বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
ঢাকা সময়: ১৭:৪৭
ব্রেকিং নিউজ

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও একজন শাহেদ আলী কসাই

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও একজন শাহেদ আলী কসাই

লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক
 
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কাল্পনিক সাহিত্য রচিত হয়েছে; কিন্তু সঠিক ইতিহাস কম লেখা হয়েছে। অনেক অজানা ও অচেনা বীরদের যুদ্ধের ইতিহাস আজও লিপিবদ্ধ করা হয়নি। যারা অত্যাচারিত জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে দেশমাতৃকার ডাকে উত্তরাধিকার সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টায় আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকের কথা সময়ের পাটাতনে হারিয়ে গেছে। তাদের বীরত্বগাথা ও আত্মত্যাগ নিয়ে গবেষণার পরিধি এখনও সীমিত। তারা নিজেরা জ্বলে আলোকিত করলেন ভবিষ্যৎকে এবং সেই আলোকে জন্ম হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। অস্তিত্বের লড়াইয়ে এই মানুষজন অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সভ্যতার দীপ্ত দুপুরে মধ্যযুগীয় অন্ধকার এ দেশটাকে গ্রাস করেছিল। সেদিন যারা জীবনকে তুচ্ছ করে দেশমাতৃকার সেবায় এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন শাহেদ আলী কসাই।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস আন্দোলন ও সংগ্রামের মাস, দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা প্রকার ঘটনাপ্রবাহের মাস। এর প্রেক্ষিতে এই মাসে রংপুরে যেসব ঘটনা ঘটেছিল তার অনেকগুলো ঘটনা কিংবদন্তি হয়ে আজও এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ৭ই মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ রংপুরবাসীরা পরদিন সকালে শুনতে পান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের নির্দেশ অনুযায়ী রংপুর অঞ্চলের জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করে। সারা রংপুর অঞ্চলে চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চের পর পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ এলাকার অবহেলিত ও নির্যাতিত মানুষ যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৭১ সালে, তাদের মধ্যে শাহেদ আলী কসাই অন্যতম। তার বীরত্ব ও তার পরিবারের করুণ পরিণতির কথা জাতির শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা প্রয়োজন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই রংপুর অঞ্চলে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এই কমিটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের মাধ্যমে জনগণকে প্রতিটি গ্রামে ও মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
শাহেদ আলী ছিলেন রংপুর কোতোয়ালি থানার অন্তর্গত সম্মানীপুর গ্রামের খিজির উদ্দিন ও সালেহা বেগমের জ্যেষ্ঠ সন্তান। গ্রামটি রংপুর সেনানিবাস থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। শাহেদ আলী স্থানীয় বড়োবাড়ি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রংপুর শহরের মুনশিপাড়ায় কেরামতীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু পড়াশোনায় বেশ মেধাবী হলেও পিতার অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তিনি বুঝতে পারতেন যে তার পিতার একার উপার্জনের ওপর ভরসা করে এই বিশাল পরিবারের খরচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর তিনি কর্মজীবন শুরু করতে সচেষ্ট হন। চাষাবাদের জন্য তাদের তেমন কোনো জমিজিরাত ছিল না বলে নানান জায়গায় কাজের চেষ্টা করেও কোনো কাজ না পেয়ে পেটের দায়ে তিনি কসাইয়ের কাজ বেছে নেন। তিনি লালবাগ হাটের একটি মাংসের দোকানে কসাইয়ের কাজ শুরু করেন। ফলে তার পরিবারে কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। তবুও কৃষকের সন্তান কসাই হবে, সেটি তার বাবা-মা মেনে নিতে পারেননি এবং প্রায়ই এ বিষয়ে তারা দুঃখ প্রকাশ করতেন।
শাহেদ আলী ছিলেন গ্রামের সবার প্রিয়পাত্র। গ্রামের যে কোনো মানুষের বিপদে-আপদে এগিয়ে যেতেন সাহসী শাহেদ আলী। উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী শাহেদ আলী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখতেন। যদিও তিনি ছিলেন কসাই, তবুও গ্রামবাসীদের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে সব সময় আলোচনা করতেন। দেশ ও জাতির প্রতি তার ছিল প্রচ- মমত্ববোধ।
১৯৭১ সালে দেশের পরিস্থিতি শাহেদ আলীকে ভাবিয়ে তুলল। তার ছিল দুই স্ত্রী। তিনি তার স্ত্রীদের বলতেন, এই পাঞ্জাবিরা এদেশে থাকলে বাঙালিদের ওপর অনেক বিপদ ডেকে আনবে। তারা আমাদের মানুষের মতো বাঁচতে দেবে না। তার স্ত্রী আশরাফুন্নেসা ও কমলা সুন্দরী শাহেদ আলীর এসব কথা শুনে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন। যেহেতু তাদের গ্রামটি সেনানিবাসের কাছেই ছিল, তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র আর ক্ষমতা সম্বন্ধে তাদের কিছুটা ধারণা ছিল। তারা মনে করতেন, এই সেনাবাহিনী অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তারা শাহেদ আলীকে বলতেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে তারা গ্রামের সবাইকে হত্যা করবে। শাহেদ আলীকে সব সময় সাবধানে থাকতে বলতেন তারা।
মার্চ মাসের প্রথম থেকেই দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন চলছিল এবং সেনানিবাসের ঠিকাদারদের সহযোগিতায় রংপুর সেনানিবাসে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন থেকেই পাকিস্তানি সৈন্যরা রংপুর সেনানিবাস থেকে আশপাশের গ্রামে গিয়ে জোরপূর্বক মানুষের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও খেতের শাক-সবজি ছিনিয়ে আনত। গ্রামবাসী পাকিস্তানি সৈন্যদের এই দুষ্কর্মে বাধা দিলে তাদের ওপর চালানো হতো অমানুষিক অত্যাচার। ক্রমে এই অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে শুরু করে।
‘… ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’- বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিহত করতে গ্রামবাসীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে শাহেদ আলী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি পরদিন ৮ মার্চ সকালে গ্রামের বাজারে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন। সেদিন থেকেই তিনি গ্রামের মানুষকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও বলপূর্বক খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বলেন এবং প্রস্তুত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি তাদের আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার জন্য। তিনি তার গরু জবাই করার বড় ছোরাটা দেখিয়ে বলতেন, আমার এই ছোরা নিয়ে আমি প্রস্তুত, আপনারাও যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন। তার সঙ্গে একমত হয়ে গ্রামের তরুণরা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে কোনো প্রকার খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করবে না এবং আগের মতো বলপূর্বক খাদ্যসামগ্রী ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করবে। কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে শাহেদ আলী রংপুর সেনানিবাসের সৈন্যদের অনুকরণে কিছু প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ সকাল ১০টার দিকে রংপুর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবি অফিসার লে. আব্বাস কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে টহলে বের হয়। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও তারা বলপূর্বক খাদ্যসামগ্রী ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সম্মানীপুর গ্রামের হাজি জসিম উদ্দিন তাদের দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে গ্রামের ভেতর দিয়ে দৌড়িয়ে বলতে থাকেনÑ সেনানিবাস থেকে এক দল মিলিটারি তাদের গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের উদ্দেশ্য বলপূর্বক গ্রাম থেকে খাদ্যসামগ্রী লুট করা। লে. আব্বাস ছিল ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের একজন অফিসার। ইতোপূর্বেও সে সেনানিবাসের আশপাশের গ্রাম থেকে বলপূর্বক খাদ্যসামগ্রী ছিনিয়ে আনত। লে. আব্বাস একটি জিপে সেনানিবাসের পশ্চিম গেট দিয়ে সম্মানীপুর ও দমোদরপুর গ্রামের দিকে রওনা দেয়। তার সঙ্গে ছিল একজন ড্রাইভার ও চারজন সশস্ত্র সৈন্য। গ্রামের দিকে তার এগিয়ে যাওয়ার খবরটি আশপাশের গ্রাম সম্মানীপুর, দমোদরপুর, বড়োবাড়ি ও মনোহরপুরে ছড়িয়ে পড়ে।
 
 
হাজি জসিম উদ্দিনের কাছ থেকে খবর পেয়ে শাহেদ আলী তার ছোরা নিয়ে দৌড়ে গ্রামবাসীদের একত্রিত করতে থাকেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিহত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেনÑ আর অত্যাচার সহ্য করা হবে না, আমরা আমাদের সম্পদ ছিনিয়ে নিতে দেব না। আশরাফুন্নেসা অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে শাহেদ আলীকে যেতে বাধা দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে গ্রামের যে রাস্তাটি রংপুর সেনানিবাসের দিকে গেছে, সেদিকে চলে যান শাহেদ আলী। পথে তিনি চিৎকার করে তার দলের সদস্যদের যার যা আছে তা নিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে নির্দেশ দিতে থাকেন। শাহেদ আলীর সঙ্গে গ্রামের কয়েকজন তরুণÑ আবদুর রহিম, বাবুল, রফিক, হায়দার, জসিম ও গুলজার হাতে শাবল, লাঠিসোটা, কুড়াল, দা, বর্শা অর্থাৎ যে যা সামনে পেয়েছে, তা নিয়ে দৌড়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে সমবেত হন।
শাহেদ আলী ও তার সঙ্গীরা দেখতে পান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জিপটি কাঁচা রাস্তা দিয়ে গ্রামের দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে। রাস্তার পাশে ছিল কিছু উঁচু জমি, যা ঝোপঝাড়ে পূর্ণ ছিল। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেন শাহেদ আলী। সেই ঝোপের আড়ালে শাহেদ আলী ও তার সঙ্গীরা এমনভাবে অবস্থান গ্রহণ করেন যেন পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের দেখতে না পায়। শাহেদ আলী সঙ্গীদের নির্দেশ দেন যে, প্রথমে তিনি সামনে উপবিষ্ট অফিসারকে আক্রমণ করবেন এবং তারপরই যেন বাকিরা পিছনের সৈন্যদের আক্রমণ করেন। আক্রমণ অতি দ্রুত করতে হবে যেন সৈন্যরা রাইফেল দিয়ে গুলি করার সুযোগ না পায়। সৈন্যসহ জিপটি ঢিবির কাছে পৌঁছাতেই শাহেদ আলী উঁচু ঝোপ থেকে বেরিয়ে দ্রুত জিপের বনেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং মুহূর্তেই লে. আব্বাসকে ছোরা দিয়ে আঘাত করেন। সঙ্গে সঙ্গে শাহেদ আলীর সঙ্গীরা গাড়ির পিছন দিকে বসা সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি সৈন্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শাহেদ আলী ও তার সঙ্গীরা সৈন্যদের হাত থেকে অস্ত্রগুলো ছিনিয়ে নেন এবং সৈন্যদের আঘাত করতে থাকেন। তাদের আক্রমণে লে. আব্বাস ও অন্য সৈন্যরা তখন মৃতপ্রায়। ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী মনোহরপুর গ্রামের সৈনিক নুরুল ইসলাম যিনি ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন সেখানে উপস্থিত হন। অভিজ্ঞ নুরুল ইসলাম শাহেদ আলীকে বলেন, যদি পাকিস্তানি সৈন্যরা দমোদরপুর ও সম্মানীপুর গ্রামের কাছে তাদের সৈন্যদের এমন অবস্থায় দেখতে পায়, তাহলে তারা এই এলাকায় গণহত্যা চালাবে এবং গ্রামগুলোকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। তিনি তাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জিপ ও আহতদের দূরে কোনো ফাঁকা জায়গায় ফেলে আসার পরামর্শ দেন। তার কথা সবার মনঃপূত হলো। তাদের অনুরোধে নুরুল ইসলাম নিজে জিপ চালিয়ে আহতদের দমোদরপুর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ডাঙিরপাড় নামক স্থানের একটি পরিত্যক্ত জায়গায় জিপসহ ফেলে আসেন। সেখানে গ্রামবাসীরা বল্লমের আঘাতে জিপের টায়ার ক্ষত-বিক্ষত করে দেন, যেন তা আর চলতে না পারে।
লে. আব্বাসের ফেরত আসতে দেরি দেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি উদ্ধারকারী দল চারদিকে খুঁজতে থাকে এবং সন্ধ্যার পর তাদের ডাঙিরপাড় থেকে শোচনীয় অবস্থায় উদ্ধার করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছিল লে. আব্বাস। দলটি তাকে ও অন্য সৈন্যদের মুমূর্ষু অবস্থায় সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণেশপুর এলাকাকে ঘটনাস্থল মনে করে প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে পরদিন গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয়। তারপর তারা সেনানিবাসের পশ্চিম দিকের আদর্শ গ্রামটিও জ্বালিয়ে দেয়।
পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর গ্রামবাসীদের আক্রমণের পর রংপুর সেনানিবাসে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি অফিসার সেনানিবাসের আশপাশের গ্রামে আক্রমণ করে ধূলিসাৎ করার মতো পোষণ করে। কিন্তু অধিনায়কগণ তাদের আপাতত শান্ত থাকার জন্য বলে এবং ভবিষ্যতে এর প্রতিকার হবে বলে আশ্বাস দেয়। ২৪ মার্চ রাতে সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লে. আব্বাস ও আহত সৈন্যদের মৃত্যু হয়।
শাহেদ আলী এ ঘটনার পর নিজের গ্রাম ত্যাগ করে তার কর্মস্থল লালবাগ হাটে অবস্থান নেন। যাওয়ার আগে তিনি তার স্ত্রীদের বলেন, পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসবেন। তার স্ত্রীদেরও তিনি গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে গিয়ে অবস্থান নিতে বলেন। তিনি মনে করেছিলেন, লালবাগ হাট তার গ্রাম থেকে বেশ দূরে বলে হয়তো পাকিস্তানি সৈন্যরা সেখান থেকে তাকে ধরতে পারবে না। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী লে. আব্বাসের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খোঁজ করতে শুরু করে। সম্মানীপুর গ্রামের আমজাদ নামে একজন দুষ্ট প্রকৃতির লোক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চর হিসেবে কাজ করত। বেঁটে প্রকৃতির ছিল বলে এলাকাবাসী তাকে ‘গাটিয়া আমজাদ’ বলে ডাকত। গাটিয়া আমজাদ পাকিস্তানি সৈন্যদের খবর দেয় যে শাহেদ আলী লালবাগ হাটে অবস্থান করছে। গাটিয়া আমজাদ পাকিস্তানি সৈন্যদের গোপনে লালবাগ হাটে নিয়ে কসাইয়ের দোকানে শাহেদ আলীকে শনাক্ত করে দেয়। দুজন পাকিস্তানি সৈন্য হঠাৎ পিছন থেকে শাহেদ আলীকে জাপটে ধরে। শক্তিশালী শাহেদ আলী মুহূর্তেই তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। আরেকজন সৈন্য তার মাথায় রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে ও অন্য একজন বেয়োনেট দিয়ে তার বাম চোখে আঘাত করে, এতে তার চোখ বেরিয়ে আসে। পাকিস্তানি সৈন্যরা গুরুতর আহত শাহেদ আলীকে জিপের পিছনে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যায়। শাহেদ আলীর পরিবারের সদস্যরা এ ঘটনা জানতে পেরে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। পরদিন লালবাগ হাট থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে লাহিড়ীর হাটের কাছে একটি কর্দমাক্ত স্থানে তার ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার শরীরে ছিল বেশ কয়েকটি গুলি ও নির্যাতনের চিহ্ন। তার দুটি চোখই উপড়ে ফেলা হয়েছিল এবং মাথায় আঘাতের ফলে মগজ বের হয়ে গিয়েছিল। গ্রামবাসীরা শাহেদ আলীর মৃতদেহ সম্মানীপুর গ্রামে এনে তার বাড়ির পিছনে যখন কবর দেওয়া সম্পন্ন করেন তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার গ্রামে উপস্থিত হয়। তারপরই শুরু হয় শাহেদ আলীর পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন। পাকিস্তানি সৈন্যরা শাহেদ আলীর প্রথম স্ত্রী আশরাফুন্নেসাকে মাথায় আঘাত করে এবং দ্বিতীয় স্ত্রী কমলা সুন্দরীকে চরম নির্যাতন করে। এ ঘটনার পর আশরাফুন্নেসা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন এবং নির্যাতনের পর কমলা সুন্দরী মৃত্যুমুখে পতিত হন।
শাহেদ আলীর চার মেয়ের (মাজেদা, পারুল, পারভীন, সাহেদা) মধ্যে দুজন (পারুল ও সাহেদা) ও দুই ছেলে (আজাদ ও আজহারুল) জীবিত আছেন।
মুক্তিযুদ্ধে শাহেদ আলী প্রথম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর গেরিলা আক্রমণের পরিকল্পনা করে সার্থক বাস্তবায়ন করেন। তিনি ছিলেন গেরিলা যুদ্ধের নেতা। তার সহযোদ্ধারা ছিলেন গেরিলা। যারা কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঁচজন শত্রু সৈন্যকে নিধন করতে সক্ষম হন। অবিশ্বাস্য সাহসিকতার অধিকারী গ্রামবাংলার এই সাধারণ মানুষটি কসাইয়ের ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকদের ওপর। ইতিহাসে এ-রকম বীরত্ব বিরল।
শহিদ শাহেদ আলী কালজয়ী ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বাধীনতার পূর্বাভাস পেয়েছিলেন; কিন্তু স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি, স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেননি। তার হৃদয়বিদারক মৃত্যুতে আমরা দুঃখিত। সৃষ্টি ও মুক্তির জন্য তিনি তার জীবনটাকে দিয়ে গেছেন। মমত্বই তার শ্রেষ্ঠ পাওনা। দেশপ্রেমের উদ্দীপনা হৃদয়ে ধারণ করে তিনি এগিয়ে গেছেন মৃত্যুকে উপেক্ষা করে। তার আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি; বরং সহস্র ধারায় বিকশিত হয়ে পল্লবিত হয়েছে বিজয়ের মাধ্যমে।
 
লেখক : স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত, পদ্মশ্রী

  মন্তব্য করুন
     FACEBOOK