামীণ দৃশ্য, লোকপ্রযুক্তির গরুর গাড়ি, ঢেঁকিতে ধান ভানার ও কৃষক রমণী, কৃষি জমিতে গরু জোয়াল কাঁধে লাঙ্গল টানছে, কৃষক লাঙ্গল ধরে আছে, পাশেই ধান রোপণ করছে কৃষক, গাছতলায় রাখাল বাঁশি বাজাচ্ছে, কিছুটা দূরেই গরুর পাল; বৃক্ষ শোভিত মাটির ঘরের বাড়ি, বাড়ির পাশেই খড়ের গম্বুজ ও পরিবেশবান্ধব কলপাড়, কলপাড়ে পানি নেওয়ার জন্য গ্রাম্য রমণী; দূরে নদী, নদীর ওপারে আবার গ্রামের দৃশ্য; ফুলগাছ ও ফুলকে তিনি মোটিভ করে আঁকেন আলপনা। রঙে ও রেখার ফুল, পাতা ও বৃক্ষ তার মন থেকে ফোটা ফুলে পরিণত হয়ে যায়। ফুলের গাছ যে টবেও শোভা পায় তারও দেয়ালচিত্র রয়েছে। আধুনিক জীবনের প্রভাব যে গ্রাম অঞ্চলেও পড়েছে তার ছবিও আঁকা হয়েছে কলপাড় এবং টবে রাখা ফুল গাছ দেখলে বোঝা যায়। আর কৃত্রিম রং দিয়ে আলপনার রেখা মনের মতো মোটা ও চিকন করে টানা সহজ হয়। ফলে কৃত্রিম রংও ঐতিহ্যের প্রাকৃতিক রঙের পাশাপাশি গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশজ অর্থাৎ গ্রামীণ লোকশিল্পের উপাদানের সাথে নাগরিক জীবনের বৈশিষ্ট্যে নতুন বাস্তবতা যোগ হয়ে গ্রাম ও নগরের সমন্বয়ের রূপটি ক্ষীণভাবে হলেও উঠে আসছে। আলপনায় যে দেখন বর্মণের বিশেষ দক্ষতা ও মুন্সিয়ানা রয়েছে, তা দেয়ালচিত্রে চোখ পড়লেই বোঝা যায়। একটি উদাহরণ দিয়ে তা স্পষ্ট করা হলোÑ পাপড়িসহ ফুল এবং ফুলের বৃত্তের যে রেখা এবং রেখার মধ্যে পার্থক্য তা শিল্পিত মন না-হলে তার রূপ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। নানারকম আবেগ শিল্পীর আলপনায় মূর্ত হয়েছে দেয়ালচিত্রে। আলপনার জন্য দেখন বর্মণ পুরস্কৃতও হয়েছেন। উপজেলা পরিষদ নাচোল এবং সাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশন নাচোল থেকে তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন।
তার উত্তরাধিকার বহন করছে গোটা টিকইল গ্রাম। অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলার লোকশিল্পের এক শক্তিশালী বিষয় আলপনা চিত্র। নকশিকাঁথার মতোই এ শিল্পটি আমাদের কৃষিজীবী সমাজের মেয়েলি হাতের সৃষ্টি।’
 
লেখক : কবি, মুক্তিযুদ্ধ ও ফোকলোর গবেষক
উপ-পরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

 

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK